বই পড়া ভারী মজা
-শামসুল হক
প্রকাশক: চিত্তরঞ্জন সাহাপ্রকাশনী: মুক্তধারা
প্রথম প্রকাশ: ১৯৬৫, পঞ্চম সংস্করণ: ১৯৮৮
মূল্য: সাদা কাগজ: ৩২.০০ টাকা, লেখক কাগজ: ২৪.০০ টাকা
পৃষ্ঠা সংখ্যা: নির্ঘন্টসহ ১০২+২= ১০৪
শিশু কিশোরদের লক্ষ্য করে তাদের উপযোগী সহজ সরল আবেগ মেশানো ভাষায় লেখা এই বইটি বেশ তথ্যবহুল। পড়তে গিয়ে কোনরকম হোঁচট খেতে হয়না। লেখক শামসুল হক সাবলীল ভঙ্গিতে বই পড়ার উপকারের কথা বলতে বলতে অনেক কথা বলে ফেলেছেন। বই এবং এই সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে একের পর এক গল্প বলে গেছেন। লেখক আন্তরিকভাবে 'তুমি' 'তোমরা' সর্বনাম ব্যবহার করে তার পাঠককে আপন করে নিয়েছেন।
মোট পনেরোটি বই সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে গল্পের ভঙ্গিতে তথ্যবহুল রচনা রয়েছে 'বই পড়া ভারী মজা' বইটিতে। প্রথম রচনার নামেই বইয়ের নামকরণ করা হয়েছে। কেন বই পড়া উচিত, বই পড়লে কি পাওয়া যায় ইত্যাদি নানারকম প্রশ্নের উত্তর রয়েছে এই রচনাগুলোতে।
লেখক বলেন,
আমরা সবাই বই পড়তে ভালবাসি। যুগে যুগে জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিরা যে-সব মূল্যবান কথা আমাদের জন্য রেখে যান, যে-সব গল্প কাহিনী আমাদের মনকে দোলা দিয়ে যায়, সে-সব জানার জন্য মন আমাদের কত আকুলি-বিকুলি করে। মহাপুরুষেরা তাদের রচনায় রেখে যান অমর প্রতিভার স্বাক্ষর। তাঁরা যুগে যুগে আমাদের চিন্তাজগতে আলোড়ন তোলেন--- বদলে দেন আমাদের জীবনের গতিপথ। আমরা অনুপ্রেরণা পাই নতুন পথে চলবার। কোরান, বেদ, বাইবেল যেমন জন্ম দিয়েছে নতুন নতুন জাতির, ভলতেয়ার, রুশো, গোর্কি তেমনি দিয়ে গেছেন সমাজ গঠনের নতুন নতুন ইঙ্গিত। বইয়ের মধ্যে বন্দী হয়ে আছে মানুষের যুগ যুগ সঞ্চিত অভিজ্ঞতার মণি-মাণিক্য।
বইয়ের অন্যতম উপাদান ছবি। ভাষাবিকাশের বিভিন্ন স্তরে মানুষ ছবি ব্যবহার করা শুরু করে ভাবনা প্রকাশে, বিনোদনের আবেগে মানুষ ছবি আঁকতো। লেখক শামসুল হক তাঁর 'বই পড়া ভারী মজা' বইতে আদিম মানুষের আঁকা বিভিন্ন ছবি বিশ্লেষণ করে তার ব্যবহার রীতি, বক্তব্য বুঝিয়ে দিয়েছেন। মানুষ প্রথমদিকে চিত্রলিপি দিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করতো। নিচের ছবিটি দেখা যাক-
এরকম আরো বেশ কয়েকটি আদিম মানুষের গুহার দেয়ালে আঁকা চিত্রলিপি ও তার ব্যাখ্যা গল্পটিতে আছে। গুহিচিত্রগুলো আবিষ্কারের কাহিনী আরো মজার। শিশু-কিশোররাও যে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণায় অবদান রাখতে পারে তা অন্তত দুইটি কাহিনী পড়লে বোঝা যায়।
১৮৭৯ সালে স্পেনের 'আলতামিরা' গুহা আবিষ্কার করেছে পাঁচ বৎসর বয়ের ছোট্ট মেয়ে 'মারিয়া'। বাবার হাত ধরে গুহা ভ্রমণ করতে গিয়েছিল সেদিন। গুহার ছাদ নিচু হওয়ায় পিতা 'সাউটুওলা' মাথা নিচু করে হাঁটছিলেন, আর মেয়ে মারিয়া ছিল তার পাশেই। গুহার ছাদ ভর্তি করে প্রাচীন কালের মানুষেরা বিভিন্ন জীবজন্তুর ছবি এঁকেছিল। একটা 'ষাড়' দেখতে পেয়ে ছোট্ট মারিয়া চীৎকার করে উঠেছিল। পিতা মাথা উঁচু করে ছাদের দিকে তাকাতেই আবিষ্কৃত হয়ে গেল আদিম মানুষদের আঁকা সবচেয়ে বড় ছবির সংগ্রহশালা।
১৯৪০ সালে ফ্রান্সের লাসকো (Lascaux) গুহা আবিষ্কার হয়। এর দেয়াল ও ভেতরের সুরঙ্গের দেয়ালে অনেক ছবি অংকিত ছিল। আবিষ্কার করেছিল চার স্কুল ছাত্র কিশোর। উদ্দেশ্যহীনভাবে এদিক সেদিক ঘুরতে বেড়িয়ে তারা গুহাটি আবিষ্কার করে ফেলে। স্কুলের একজন শিক্ষক ক্লাশে প্রাগৈতিহাসিককালের বিভিন্ন কাহিনী বলতেন। অনেক রকমের ছবি আঁকা গুহাটি দেখে শিক্ষকের কথা মনে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে সাড়া পড়ে গেল চারদিকে। কিশোর চার বন্ধু বিশ্বের সমস্ত ইতিহাস সন্ধানী মানুষের চোখে সম্মানিত হয়ে গেল।
বই লিখতে হয় ভাষা দিয়ে। পৃথিবীতে এখন প্রায় সাত হাজারটি ভাষা আছে। কোন ভাষাই হঠাৎ করে সৃষ্টি হয়নি। প্রতিটি ভাষা সময়-কালের প্রভাবে ধীরে ধীরে বিবর্তিত হয়েছে, সংস্কৃত হয়েছে। ভাষা কেউ আবিষ্কার করেনি। বিভিন্ন কাজ আরো সহজ ও দ্রততম সময়ে করবার তাগিদে মানুষকে ভাষার উদ্ভাবন করতে হয়েছে। অঙ্গভঙ্গি দিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করা হল মানুষের প্রাণিগত প্রবণতা। পৃথিবীর সব প্রাণীই তাদের অঙ্গভঙ্গি দিয়ে অন্যদের সামনে নিজের বক্তব্য, মনোভঙ্গি প্রকাশ করে। ভাষাহীন সময়ে মানুষ এর ব্যতিক্রম ছিল না। শিকার করা, অন্যকে নিয়ন্ত্রণ করা, নিজের নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয়ে মানুষ একটা দুইটা করে শব্দ ব্যবহার করা শুরু করে। এরপর কীভাবে মগজ বিবর্তনের সাথে সাথে ভাষারও বিকাশ হয় তার মনোজ্ঞ বর্ণনা রয়েছে "বইয়ের প্রাণ ভাষা" নামক তৃতীয় রচনাটিতে।
আমরা সূচীপত্রটি যদি দেখে নিই তাহলে "বই পড়া ভারী মজা" বইয়ের সম্পূর্ণ চিত্রটি এক নিমেষে বুঝে নিতে পারি।
- বই পড়া ভারী মজা
- ছবিও কথা বলে
- বইয়ের প্রাণ ভাষা
- ছবি থেকে অক্ষর
- পাথরের বই
- গাছের নাম প্যাপিরাস
- পাতায়ও লেখা যায়
- চামড়ার ওপর লেখা
- কারগৎ
- জার্মানীর সেই বিখ্যাত শিল্পীটি
- বিলিতি কাগজ বিলিতি ছাপা
- কালি তৈরির ইতিহাস
- বাংলাদেশে ছাপাখানা
- কলম দিয়ে লিখি
- পড়লেই জানতে পারবে
‘পাথরের বই' গল্পের ঢঙে বলা হয়েছে। শিউলি ও শিমুল নামক দুই বোনের বিতর্ক শেষ হয় মায়ের কাছে বই লেখার প্রাচীন উপাদান পাথরের ব্যবহারের গল্প শুনে। মা তাদেরকে যীশুখ্রিস্টের জন্মেরও দশ হাজার বছর আগে মানুষ কীভাবে লিখত তার গল্প বলেন। একে একে আসিরিয়া, ব্যবিলনে ব্যবহৃত লেখার মাধ্যম পোড়া মাটির ইটের কথা বলেন। মায়ের ভাষ্যে আমরা জানতে পারি, অশোকের জন্মের চার হাজার বছর আগে আসিরিয়া নামে দেশ ছিল। সেখানকার রাজা আসুরবানিপাল রাজধানী নিনেভে বিশাল লাইব্রেরি তৈরি করেছিলেন। নিনেভের এই পাঠাগারে বাইশ হাজারেরও বেশি পাথুরে বই ছিল।
ইতিহাসের প্রথম দিকে পাথরের উপর খোদাই করে বই লিখিত হত। এরপর মিশরে প্যাপিরাস নামক গাছ থেকে কাগজ তৈরি করা শুরু হল। প্যাপিরাস থেকে তৈরি করা কাগজ বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। ফিনিশীয়রাও প্যাপিরাসের ব্যবসা করতো। ভূমধ্যসাগরের আশেপাশে ইউরোপের দেশসমূহে প্যাপিরাসের রপ্তানী ব্যবসার বেশিরভাগ ছিল ফিনিশীয়দের হাতে।
প্যাপিরাস গাছ থেকে কীভাবে কাগজ তৈরি হত, প্যাপিরাস গাছ থেকে কাগজ ছাড়াও আর কী কী তৈরি হত লেখক "গাছের নাম প্যাপিরাস" রচনাটিতে তার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। এই রচনা শিক্ষক ও ছাত্রের মধ্যে কথোপকথনের ভঙ্গিতে লেখা। শিক্ষক ছাত্রদের প্রশ্ন করছেন, ছাত্ররা উত্তর দিতে না পারলে শিক্ষক নিজেই তার উত্তর দিচ্ছেন- এরকম ভঙ্গিতে লেখায় রচনাটি নতুন পাঠকদের কাছে সহজবোধ্য মনে হবে।
“পাতায়ও লেখা যায়" রচনাটিতে লেখক নিজেই যেন গল্পকথক হয়ে শিক্ষার্থীদের কৌতুহল মিটিয়েছেন। ভারত উপমহাদেশের দেশগুলোতে লেখার উপকরণ হিসেবে গাছের পাতা ব্যবহৃত হত। থাইল্যান্ড, শ্রীলংকায় লেখার কাজে ব্যবহৃত হত তালপাতা। এছাড়াও সাময়িকভাবে লেখার জন্য মানুষ কলাগাছের পাতা ব্যবহার করতো। এসব দেশে তালপাতা, বটপাতা, কলাপাতার পাশাপাশি ব্যবহার করতো ভূর্জপত্র।
“কায়গৎ" শব্দটি চৈনিক। আমরা যার উপর লিখি, সেই বস্তুটিকে কাগজ বলি, চীনারা সেই একই বস্তুকে বলে 'কায়গৎ'। প্রাচীন চীন থেকে পৃথিবী দুটো অতি প্রয়োজনীয় জিনিস পেয়েছে। চা ও কাগজ। চীনে খ্রিস্টপূর্ব ৭৩ থেকে ৪৯ সালের মাঝামাঝি সময়ের তিন টুকরো কাগজ খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। অতএব চীনারা যে যিশুখ্রিস্টের জন্মের আগেই কাগজ ব্যবহার করতো সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। চীনদেশের লিপিকাররা আগে বাঁশের ফলকের উপর লিখতো। পরে বাঁশের বদলে লেখার কাজে রেশী কাপড় ব্যবহার করা হত। কিন্তু সাই লুন (আনুমানিক একশত খ্রিস্টাব্দ) নামের একজন রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা নতুন উপাদান কাগজ তৈরির কাজে ব্যবহার করতে চাইলেন। তিনি কাপড়ের টুকরো, ফালতু শণ, গাছের ছাল, মাছ ধরার ছেঁড়া জাল, পুরনো কম্বল প্রভৃতি ফেলনা জিনিস দিয়ে কাগজ তৈরির পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। এই সব অপ্রচলিত উপাদান ভিজিয়ে নিয়ে পিষে থ্যাতলা করে চৌকোণা বাঁশের তৈরি পাতলা কাপড়ের উপর পাতলা করে বিছিয়ে কীভাবে কাপড় তৈরি হত তার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যাবে 'কায়গৎ' নামক রচনাটিতে। পাশাপাশি চীনারা কাগজ তৈরির পদ্ধতি কীভাবে বহুদিন পর্যন্ত আধুনিক পৃথিবীর কাছ থেকে গোপন রেখেছিল, কীভাবে কাঠের টুকরোর মধ্যে খোদাই করে ছাপার কাজ আরম্ভ করেছিল, তারও ইতিহাস লেখক ছোটদের উপযোগী করে লিখেছেন।
এখন আমরা যাকে ছাপাখানার জনক বলে জানি জার্মানীর সেই বিখ্যাত শিল্পী "জোহান গেনসফিশ গুটেনবার্গ" ও তার ছাপাখানা তৈরির কাহিনী রয়েছে "জার্মানীর সেই শিল্পীটি" নামক রচনায়। "বিলিতি কাগজ বিলিতি ছাপা" রচনাটিতে রয়েছে ইংল্যান্ডে কাগজের কারখানা স্থাপনের ঐতিহাসিক কাহিনী। ১৫৮৮ সালে ইংল্যান্ডের রাণী ছিলেন প্রথম এলিজাবেথ। তিনি প্রথম জন স্পিলম্যান নামক একজনকে কাগজের কারখানা স্থাপনের লাইসেন্স দিয়েছিলেন। পরে আরও অন্যান্যদের উদ্যোগে কাগজ শিল্প বৃটেনে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। "কালি তৈরির ইতিকথা" নামক রচনাটিতে রয়েছে কাগজে লেখার উপাদান কালির কথা। আগে মানুষ কয়লা, লালমাটি দিয়ে তাদের আঁকা ছবি রঙ করতো। কখনও কখনও তারা জীবজন্তুর রক্ত দিয়েও ছবি আঁকতো। পরে ল্যাম্পের কালি ও ঝুল দিয়ে রঙ তৈরি করা শুরু হয়। এই কালি প্রথম তৈরি হয়েছিল চীনে। যিশুখ্রিস্টের জন্মেরও আড়াই হাজার বছর আগে মিশরে কালির ব্যবহার ছিল বলে মনে করা হয়। আধুনিক যুগে কালি কীভাবে তৈরি হয়, ছাপার কালি, ছবি আঁকার কালি, অদৃশ্য কালি বিভিন্ন প্রকারের কালি তৈরির পদ্ধতি, নিয়মকানুন ও তাদের ইতিহাস সংক্ষেপে কিশোর পাঠকের উপযোগী করে বর্ণিত হয়েছে এই রচনায়। বাংলা ভাষায় প্রথম ছাপানো বই, প্রথম মুদ্রণ যন্ত্রের প্রবর্তন ইত্যাদি মনোজ্ঞ ভাষায় বর্ণনা করা হয়েছে "বাঙলাদেশে ছাপাখানা" নামক রচনাটিতে। ভারতবর্ষে প্রথম মুদ্রণ যন্ত্র নিয়ে আসে পর্তুগীজরা। ১৫৫৭ সালে তারা একটি বই ছাপে। পর্তুগীজ ভাষায় খ্রিস্টধর্ম বিষয়ে মুদ্রিত বইটিই ভারতবর্ষে যন্ত্রে ছাপানো প্রথম বই। ১৭৭৮ সালে ন্যাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড নামক একজন ইংরেজ 'এ গ্রামার অব বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ' নামক একটি বাংলা ব্যাকরণ ছাপেন। ইংরেজি ভাষায় লিখিত এই বইতে বাংলা ভাষার উদাহরণ বাংলা লিপিতে দেয়া হয়েছিল। বাংলা লিপি তৈরির কর্মযজ্ঞে হ্যালহেডের সহযোগী ছিলেন উইলকিনস ও পঞ্চানন কর্মকার। পরে ১৮০০ সালে শ্রীরামপুর ব্যাপটিস্ট মিশনে স্থাপিত ছাপাখানায় পঞ্চানন যোগদান করেন। তাঁরা কাঠের হরফের পরিবর্তে ধাতু দিয়ে তৈরি লিপি ব্যবহার করা শুরু করেন। উইলকিনস বাংলা বর্ণ তৈরি ও বাংলা বই ছাপাবার জন্য একাধিক ছাপাখানা তৈরিতে উৎসাহ ও সহযোগীতা করেছিলেন। তার নাম বাংলা মুদ্রণ শিল্পের ইতিহাসে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে।
