কোনো একটি বই সম্পর্কে আলোচনা-সমালোচনার কাজটি একটি উপভোগ্য বিষয়। শরীর, মন ও মগজ তিনটিরই কাজ একসাথে করা যায়। রোলাঁ বার্ত বলেছেন-“পড়া আসলে এক ধরনের বিশিষ্ট কাজ”। ফলে বই যদি পড়ার মতো করে পড়া যায়, তাহলে ভাবতে হয় খুব। পণ্ডিতদের কেউ কেউ আবার বলেছেন- “পড়া একটি আনন্দদায়ক উপলব্ধি।” একটি বই সম্পূর্ণ পাঠ করার পর মননজগতে একটি নতুন অনুভূতির উদ্ভব হয়। মনটা এক নতুন রঙে রঙিন হয়ে ওঠে। এক অপার্থিব অভিজ্ঞতার আবেশ কালব্যাপী সমস্ত আমিত্বকে ঘিরে থাকে। তাই বলা যায় বইজীবনের চাইতে সুখের জীবন আর হয় না। বই পড়ার কাজটা আরও আনন্দদায়ক হয়ে ওঠে, যদি সেই বইটি অন্য কাউকে পড়ানো যায়। একটি পছন্দের বই পড়া ও পড়ানো দুটো একসাথে মিলে গেলে আনন্দটা অনির্বচনীয় অনুভূতিতে রূপ নেয়। এটা আমরা সবাই বুঝি ও মানি।
মানুষ হিসেবে আমরা আনন্দিত হতে পছন্দ করি, আর সেই আনন্দকে ছড়িয়ে দিয়ে অন্যকে আনন্দিত করে তুলতে আরও বেশি পছন্দ করি। আনন্দকে ভাগ করে নিতে ও দিতে মানুষ মানুষের আরও কাছাকাছি আসে, থাকে। এই সরল কার্যক্রমের মাধ্যমে আমরা মনুষ্যেতর থেকে আরও মানবিক হয়ে উঠি। গড়ে তুলি সুখপ্রদ, আনন্দময় জীবন, জনপদ, সমাজ।
যে বই পাঠের তৃপ্তি, আনন্দ অন্যকে জানাতে ইচ্ছা করে, সে বই আমরা অন্যকে পড়তে দেই, পড়তে বলি। নিজের ভালোলাগা এমনকি মন্দলাগা কোন বইয়ের বিবরণ আমরা উৎসাহের সাথে অন্যকে জানাই। নিজের অনুভূতির যথার্থতা যাচাই করতে অন্যকে আহ্বান জানাই। এই যে নিজের অনুভূতি অন্যকে জানানোর প্রক্রিয়া, তার কোন বিধিবদ্ধ বিধান নেই। তাই কোন একটি গ্রন্থপাঠের অভিজ্ঞতা সামাজিক বা পারিবারিকভাবে অন্যদের কাছে আমরা যে পদ্ধতিতে প্রকাশ করি, তা অনেক সময়ই নৈর্ব্যক্তিক থাকে না। একান্ত ব্যক্তিগত শুভ-অশুভ বোধের সাথে জট পাকিয়ে যায়। যা অন্যদের সামনে পাঠকৃত গ্রন্থটি সম্পর্কে চিত্রের একপাশ শুধু প্রকাশ করে। আর অন্যপাশ থেকে যায় অনুচ্চারিত। এমন অবস্থা কাঙ্ক্ষিত নয়।
পাঠকৃত বই সম্পর্কে অন্য কাউকে যথাযথ বর্ণনা দেয়ার একমাত্র উপায় কাঠামোবদ্ধ আলোচনা। নির্দিষ্ট কিছু নির্ণায়ককে সামনে রেখে কোন বইকে অন্যদের সামনে উপস্থাপন করার অপর নাম গ্রন্থ আলোচনা সমালোচনা পর্যালোচনা, বই আলোচনা, সমালোচনা, পুস্তক পর্যালোচনা, বিশ্লেষণ ইত্যাদি। আমরা আমাদের নিজেদের ভালোলাগা-মন্দলাগা বইগুলো সম্পর্কে অন্যদেরকে জানাতে চাই। এই জানানোটা যেন খাপছাড়া এলোমেলো হয়ে না যায়, সেজন্য গ্রন্থ সমালোচনা সম্পর্কে বিভিন্নজন বিভিন্নরকম রূপরেখা প্রস্তাব করেছেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিজেদের প্রয়োজনমতো বিভিন্ন নির্দেশনা প্রদান করেছে। এই পদ্ধতিগুলো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানভেদে ভিন্নরকম হতে পারে। কিন্তু কোনটিই একটি বইয়ের সম্পূর্ণ আলোচনা করার মতো পূর্ণাঙ্গ বিধান প্রদান করে না। এর ব্যাখ্যা বিবিধ।
সার্বিকভাবে বলা যায় গ্রন্থ সমালোচনার জন্য নির্দিষ্ট কোনো বাঁধাধরা নিয়ম বেঁধে দেয়া সম্ভব নয়। তবে আলোচনাকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে স্থির রাখতে বিভিন্ন বিষয়-প্রসঙ্গকে বিচার্য করে তোলা যায়। প্রতিষ্ঠানভেদে কয়েকটি মাত্র নির্ণায়ককে আলোচ্য করে তোলার প্রবণতা আছে। তবে আপাতভাবে বলা যায় কি করা উচিত, কিভাবে করা উচিত এ বিষয়ে মতভেদ খুবই কম। বরং পাঠকের মনজগতে যা আলোড়ন তুলেছে, তার বিবরণ যেন বিস্তারিত হয় সেই প্রচেষ্টাটাই কাঙ্ক্ষিত। প্রত্যেক পাঠক পরস্পরের চাইতে ভিন্ন ভিন্ন মননবোধের অধিকারী। সেজন্য গ্রন্থ পর্যালোচনার কোন সর্বজনীন নিয়ম তৈরি করা সম্ভব নয়। গ্রন্থ বিশ্লেষণের প্রবন্ধটি লিখবার সময় এর ধারাবাহিকতাকে গতিময় রাখার জন্য যেসব বিষয়ের দিকে লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন সেইসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে পারি।
সেইসব বিষয়কে আমরা বলি সমালোচনার নিয়ম নীতি। এই নীতিমালা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিজেদের প্রয়োজনমতো নির্ধারণ করে। কারণ কোন একটি বই বিভিন্ন দিক থেকে বিশ্লেষণ করা সম্ভব। অনেক অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যায়। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বইটির দিকে তাকানো যায়। বইটির বিভিন্ন উপাদানকেই আলোচ্য করে তোলা যায়। বিভিন্নরকম মানসিকতা বইয়ে লিখিত উপাদানকে ভিন্নরকমভাবে গ্রহণ করবে সেটাই স্বাভাবিক। অনেক বিষয় বা দৃষ্টিকোণ বা উপাদানগুলোকে একটি তালিকাবদ্ধ করে বই আলোচনার প্রস্তাব করা হয়। এটা আসলে করা হয় যেন আলোচনা করতে করতে আলোচক খেই হারিয়ে না ফেলেন।
নতুন গ্রন্থবিশ্লেষককে গ্রন্থ সমালোচনার বিভিন্ন নীতিমালা, বিধিবিধান ইত্যাদির সাথে আমরা মাঝে মাঝে পরিচয় করিয়ে দেব। অনলাইনে প্রাপ্ত বিশ্বের বিভিন্ন শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরামর্শগুলো আমরা অনুবাদ করবো। 'বিশ্লেষণী সক্ষমতা অর্জন করার বিষয়’- তা মান্য ভাবার মতো বিনয় আমাদের আছে।
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম