সভ্যতার মর্মপীড়া- সিগমান্ড ফ্রয়েড


সভ্যতার মর্মপীড়া- সিগমান্ড ফ্রয়েড

আমি কতোটুকু বুঝেছি
শুভ্র সরখেল

উৎসর্গ: সিগমান্ড ফ্রয়েড

পৃথিবীর ইতিহাস শুধুমাত্র ‘সভ্যতা’ শব্দের মধ্যে সবটুকু গোপনীয়তা লুকিয়ে রেখেছে। সভ্যতা হলো পৃথিবীর সবচেয়ে বিষ্ময়ের জায়গা। যেখানে অনেক বিতর্ক অপেক্ষা করছে। আমি সামান্য সাহসের মধ্য দিয়ে সিগমান্ড ফ্রয়েডের “সভ্যতার মর্মপীড়া’ প্রসঙ্গে দুই একটা কথা বলব।

১. আদিম হতে আদিমে ফিরে আসা

মূলত সভ্যতার শুরু হয় আদিম থেকে। যা বর্তমানে ‘অসভ্য’ বা প্রচীন। সিগমান্ড ফ্রয়েড একটা কথা স্পষ্ট বুঝিয়েছেন যে, সভ্যতা বলতে আসলে কোন নির্দিষ্টতা নেই। কারণ সভ্যতার মূল ধর্ম হলো ঘুরপাক খেয়ে পূর্বের অবস্থানে ফিরে আসা। সকল দুঃখ-কষ্টের কারণ এই সভ্যতা। সভ্যতা হতে পরিত্রাণের জন্য ফ্রয়েডের বয়ান হলো ‘এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ ঘটতে পারে অসভ্য বা আদিম অবস্থানে ফিরে গেলে। আমরা যা দিয়ে আমাদের দুঃখ-কষ্ট থেকে জন্ম নেয়া ভয় থেকে পরিত্রাণ পেতে চাই সে সবই সভ্যতার অংশ।’ ফ্রয়েড সভ্যতার সাথে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দের সামঞ্জস্য দেখিয়েছেন। তা হলো ধর্ম, ভয়, বিজ্ঞান, সাহিত্য। সুতরাং এই চারটি শব্দকে আমরা বলতে পারি সভ্যতার মূল দর্শন (Root Philosophy)। আবার এই চারটি শব্দ পরবর্তীতে আরো কয়েকটি শব্দকে ক্রমানুসারে জন্ম দেয়।

যেমন    
    ধর্ম → কল্পনা → সাহিত্য
    ভয় → ধর্ম → ব্যবসা
    ধর্ম → বিশ্বাস → ভয়
    ভয় → সাহস → বিজ্ঞান
    বিজ্ঞান → প্রযুক্তি → ব্যবসা
    ব্যবসা → প্রযুক্তি → ব্যবসা
    ব্যবসা → স্বার্থ → রাজত্ব
    স্বার্থ → জমি → কৃষি
    কৃষি → ব্যবসা → রাজত্ব
    রাজত্ব → যুদ্ধ → আইন
    আইন → রাজত্ব → রাজা
    রাজত্ব → বিদ্রোহ → রাষ্ট্র

সুতরাং সবকিছু ঘুরে ফিরে একই অবস্থানে আসছে।

২. সভ্যতা এবং বিজ্ঞান

এখন সভ্যতার আকৃতি পরিবর্তন এবং প্রয়োজন নিয়ে দুটো বয়ান দরকার। পরিবর্তন এবং প্রয়োজন এই শব্দ দুটিকে আমরা বলতে পারি সভ্যতার উপস্থাপক শব্দ। কারণ আদিম বা অসভ্য ঠিক তখনই সভ্য হবার চেষ্টা করে যখন তাদের প্রয়োজন হয়। আর তখনই পরিবর্তনের সময়, অর্থাৎ সভ্যতা এবং বিজ্ঞানের আলোচনা। এর কিছু উপাদান হতে পারে বস্ত্র, হাতিয়ার, কৃষি ইত্যাদি। আগুন এবং হাতিয়ার আসার সময় মানুষের খাদ্য গ্রহণের নিয়ম পরিবর্তন হয় নাই। কিন্তু বিজ্ঞান আসার পর মানুষের রুচির পরিবর্তন হয়, আর  তখনই কৃষি এবং কৃষিজাত পণ্যের কদর হয়। সুতরাং সভ্যতা এবং বিজ্ঞান একে অপরের ভুলগুলো লিপিবদ্ধ করতে শুরু করে। ফ্রয়েড বলেন, মানুষ পৃথিবীতে এক সময় অত্যন্ত দুর্বল প্রজাতি হিসাবে এসেছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দিয়ে পৃথিবীতে নিজেকে যে অবস্থানে নিয়ে এসেছে সেটা একটা রূপকথায় সকল ইচ্ছা পূরণের মতো। এগুলো সবই মানব সংস্কৃতির অর্জন বলে দাবি করা যায়।
বিজ্ঞান মানব জীবনের সস্তা চালচিত্রের সাথে কিছুটা দুর্ভোগ সৃষ্টি করে চলেছে। তাই ফ্রয়েড সাবলীল ভাষায় বলেছেন, ‘যদি রেলওয়ে তৈরি না হতো তাহলে আমার সন্তান বাড়ি ছেড়ে অতদূরে যেত না এবং আমারও টেলিফোন করার প্রয়োজন হতো না।’ অর্থাৎ বিজ্ঞান আমাদের সাশ্রয়ী করে না বরংচ ব্যায়ের বিনিময়ে পূর্বের আবস্থানের চেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে রূপান্তর করে। আর এই ব্যায় পূর্বের আয়ের তুলনায় বেশি।

৩. আইনের জটিলতায় সভ্যতার বেড়ে ওঠা

মানব সভ্যতার সবচেয়ে বড় কালো অধ্যায় হলো আইন। আইন শব্দটি আসে বিশৃঙ্খল শব্দের জন্য। অর্থাৎ সভ্যতার শৃঙ্খলা স্থির করার জন্য আইন প্রবর্তিত হয়। কিন্তু এই আইন কোন দেবতা বা ঈশ্বর প্রবর্তন করেন নাই। তাহলে কে করেছে? তার আগে ফ্রয়েডের একটা কথা বলা যায় ‘মানবজাতির সকল কর্মকাণ্ডের পেছনে দুটি ধারা রয়েছে, প্রয়োজন পূরণ ও আনন্দ প্রাপ্তি সম্মিলিতভাবে বহমান।’ এখন প্রথমে প্রয়োজন পূরণের কথা ধরা যাক। মানুষ তার প্রয়োজন বা চাহিদা পূরণের জন্য কিছু প্রক্রিয়াধীন হয়ে চলে। যখন একাধিক উন্নত প্রক্রিয়া আবি®কৃত হয় তখন উন্নত প্রক্রিয়ার উপর কিছু বিশেষ শ্রেণির মানুষের অধিকার এসে যায়। এবং এই অধিকার পরবর্তীতে স্থায়ীকরণ করার জন্য ওই বিশেষ শ্রেণির মানুষের তৈরি কিছু নিয়ম ‘আইনে’ পরিবর্তিত হয়। মূলত আইন হলো ক্ষমতায় থাকা মানুষের সুবিধাভোগের একটা চোরাই রাস্তা এবং নামেমাত্র শৃঙ্খলা বজায় রাখার মানুষ দেখানো ঢং। আমাদের প্রচলিত আইন ব্যবস্থা এই সূত্রের প্রসব করা কলঙ্ক মাত্র। সুতরাং আইন তখনই প্রবর্তিত হয় যখন মানুষের চাহিদার আকৃতি পরিবর্তন হয় এবং কিছু মানুষ শুধুমাত্র নিজের চাহিদাগুলো পূরণের জন্য অন্যের চাহিদা পূরণে বাধা দেয়ার চেষ্টা করে। তবে এ কথা সত্যিই বলা যায় যে, আইন পরবর্তীতে সমাজ গঠনের বাইরেও ধর্ম তত্তে আমূল প্রভাব ফেলে জাতিভেদ, কুসংস্কার এবং সাহিত্যের সৃষ্টি করেছে।

৪. যৌন সম্পকে সভ্যতার অগ্রগতি

ফ্রয়েড বলেন, ‘সভ্যতা প্রক্রিয়া যৌন ভালবাসার কাজে নিয়েজিত।’ এখানে মজার বেশ কিছু তথ্য দেয়া আছে। অর্থাৎ কোন সভ্যতার প্রসার হয় বংশ বিস্তার তথা গোত্র সমূহের জনশক্তির উপর। যৌন সম্পর্ক দ্বারা প্রথমতো এই কাজগুলো করানো হয়। যৌন সম্পর্ক প্রথমতো মানুষ একান্ত কামবাসনা হয়ে করে নি। আর যদি তাই করতো তাহলে একাধিক পুরুষ একটি নারী বা একাধিক নারী একটি পুরুষের সাথে অপরিকল্পিতভাবে যৌন সম্পর্ক বজায় রাখতো না। মূলত আদিম সভ্যতায় জমি বণ্টন থেকে যখন স্বার্থের বিষয়টা স্পষ্ট হয় ঠিক তখনই একাধিক গোষ্ঠি বা গোত্রের উদ্ভাবন হয়। প্রতিটি গোত্রের জনশক্তি বৃদ্ধির জন্য যৌন সম্পর্কটা হয়ে দাঁড়ায় সভ্যতার অগ্রগতির মূল সূত্র। সুতরাং অদিম সভ্যতায় যৌন সম্পর্কটা দুইভাবে কাজ করতো। প্রথমটা হলো কোন গোষ্ঠির বা গোত্রের বংশ বৃদ্ধি আবার দ্বিতীয়টা হলো একাধিক কোন গোত্রের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জন্য। অর্থাৎ যৌন সম্পর্ককে অনুষ্ঠানিক রূপ তখনই দেয়া হয় যখন পরস্পর কোন গোষ্ঠি বা গোত্রের মধ্যে পারস্পরিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের দরকার পড়ে। সুতরাং এই থেকে যে, যৌন সম্পর্ক শুধুমাত্র মানুষের কাম বাসনা হতে আসেনি। একটি সুস্থ সমাজ গঠনেও এটি একটি বড় প্রক্রিয়া হতে পারে। ফ্রয়েড বলেন, ‘মানুষের দুটি ইচ্ছা- ব্যাক্তিগত সুখের আকাঙ্ক্ষা এবং দ্বিতীয়টি অন্যান্য ব্যাক্তি সঙ্গে মিলনের বাসনা প্রতিটি মানুষের মধ্যে যুঝমান।’

অবশেষে বোঝা গেলো মানুষ তাদের স্বার্থেই যৌন সম্পর্কের বিভিন্ন শ্রেণি বিভাগ করে। তাই বলা যায় বর্তমানে যৌন সম্পর্কের এই রকম অবস্থার শুরু মূলত শুরুর দিক হতেই শুরু হয়েছে।


অনুবাদ: বাঙ্ময় অনুবাদ পর্ষদ। প্রকাশক: বাঙ্ময়, কুড়িগ্রাম। প্রচ্ছদ: সাম্য রাইয়ান।
প্রকাশ: জানুয়ারি ২০১২; বিনিময়: ২০ টাকা

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