ত্রৈমাসিক শিশু-কিশোর পত্রিকা
শিশুকিশোর ফাউন্ডেশন, ঢাকা।সম্পাদক: ইকবাল কবীর মোহন
প্রকাশক: নার্গিস মুনিরা
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ: হামিদুল ইসলাম
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ৫৬, মূল্য: ৫০ টাকা
বর্ষ ৩। সংখ্যা ১০। জানুয়ারি-মার্চ ২০১৭
ত্রৈমাসিক শিশু-কিশোর পত্রিকাটি হাতে নিতেই মনটা ভাল হয়ে গেল। এটা ছিল ২০১৭ সালের জানুয়ারি-মার্চ সংখ্যা। ৩য় বর্ষের ১০তম এই সংখ্যায় "ভাষা আন্দোলন আমাদের অহঙ্কারের লড়াই" শিরোনামকে প্রাধান্য দিয়ে প্রকাশিত পত্রিকাটি শিশু কিশোরদের ভাল লাগবেই। গল্প, কবিতা, উপন্যাস, জীবনী, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, পরিবেশ-প্রকৃতি কী নেই এখানে?
সম্পাদক ইকবাল কবীর মোহন তাঁর সম্পাদকের কথা'য় বলেন-
ভাষার জন্য এদেশের মানুষকে অনেক সংগ্রাম ও আন্দোলন করতে হয়েছে। দিতে হয়েছে বুকের তাজা রক্ত। … আমাদের আরো আনন্দ এ জন্য যে, বাংলাভাষা আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এই ভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখার জন্য আমরা সর্বদাই তৎপর থাকবো এটাই জাতির প্রত্যাশা।একজন যথার্থ বাঙালির মতন দেশপ্রেমে সমুজ্জ্বল তার প্রাণ। আর এর চিহ্ন ছড়িয়ে আছে তার সম্পাদনায় প্রকাশিত ত্রৈমাসিক শিশু-কিশোর পত্রিকা এর পাতায় পাতায়। শিশু কিশোর ফাউন্ডেশন এর পক্ষে পত্রিকাটি প্রকাশ করেছেন নার্গিস মুনিরা। সম্পাদক ও প্রকাশক তাদের মনের সমস্ত মাধুর্য মিশিয়ে সমস্ত পত্রিকাটি বর্ণবৈচিত্র্যে সাজিয়ে তুলেছেন। তাদের সৌন্দর্যবোধ শুধুমাত্র যথাযথ রঙ ও ছবি ব্যবহারে নয়, নান্দনিক অলংকার ও মনোমুগ্ধকর স্কেচের মধ্যেও ফুটে উঠেছে।
প্রধান প্রবন্ধ ভাষা-আন্দোলন আমাদের অহঙ্কারের লড়াই লিখেছেন আহমদ রফিক। জাতীর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কোন ঘটনার ইতিহাস বলা সহজসাধ্য নয়। বিশেষ করে অল্পবয়সী পাঠকদের উদ্দেশ্যে হলে তো কাজটা আরও জটিল হয়ে পড়ে। কিন্তু আহমদ রফিকের অনবদ্য লেখনী পাঠককে বরং আরও জানতে উৎসাহী করে তোলে। তিনি ইতিহাসের নৈর্ব্যক্তিক অবস্থান থেকে সাহিত্যিক আবেগ মিশিয়ে ভাষা আন্দোলনের ঘটনা পূর্বাপর তুলে ধরেছেন। তার রচনায় অনেক তথ্য আছে যা পাঠকের জ্ঞানতৃষ্ণাকে আরও বাড়িয়ে তুলবে।
যেমন "রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই" দাবীর পক্ষে সমস্ত বাঙালিরা যখন একাত্ম হয়ে গিয়েছিল, তখনও এদেশীয় কিছু রাজনীতিবিদ সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করার বিরোধীতা করতেছিল।
… সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা বাঙালি রাজনীতিবিদরাও এ দাবি মানতে চায়নি। যেমন খাজা নাজিমুদ্দিন, নুরুল আমিন, ফজলুর রহমান, সবুর খান, তমিজুদ্দিন খান। এমনকি মাওলানা আকরম খাঁ পর্যন্ত একই সুরে কথা বলেছেন।
সারা বাংলাদেশের প্রতিবাদী ছেলেরা রাজনীতিবিদদের এই পক্ষপাত মেনে নেয়নি। তারা নিজেদের মতো করেই সর্বস্তরে বাংলা চালু করে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে বিক্ষোভ মিছিল করতে থাকে। তাদের চেতনার সাথে পরবর্তীতে শিক্ষক, লেখক, বুদ্ধিজীবী, সাধারণ মানুষ সকলে একাত্মতা ঘোষণা করেন। লেখক আহমদ রফিক বর্ণনা করেন:-
তাদের সঙ্গে ক্রমে যোগ দেন শিক্ষক, সাংবাদিক, লেখক, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী শ্রেণীর মানুষ। পরে ধারাণ মানুষ। যেমন শহর ঢাকায় তেমনি দেশের সর্বত্র শহরে এবং গ্রামগঞ্জের শিক্ষায়তনে। বাংলাকে ভালোবাসেন এমন কিছুসংখ্যক নামকরা অধ্যাপক বাংলার পক্ষে প্রবন্ধ লেখেন। যেমন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ড. কাজী মোতাহার হোসেন, ড. মুহাম্মদ এনামুল হক।
আবার কেউ কেউ বাংলার বিরুদ্ধেও লেখেন। যেমন কবি গোলাম মোস্তফা, অধ্যাপক সাজ্জাদ হোসাইন ও হাসান জামান, সাংবাদিক মাওলানা আকরম খাঁ, মুজিবুর রহমান খাঁ, এমনকি মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী। বাঙালি আমলাদের মধ্যে এ বিষয়ে সক্রিয় ছিলেন মীজানুর রহমান। আর মুসলিম লীগের বড় বড় বাঙালি নেতা? তারা সবাই ছিলেন বাংলার বিরুদ্ধে- যে কথা আগে বলা হয়েছে।
লেখকের মতে ভাষা আন্দোলন মূলত শুরু হয়ে যায় ১৯৪৭ সালে। ছাত্ররা বাংলা রাষ্ট্রভাষার পক্ষে বিক্ষোভ প্রতিবাদ করতে শুরু করে।
এর কারণ? কারণ গণপরিষদে বাংলা ব্যবহারের জন্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাব বাতিল। বাঙালি মুসলমান সদস্য ও অবাঙালি সবাই মিলে বাংলার বিরুদ্ধে ভোট দেন।
এর প্রতিবাদে ছাত্ররা ঢাকাসহ সারা দেশে বেশ জোরদার আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। ১৯৪৮ সালের
মার্চের ১১ তারিখ থেকে ১৭ তারিখ পর্যন্ত এ আন্দোলন চলেছে সবখানে। ঢাকায় এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন শামসুল হক, নঈমুদ্দিন আহমদ, শেখ মুজিবুর রহমান, মোহাম্মদ তোয়াহা, কাজী গোলাম মাহবুব, তাজউদ্দীন আহমদ ও আরো অনেকে।
১৯ মার্চ জিন্নাহ সাহেব ঢাকায় আসেন। ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ও ২৪ মার্চ কার্জন হলে বক্তৃতা করেন। দুই জায়গাতেই তিনি উর্দু ভাষার পক্ষে কথা বলেন। সে সময় আব্দুল মতিনসহ ছাত্ররাই নো নো বলে প্রতিবাদ করে উঠেছিল।
১৯৫০ সালের ১১ মার্চে গঠিত 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ' এর আহ্বায়ক নির্বাচিত হন আব্দুল মতিন। তার নেতৃত্বে পরবর্তী দুই বৎসরের মধ্যে ভাষা আন্দোলন বেশ জোরদার হয়ে ওঠে। মুসলিম লীগ সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানকে দিয়ে বাংলা ভাষাকে বিকৃত করার ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। প্রবন্ধের লেখক আহমদ রফিক বলেন:
তার পরিকল্পনায় শুরু হয় আরবি হরফে বাংলা লেখার ষড়যন্ত্র। সেই সময় চলে বাংলাকে ইসলামী করে তোলার উদ্ভট চেষ্টা, পূর্ববঙ্গে উর্দু শিক্ষা বাড়ানোর জন্য কেন্দ্র থেকে প্রচুর অর্থ বরাদ্দ করা হয়। হরফ ষড়যন্ত্রে পূর্ববঙ্গ থেকে যেসব শিক্ষক, সাহিত্যিক বিশেষভাবে যুক্ত হন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কবি গোলাম মোস্তফা, অধ্যাপক সৈয়দ সাজ্জাদ হোসাইন, আশকার ইবনে শাইখ, হাসান জামান, উর্দুভাষী অধ্যাপক ড. সাদানি, আমলা মীজানুর রহমানের মতো বিশিষ্ট ব্যক্তি।ত্রৈমাসিক শিশু-কিশোর পত্রিকাটি আকারে বেশ বড়। পাশাপাশি আট ইঞ্চি ও খাড়াখাড়ি প্রায় এগার ইঞ্চি। ম্যাগাজিনের সূচনাতে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিশ্বদিবস নান্দনিক রঙে সাজিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে। জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত যে দিবসগুলোর কথা সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো হল:
- জানুয়ারি মাসের শেষ রোববার: বিশ্ব কুষ্ঠ দিবস
- ২৬ জানুয়ারি: আন্তর্জাতিক শুল্ক দিবস
- ২ ফেব্রুয়ারি: আন্তর্জাতিক জলাভূমি দিবস
- ২১ ফেব্রুয়ারি: আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস
- ৮ মার্চ: আন্তর্জাতিক নারী দিবস
- ১৫ মার্চ: বিশ্ব ক্রেতা অধিকার দিবস
- ২১ মার্চ: আন্তর্জাতিক বর্ণবৈষম্য বিলোপ দিবস
- ২২ মার্চ: বিশ্ব পানি দিবস
- ২৩ মার্চ: বিশ্ব আবহাওয়া দিবস
- ২৪ মার্চ: বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস
- মার্চের ২য় সোমবার: কমনওয়েলথ দিবস
পঞ্চম ও ষষ্ঠ পৃষ্ঠায় রয়েছে জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসে জন্ম গ্রহণ করা কয়েকজন সাহিত্যিক, লেখক, বিজ্ঞানী, মুক্তিযোদ্ধা, কবি শিল্পীর জীবনী। বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের ছোট একটি ছবি দিয়ে সংক্ষিপ্ত বিবরণ প্রকাশের আইডিয়াটা দারুণ। অল্প কয়েকটি বাক্যে প্রকাশিত বিবরণ পাঠককে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে জানতে আরও আগ্রহী করে তুলবে। এই মাস তিনটিতে যে স্মরণীয় ব্যক্তিবর্গ জন্মগ্রহণ করেছেন, তাঁরা হলেন:-
- ১ জানুয়ারি, ১৯০৩: কবি জসীম উদদীন
- ৪ জানুয়ারি, ১৬৪৩: বিজ্ঞানী আইজাক নিউটন
- ২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৩: বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান
- ৮ ফেব্রুয়ারি, ১৮২৮: বিজ্ঞান কল্পকাহিনী লেখক জুল ভার্ণ
- ১১ ফেব্রুয়ারি, ১৮৮২: কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
- ১২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৩: কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস
- ১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯১৬: বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করীম
- ১৭ ফেব্রুয়ারি, ১৮৯৯: কবি জীবনানন্দ দাশ
- ২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫০: সংগীতশিল্পী আজম খান
- ৯ মার্চ, ১৯৩২: চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী
- ১৪ মার্চ, ১৮৭৯: বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন
যদি ছেলেটি ঐ পোষা হাঁসকে পাহারা দিয়ে নিরাপদে রাখে তাহলেই তাকে অভিশাপ মুক্ত করবে। তার ভালো মানুষির পুরস্কার পাবে।শেষ পর্যন্ত নিলস পুর্ণাঙ্গ মানুষের আকার ফিরে পায় কী না তা অবশ্য জানা যায় নি। কারণ বেশ বড় আকারের কিশোর উপন্যাসটি এই সংখ্যায় সম্পূর্ণ প্রকাশ করা হয় নি। বাকী অংশ আগামী সংখ্যায় প্রকাশ করার জন্য রেখে দেয়া হয়েছে।
ইউরোপের দেশ হল্যান্ড (নেদারল্যান্ড) ভ্রমণের কাহিনী লিখেছেন দিলারা মেসবাহ। তার ভ্রমণকাহিনীর নাম স্বপ্নের দেশ হল্যান্ড।
১৯৯৭ সালে দিলারা মেসবাহ ইউরোপের প্যারিস, লন্ডন ও হল্যান্ড ভ্রমণের সুযোগ পেয়েছিলেন। সেই সময়ের অভিজ্ঞতা বেশ মনোহর করে বর্ণনা করেছেন। পড়তে পড়তে একজন স্বপ্নপ্রবণ পাঠক হল্যান্ডে যে চলে যাবেন একথা নিশ্চিত করে বলা যায়।
দিলারা মেসবাহের বর্ণনায় হল্যান্ডের নাগরিকদের এক অনুপম পুষ্পপ্রেমী মনের কিছু চিত্র-
হল্যান্ডের ঘরবাড়িগুলো যেন হুরপরীদের। লেসের সফেদ পর্দা মেঘের মতো উড়ছে জানালায় জানালায়। জানালার কার্নিশে কার্নিশে ছোট ছোট টবে অফুরন্ত ফুলের হাসি। প্রতিটি বাড়ি যেন দক্ষ শিল্পীর মমতাময় তুলির টানে আঁকা জলরং ছবি। একদিন সুপ্রভাতে দেখলাম প্রায় এক সাইজের ফোটা উজ্জ্বল বর্ণের টিউলিপ ফুলের সারি সারি গাছ লাগানো হচ্ছে দেয়াল ঘেঁষে। মনকে মুহূর্তে চাঙ্গা করে তোলে এইসব অপূর্ব দৃশ্য। হল্যান্ডের মানুষেরা জাতশিল্পী।
ফুল ফোটানো, ছবি আঁকা, সঙ্গীতচর্চা এদের রক্তের প্রবাহে। এদের জীবনযাপনে ফুল বুঝি অপরিহার্য। বাড়ির কার্নিশে, অফিসে রাস্তার দু'পাশে কোথায় নেই তাজা ফুলের হাসিমুখ। রফতানির জন্যও হল্যান্ডে ব্যাপকভাবে ফুলের চাষ করা হয়। শুধু ফুল রফতানি করেই হল্যান্ডবাসীরা প্রতি বছর কয়েক হাজার কোটি টাকা উপার্জন করে। সারা দুনিয়ার সত্তুর ভাগ ফুল ব্যবসাই হল্যান্ডের দখলে। বছরভর নানাজাতের ফুলের চাষ করার জন্য হল্যান্ডে আছে হাজার হাজার গ্রিন হাউজ। ওদের ভাষায় এসব গ্রিন হাউজকে বলা হয় ক্যাসল। গ্রিন হাউজের মধ্যে তাপমাত্রা, জলীয় আর্দ্রতা এমনকি রোদের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে সারা বছর নানাজাতের ফুল, শাক-সবজি উৎপাদন করা হয়।
কোটরে পেঁচা |
স্যার রোল্যান্ড হিল |
উপযুক্ত আকারের বর্ণ, ঝকঝকে ছাপা, রঙের নান্দনিক ব্যবহার, রঙিন ছবি, বিভিন্ন পাতায় অলংকরণ সর্বোপরি ভালো মানের সাদা কাগজ ত্রৈমাসিক শিশু-কিশোর পত্রিকাটির মান অনেক উঁচুতে নিয়ে গিয়েছে। এই ধরণের দৃষ্টিনন্দন, সুখপাঠ্য, তথ্যবহুল, মনোলোভা রঙে সাজানো-অলংকৃত পত্রিকা শিশুকিশোরদের জন্য খুব উপযোগী। তাদের স্বপ্নীল মনকে আরও রঙিন মায়ায় রাঙিয়ে তুলতে এই পত্রিকা সত্যিই বিশেষভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বাংলা ভাষায় এই মানের পত্রিকা আরও প্রকাশিত হওয়া উচিত। এই পত্রিকার প্রকাশনা নিয়মিত থাকুক, প্রতি সপ্তাহে প্রকাশ হোক এই প্রত্যাশা করি। তিন মাসে একবার পেয়ে কোন পাঠকেরই মন ভরবে না।