“কলম দিয়ে লিখি" রচনাটিতে লেখালেখির অন্যতম উপাদান কলম সম্পর্কে নানারকম কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে। গ্রীক শব্দ 'কালামুস' থেকে আরবীয়রা কলম শব্দটি পেয়েছিল। সেখান থেকে শব্দটি এসে গেছে বাংলা ভাষায়। আগেকার দিনে মানুষ গুহার দেয়ালে ছবি আঁকার জন্য পাথর, চোখা হাড়, গাছের চিকন ডাল ইত্যাদি ব্যবহার করত। মেসোপটেমিয়ার মানুষরা হাতির দাঁত, লোহার টুকরো, কাঠের শলাকা দিয়ে কিউনিফর্ম লিপি লিখত। মিসরে গাছের ডাল চিবিয়ে ব্রাশের মত নরম করে লিখত। কায়রো এবং আলেকজান্দ্রিয়ায় এই ব্রাশের মত কলম তৈরি করা হত। চীনদেশের মানুষরা লেখার কাজে ব্যবহার করতো হাড়, বাঁশ, কাঠ, লিনেন, সিল্ক ইত্যাদি। গ্রিসে পূর্বে পাথর ও ব্রোঞ্জের ফলকের উপর খোদাই করে লেখা হত। পরে পার্চমেন্ট ব্যবহার শুরু হবার পর পালক ব্যবহার শুরু হল। প্রাচীন গ্রিস ও রোমের নবীন শিক্ষার্থীরা লিখত মোম মাখানো কাঠের স্লেটে, আর ব্যবহার করতো চোখা লোহার শলাকা দিয়ে। কালি ছাড়া অনায়াসে মোমের আস্তরণের উপর লোহার শলাকা দিয়ে লেখা যেত। এর নাম ছিল 'স্টাইলাস'। ভারতবর্ষে, কঞ্চি, খাগ, পালক দিয়ে লেখার প্রচলন ছিল। পালক দিয়ে লিখত উচ্চবিত্তরা। ১৮০৩ সালে ইস্পাত ব্যবহার করে কলমের নিব তৈরি শুরু হয়। ১৮৫০ সালে আবিষ্কৃত হয় ঝর্ণা কলম। লেখালেখির আরেকটি উপাদান 'পেনসিল'। ল্যাটিন শব্দ পেনিসিলাম থেকে এসেছে পেনসিল শব্দটি। ১৫৬৫ সালে সুইটজারল্যান্ডের জুরিখ শহরের অধিবাসী কনরড গ্রাফাইট ব্যবহার করে এই পেনসিল আবিষ্কার করেন। আধুনিক বল পয়েন্ট কলম আবিষ্কার হয় ১৯৪০ সালের দিকে।
“বই পড়া ভারী মজা” বইয়ের সবশেষে রয়েছে একটি নিটোল গল্প। প্যাঁকপ্যাঁক করা হাঁস একটি বই হাতে নিয়ে তা না পড়েই নিজেকে জ্ঞানী সবজান্তা ভাবতে শুরু করে। ফলে সে অহঙ্কারী হয়ে ওঠে। তারপর বই হাতে নিয়ে অহঙ্কারে বুক চিতিয়ে থাকা হাঁসের মুরগী, গরু, কুকুর, ঘোড়া প্রভৃতি জন্তুর সাথে নানারকম ঘটনা ঘটে। শেষে হাঁস বুঝতে পারে বই সাথে থাকলেই জ্ঞানী হওয়া যায় না। বই পড়তে হবে, বইয়ের পাতায় যা লেখা থাকে তা পড়তে হয় এবং বুঝে নিয়ে মনে রাখতে হয়। মজার এই হাস্যরসাত্মক গল্পটির নাম "পড়লেই জানতে পারবে"।
লেখক শামসুল হক তাঁর “বই পড়া ভারী মজা” বইটিতে বই সম্পর্কিত নানা বিষয় নিয়ে নানারকম ঘটনার অবতারণা করে আলোচনা করেছেন। শিশু-কিশোর তো বটেই অনুসন্ধানী পাঠকরাও এই বই পাঠে উপকৃত হবেন। মানুষের জীবনে বইয়ের ভূমিকা, মানুষের দ্বারা লিখন পদ্ধতি ও ভাষা আবিষ্কারের ইতিহাস, বই সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়, কাগজ, কালি, কলম, ছাপাখানা, লাইব্রেরি ইত্যাদি নিয়ে সহজ সরল ভাষায় লেখা বইটির বহুল পঠন প্রত্যাশা করি। বইটি এখন হয়তো বাজারে পাওয়া যায় না, কিন্তু এত প্রয়োজনীয় বইটির আর পুনর্মুদ্রণ হচ্ছে না, এটা ঠিক নয়। বইটি আবারো বাজারে সহজলভ্য হোক, নবীন পাঠকদের বইপাঠে উৎসাহ দানে ভূমিকা রাখুক, গড়ে উঠুক বইপ্রেমী প্রজন্ম এই প্রত্যাশা করি।
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম