স্বামী তেজসানন্দ
১৮৬৭ সালের ২৮ অক্টোবর জন্ম নিয়েছিলেন তিনি। জন্মস্থান সুদূর আয়ারল্যান্ডের রাষ্ট্রেভর শহরে। পিতার নাম স্যামুয়েল রিচমন্ড আর মাতার নাম মেরি ইসাবেল। জন্মের পর পিতামহী মার্গারেট এলিজাবেথ নীলাসের নামের সাদৃশ্য রেখে নাম রেখেছিলেন মার্গারেট এলিজাবেথ। ভিন্ন দেশে, ভিন্ন পরিবেশে জন্মগ্রহণ করে কিভাবে তিনি ভারতমাতার প্রেমে আকুল হলেন, স্বামী বিবেকানন্দের মানসকন্যার স্বীকৃতি পেলেন, হয়ে উঠলেন ভগিনী নিবেদিতা তার সংক্ষিপ্ত অথচ তথ্যবহুল বিবরণ রয়েছে এই গ্রন্থে। স্বামী তেজসানন্দকে এই বই লিখতে অসংখ্য বইয়ের সহায়তা নিতে হয়েছিল। গ্রন্থকারের নিবেদন অংশে রয়েছে-
গত ১৯৫৬ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ গ্রন্থকারকে সর্বপ্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের 'নিবেদিতা-লেক্চারার' রূপে মনোনীত করিয়া ভগিনী নিবেদিতার জীবন ও অবদান-সম্বন্ধে আলোচনা করিবার আমন্ত্রণ জানান। তদুপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিবেদিতা-সম্বন্ধে সুধীসমাজে দিবসত্রয় যাহা পরিবেশিত হইয়াছিল তাহাই এক্ষণে পুস্তকাকারে মুদ্রিত হইল। ইহাতে একদিকে যেমন তাঁহার জীবনের মুখ্য ঘটনাবলী ধারাবাহিকভাবে সন্নিবেশিত হইয়াছে, অপরদিকে তেমনই বিভিন্ন ক্ষেত্রে-- বিশেষতঃ ভারতীয় শিক্ষা, শিল্প, সংস্কৃতি, জাতীয়তা ও জাতির মুক্তিসংগ্রামে তাঁহার কি অমূল্য অবদান তাহার সম্যক পরিচয় দিবারও চেষ্টা করা হইয়াছে।
ভগিনী নিবেদিতা বইটি পাঠ করতে গিয়ে লেখক স্বামী তেজসানন্দের সৌজন্যে ভগিনী নিবেদিতা বিরচিত বেশ কয়েকটি বইয়ের নাম জানা হয়ে গেল। যেমন:
- The Master as I saw Him
- The Web of Indian Life
- Footfalls of Indian History
- Studies from an Eastern Home
- Notes of Some Wanderings with the Swami Vivekananda
- Hints on National Education in India
- Aggressive Hinduism
- Cradle Tales of Hinduism
- Civic and National Ideals
- Religion and Dharma
- Kali the Mother
- Myths of the Hindus and the Buddhists
- Kedarnath and Badrinath
- Death
- The Beloved
ভগিনী নিবেদিতা ভাল শিক্ষক ছিলেন। তিনি ফ্রোয়েবেল এবং পেস্তালৎসি'র বিভিন্ন প্রগতিমূলক শিশুমনোবিদ্যার গবেষণা সম্পর্কে সম্যক অবহিত ছিলেন। আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতা আন্দোলনের তিনি সমর্থক ছিলেন; রাশিয়ার বিপ্লবকাহিনী তাকে নিজদেশের স্বাধীনতার চেতনায় উদ্দীপ্ত করেছিল।
স্বীয় বিপ্লবী মনোভাব বালক-বালিকা-গণেরও অন্তরে ঢালিয়া দিবার উদ্দেশ্যে স্বাধীনভাবে উইম্বলডনের অন্য অঞ্চলে 'রাস্কিন-স্কুল' নামে একটি শিক্ষায়তন স্থাপন করিয়া স্বয়ং উহার অধ্যক্ষা হইলেন। সুইজারল্যান্ডের পেস্তালৎসি ও জার্মানীর ফ্রোবেল প্রবর্তিত আধুনিক শিক্ষা পদ্ধতিতে যাঁহারা শ্রদ্ধাশীল, কেবল সেই সকল সুধীবৃন্দেরই সেখানে কর্মী হিসাবে প্রবেশাধিকার রহিল।
১৮৯৫ সালের অক্টোবর মাসের স্বামী বিবেকানন্দ ইংল্যান্ডে যান। যান্ত্রিক সভ্যতার অসারতা এবং ভারতীয় দর্শনের উপযোগীতা বিষয়ে তিনি সেখানে একাধিক বক্তৃতা প্রদান করেন। এই সময়ে নিবেদিতা (মার্গারেট) স্বামীজীর চেতনা দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত হন। ২২ অক্টোবর তারিখে তিনি স্বামীজীকে প্রথম দেখেন। প্রথম দর্শনে স্বামীজীকে কেমন দেখেছিলেন তাঁর বর্ণনা নিজে লিখে গেছেন।
...তাঁহার মুখমণ্ডল, লোকে খুব ধ্যানপরায়ণ ব্যক্তিগণের বদনে যে মিশ্রিত কোমলতা ও মহত্ত্বের ভাব দেখিতে পায় তাহাই লক্ষিত হইতেছিল; হয়তো উহা সেই ভাব, যাহা রাফেল আমাদিগকে তাঁহার Sistine Child-এর ললাটফলকে আঁকিয়া দেখাইয়া গিয়াছেন।
১৮৯৮ সালের ২৮ জানুয়ারি তারিখে নিবেদিতা ভারতে আসেন। ১১ মার্চ তারিখে স্টার রঙ্গমঞ্চে বলেন-
দীর্ঘ ছয় হাজার বৎসর ধরে রক্ষণশীল হয়ে থাকবার আশ্চর্য নৈপুণ্য আপনাদের আছে। কিন্তু এই রক্ষণশীলতা দ্বারা আপনাদের জাতি বিশ্বের সর্বোত্তম অধ্যাত্ম সম্পদগুলিকে এতকাল ধরে অবিকৃতভাবে রক্ষা করতে পেরেছে। এই জন্যেই আমি ভারতবর্ষে এসেছি- জ্বলন্ত আগ্রহে তাঁর সেবা করব বলে।
স্বামী বিবেকানন্দের শিক্ষায় নিবেদিতা ভারতীয় দর্শনকে ভালভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। কালীমাতার পূজার প্রয়োজনীয়তা তিনি চেতনায় যা বুঝেছেন তা নিম্নরূপ-
বিশ্ববুকে প্রতিনিয়ত যে মহাশক্তির খেলা চলিতেছে, যে দ্বন্দ্ব ও বৈচিত্র্য নিত্য নানা নামরূপে ফুটিয়া উঠিতেছে, তাহা সর্বদ্বন্দ্বের সমন্বয়ভূমি এক অদ্বয় চৈতন্যসত্তারই অভিব্যক্তিমাত্র। এই বৈচিত্র্যই সৃষ্টির প্রাণ। সৃষ্টি ও ধ্বংস, জন্ম ও মৃত্যু এক অচিন্ত্য মহাশক্তিরই অফুরন্ত লীলা। এই মহাশক্তিই কখনও সুন্দর হইতে সুন্দরতর, আবার কখনও ভীষণ হইতে ভীষণতর। পদতলে নির্বিকার নির্গুণ চৈতন্যঘন পরম শিব নির্বিকল্প-সমাধিকল্পে শবরূপে শায়িত। তাঁহারই বিশালবক্ষে সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়রূপিনী আদ্যাশক্তি ভীষণমধুর মূর্তিতে নিত্য বিরাজিতা।
শিক্ষা সম্পর্কে ভগিনী নিবেদিতার কিছু নিজস্ব মত ছিল। ইউরোপের প্রখ্যাত শিশু মনোবিজ্ঞানীদের গবেষণা দ্বারা তার মানসজগত প্রভাবিত ছিল। তাই তিনি শিক্ষাদর্শ সম্পর্কে বিখ্যাত বই Hints on National Education in India তে বলেছেন-
কেবল শুষ্ক পুঁথিগত বিদ্যা ও ঘটনাপুঞ্জ দ্বারা বুদ্ধিকে ভারাক্রান্ত করাকেই শিক্ষা নামে অভিহিত করা চলে না। শিক্ষা বলিতে প্রাণদ তথা জীবন্ত ভাবরাশিকেই বুঝায় যাহা বালক বালিকার মন বুদ্ধি, হৃদয় ও ইচ্ছাশক্তিকে বিকশিত ও পরিমার্জিত করে। শুধু বুদ্ধির উৎকর্ষ দ্বারা যে শিক্ষা মানুষকে কেবল ধূর্ত বা চতুর করিয়া তোলে, যাহা কেবল জীবন-নির্বাহের পাথেয় সংগ্রহের উপায়মাত্র হইয়া দাঁড়ায়, তাহা দ্বারা অনুকরণপ্রিয় মর্কটসদৃশ একটি জীব গড়িয়া উঠিতে পারে বটে, কিন্তু উহা মানুষকে যথার্থ মানুষ করে না- তাহার অন্তর্নিহিত শৌর্যবীর্য, মনুষ্যত্বকে উদ্বুদ্ধ করে না।
এই বইয়ে তিনি আরও বলেছেন-
The will of the hero is ever an impulse to self-sacrifice. It is for the good of the people, not for my own good that I should strive to become one with the highest, the noblest and the most truth-loving that I can conceive
ভগিনী নিবেদিতা তাঁর The Web of Indian Life গ্রন্থে বলেছেন-
সমগ্র এশিয়াখণ্ডে অতি প্রাচীনকাল হইতে আজ পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে এক অখণ্ড সভ্যতা বিরাজমান। এশিয়ার এই সভ্যতা প্রাচ্য ভূখণ্ডের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন কালে বিভিন্ন মূর্তি গ্রহণ করিলেও তাহার মজ্জাগত ঐক্য কখনও হারায় নাই। এশিয়াখণ্ডের এই বিশেষ সভ্যতার উদ্ভব-কেন্দ্র হইতেছে ভারতবর্ষ। ভারতবর্ষ হইতেই প্রাচীন এশিয়ার সব দেশে ধর্ম, সভ্যতা ও দার্শনিক চিন্তাধারা মরু, গিরি, কান্তার, সমুদ্র অতিক্রম করিয়া প্রবাহিত হইয়াছে।
ভারতের প্রতি তাঁর ভালবাসায় যেমন ছিল নিখাঁদ তেমনি তার কর্মপ্রচেষ্টাতেও কোন সীমা ছিল না। দেশের উন্নয়নকল্পে রামকৃষ্ণ মিশনের সাথে থেকে তিনি শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্ম সামাজিক জীবন সবক্ষেত্রে সংস্কারের চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। দেশের দশের উন্নয়নভাবনাকে করে নিয়েছেন নিত্যসঙ্গী। এক পর্যায়ে তিনি রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন। এমনকি এক পর্যায়ে দেশমাতার সম্ভ্রম রক্ষার প্রয়োজনে তিনি বিপ্লবাত্মক রাজনীতিকেও সমর্থন করেছিলেন। তাঁর বাড়িতে শুধু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নয়, ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র দত্ত, শ্রীযদুনাথ সরকার, বৈজ্ঞানিক জগদীশচন্দ্র, ও প্রফুল্লচন্দ্র, শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ, শ্রীনন্দলাল বসু, অসিত হালদার, সাংবাদিক শিশিরকুমার ঘোষ, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়, শ্রী হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ, ডন সোসাইটির সম্পাদক সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, সাহিত্যিক দীনেশচন্দ্র সেন নিয়মিত ভ্রমণ করতেন। ১৩ অক্টোবর ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে এই কর্মযোগী নারীর মহাপ্রয়াণ ঘটে।
স্বামী তেজসানন্দ রচিত ভগিনী নিবেদিতা বইটি মাত্র ১১১ পৃষ্ঠার। কিন্তু তথ্যের প্রাচুর্যে এবং বর্ণনার সরলতায় বইটি তার ক্ষুদ্রায়তনকে অতিক্রম করতে পেরেছে।
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম