ছোটদের সুভাষচন্দ্র-মিজানুর রহমান শেলী

ছোটদের সুভাষচন্দ্র-মিজানুর রহমান শেলী

ছোটদের সুভাষচন্দ্র-মিজানুর রহমান শেলী
প্রকাশক: সাহিত্যমালা, ঢাকা।

দ্বিতীয় প্রকাশ: ১৯৮৬, পৃ: ৭৮, মূল্য: ২১ টাকা

নেতাজী সুভাষচন্দ্রের জীবনের নানা বৈচিত্রময় ঘটনা ছোটদের সামনে তুলে ধরতেই বইটির অবতারনা। ইংরেজ শাসনে অতীষ্ট ভারত যাদের হাত ধরে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু তাদের মধ্যে অন্যতম। দেশ সেবার জন্য দেশের ডাক তিনি মর্মচেতনায় অনুভব করেছিলেন। তিনি কী আর স্থির থাকতে পারেন? পরাধীনতার জগদ্দল পাথর দেশের বুক থেকে সরাতে হবে এই দীক্ষায় তিনি কৈশোরেই উদ্বুদ্ধ হন। নেতাজী সুভাস বোসের জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ সময়কে সূত্র ধরে লেখক 'মীজানুর রহমান শেলী' শুরু করেছেন তাঁর 'ছোটদের সুভাষচন্দ্র' বইটি।

তখন তিনি বিলেত থেকে মাত্র ভারতে এসেছেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের দেশ স্বাধীন করার আহ্বান তাকে আকুল করেছে। তাই সরাসরি গিয়ে দেখা করলেন দেশবন্ধুর সঙ্গে। তাঁর কাছে মনের গভীরে থাকা দেশমাতৃকার সেবার করার সুপ্ত ইচ্ছার কথা প্রকাশ করলেন। দেশবন্ধু তার কথা শুনে তাকে দুহাতে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরেন। দেশ বন্ধু বললেন:

“স্বরাজ আমাদের চাই। কিন্তু মুষ্টিমেয় জন্য স্বরাজ চাই না। চাই অগণিত জনসাধারণের সুখ।… সাধারণের সুখ সমৃদ্ধি, সাধারণের অশিক্ষা ও কুশিক্ষা দূর করাই আমাদের স্বরাজের লক্ষ্য। স্বরাজ উদ্দেশ্য নয়, একটা উপায় মাত্র। মানুষের মুক্তিই আসল উদ্দেশ্য। জনশক্তির সংহত শক্তিই দিকে দিকে জাগিয়ে তোলার ব্রত নিতে হবে আজ।"

সুভাষচন্দ্রের জন্ম হয়েছে ১৮৯৭ সালের ২৩ জানুয়ারি। পিতার নাম রায় বাহাদুর জানকী নাথ বসু। পাঁচ বৎসর বয়সে ভর্তি হন "প্রোটেস্ট্যান্ট ইউরোপীয় স্কুলে"। ইংরেজ ও অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের শিশুদের শিক্ষার জন্য ব্যাপটিস্ট মিশন এই স্কুল পরিচালনা করে। খুব অল্প সংখ্যক ভারতীয় শিক্ষার্থীকে এই স্কুলে ভর্তি করা হয়। সাত বছর এই স্কুলে পড়াশোনার পর তিনি ভর্তি হন 'র্যাভেনস কলেজিয়েট বিদ্যালয়ে'। আগের প্রোটেস্ট্যান্ট ইউরোপীয় স্কুলে (P. E. School) বাংলা ও সংস্কৃত ভাষা পড়ানো হতো না। কিন্তু র্যাভেনস স্কুলে এই বিষয়দুটি অবশ্যপাঠ্য ছিল।

এখানেই সুভাষের জীবনে দেশপ্রেম ও রাজনীতি সচেতনতা প্রবল হয়ে ওঠে। পরাধীন দেশের অপমান দূর করতে তিনি সংকল্পবদ্ধ হন। সহপাঠী চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে সাথে নিয়ে তিনি দেশমুক্তির রাজনীতিতে উৎসাহী হয়ে ওঠেন। সুভাষচন্দ্র বসু দেশকে, দেশের সংস্কৃতি-প্রথাকে কীভাবে ভালোবাসতে হয় তা শিখেছেন স্বামী বিবেকানন্দের কাছে। দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করার আত্মপ্রত্যয় লাভ করেছেন শ্রী অরবিন্দু, ক্ষুদিরাম, কানাইলাল, সত্যেন বোস, প্রফুল্ল চাকী প্রমুখের কাছ থেকে। একসময়ে সহযোগী হিসেবে পান হেমন্ত কুমার ও দিলীপ কুমার রায়কে। তখন তারা স্কুলের ছাত্র, কিশোর বয়স। কিন্তু ওই বয়সেই তারা দেশের সেবায় জীবন উৎসর্গ করতে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ ছিল। পারিবারিক, সাংসারিক বন্ধন থেকে মুক্ত হবার জন্য প্রথমে তারা সন্ন্যাসী হতে চাইলেন। বন্ধুদের সাথে নিয়ে বেড়িয়ে পড়েন সন্ন্যাসী হতে। কিন্তু বিভিন্ন মন্দিরে সন্ন্যাসীদের মধ্যে প্রত্যাশিত মানবিক বোধের অভাব দেখে হতাশ হন তিনি। ফির আসেন বাড়িতে।

স্কুলে থাকতে তিনি ইংরেজদের ভারত বিদ্বেষ অনুভব করতে পেরেছিলেন। প্রেসিডেন্সি কলেজে এসে তার জ্বলন্ত রূপ দেখতে পেলেন। প্রতিবাদ করার উপায় থাকলে প্রতিবাদ করেন; আর উপায় না থাকলে উপায় বের করার চেষ্টা করেন। ছাত্রদের প্রতিবাদ বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেন। এরকম এক ঘটনায় জড়িত থাকার, নেতৃত্ব দেয়ার অপরাধে সুভাষের বিরুদ্ধে রাস্টিকেশনের অর্ডার হয়। ফলে আই এ পাশ করার পরেও তিনি কোন কলেজে ভর্তি হতে পারছিলেন না। পরে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তা (উপাচার্য) আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সাথে সরাসরি দেখা করেন। তিনি সুভাষের আবেদনে সাড়া দিয়ে রাষ্টিকেশনের আদেশ প্রত্যাহার করে নেন।

ইতিমধ্যে দুবছর পিছিয়ে পড়েছেন তিনি। তাই স্কটিশচার্চ কলেজে ভর্তি হবার পর তিনি মন দিয়ে পড়াশোনায় মগ্ন হলেন। সমসাময়িক সময়ে ইন্ডিয়া ডিফেন্স ফোর্সে ছাত্রবাহিনী গঠন করার জন্য সরকার উদ্যোগ নেয়। সুভাষচন্দ্র বসু অস্ত্রচালনা ও যুদ্ধবিদ্যার সাথে পরিচিত হবার জন্য সেই দলে যোগ দেন। সন্ন্যাসীর জীবন দর্শন সুভাষচন্দ্র মর্মে মর্মে অনুভব করেন।

“সন্ন্যাসী আর সৈনিককে তিনি একই সূত্রে বেধে দিতে চাইলেন। চাই সন্ন্যাসীর নির্বেদ, চাই সৈনিকের দুঃসাহস।"

প্রথম শ্রেনীতে বি.এ. পাশ করার পর পিতার ইচ্ছায় তিনি বিলেতে যান আই.সি.এস. পড়তে। আই.সি.এস. পরীক্ষায় চতুর্থ স্থান লাভ করেন তিনি। কিন্তু ইংরেজদের দাসত্ব করবেন না বলে তিনি চাকুরি থেকে পদত্যাগ করেন।

১৯২১ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের আহ্বানে বিলেতী বস্ত্রের বহ্ন্যুৎসবের মাধ্যে সুভাষচন্দ্রের স্বাধীনতা আন্দোলেনর কাজ সক্রিয়ভাবে শুরু হয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচীর মধ্যে দিয়ে সুভাষের জীবন এগিয়ে যেতে থাকে। ১৯২৩ সালের ভোটে জিতে স্বরাজ দল কলকাতা কর্পোরেশনের সবকটি কাউন্সিল পদ জিতে নেয়। মেয়র হলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, ডেপুটি মেয়র শহীদ সুরাবর্দি ও চীফ এক্সিকিউটিভ অফিসার হলেন সুভাষচন্দ্র।

১৯৩০ সালে সুভাষচন্দ্র কলকাতা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন। ব্রিটিশ সরকারের বিরাগভাজন হয়ে তিনি তখন জেলে বন্দী ছিলেন। লেখক মিজানুর রহমান শেলী তার "ছোটদের সুভাষচন্দ্র" বইতে এরপর তুলে ধরেছেন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলেনর নানা কাহিনী। সুভাষচন্দ্র কংগ্রেস দলের সভাপতি নির্বাচিত হন ১৯৩৮ সালে। মহাত্মা গান্ধীর বিরোধীতা ও কতিপয় রাজনীতিবিদদের ষড়যন্ত্রে তিনি পদত্যাগ করেন। তার আন্দোলনে ব্রিটিশ সরকার হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারন করতে বাধ্য হয়। কংগ্রসের নেতৃত্বের অসহযোগীতা তাকে আলাদা দল তৈরি করতে বাধ্য করে। ব্রিটিশদের চক্ষুশূল হওয়ার কারণে সুভাষকে গৃহবন্দী করা হয়। সুভাষ ব্রিটিশদের শ্যোন দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে আফগানিস্তান হয়ে ইউরোপে চলে আসেন। প্রথমে ইতালিতে থামেন। তারপর রাশিয়াতে সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা সারেন। শেষ চলে আসেন জার্মানী। সুভাষচন্দ্র জার্মানীতে 'আজাদ হিন্দ সংঘ' তৈরি করে প্রবাসীদের নিকট থেকে অভূতপূর্ব সাড়া পান। 'আজাদ হিন্দ বাহিনী'র তৈরি করা সৈন্যবাহিনীর কথা ঘোষণা করা হয় ১৯৪২ সালের ২৬ জানুয়ারি। উক্ত সভায় জার্মানীর তৎকালীন শাসক হিটলার ভাষণ দিয়েছিলেন। পরে সিঙ্গাপুরে গঠিত আজাদ হিন্দ ফৌজের অভিবাদন গ্রহণ করেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী তেবো।

এই বাহিনী নিয়ে তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনা করেন। বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে জাপানের আত্মসমর্পণের খবরে তিনি উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়েন। জাপানের কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করতে যাওয়ার পথে বিমান দুর্ঘটনায় মহান নেতা দেশপ্রেমিক সুভাষচন্দ্র বসুর মৃত্যু হয়।

নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর জীবনের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ঘটনাবলীর কিশোর উপযোগী সংক্ষিপ্ত বিবরণ বইটিতে সফলভাবেই বর্ণনা করা হয়েছে। লেখক সরল বাক্য, সহজ শব্দ ব্যবহার করে ইতিহাসের ধারাবাহিক বিবরণ দিয়ে গেছেন। পড়তে পড়তে কোথাও ছন্দপতনের ঘটনা ঘটেনি। অনুসন্ধিৎসু পাঠক বইয়ের পাতায় পাতায় সুভাষচন্দ্রের জীবনের দৃপ্ত, বুদ্ধিদীপ্ত, দেশপ্রেমের আলোকে উজ্জ্বল বিপ্লবী মানুষের চিত্র দেখতে পাবে। পাঠরত শিশু কিশোর সুভাষচন্দ্রের জীবনবোধের সাথে একাত্ম হয়ে যাবে। লেখক সফলভাবে অল্পবয়সী পাঠকের মনের অলিন্দে জেগে ওঠা উৎসাহ ও কৌতুলহল মেটাতে পেরেছেন। তাঁর লেখার ভঙ্গি, আকর্ষণীয় শব্দচয়নে দক্ষতা প্রশ্নাতীত। সুভাষচন্দ্র বসুর জীবন কাহিনীর পরম্পরা বর্ণনায় তিনি কৌশুলী ও নিষ্ঠাবান। বইটি পড়লেই বোঝা যায় লেখক নিজেও সুভাষচন্দ্রের বিপ্লবী দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্দীপ্ত।

ভারতবর্ষের রাজনৈতিক স্বাধীনতার অন্যতম ব্যক্তিত্ব সুভাষচন্দ্র বসুর জীবনী প্রকাশে প্রকাশকের আগ্রহে কমতি নেই; কিন্তু বইটি প্রকাশের সময় তাদের আরও যত্নবান হওয়া উচিত ছিল। বানান ভুল প্রচুর, ছাপার মান একেবারে নিম্নশ্রেণীর। লেখা অনেক জায়গাতেই অস্পষ্ট, শব্দের সঠিক পরিচয় নির্ণয় দুরূহ হয়ে পরে। তাছাড়াও প্রচ্ছদ ও গ্রন্থের অঙ্গসৌষ্ঠব ও সৌন্দর্যবৃদ্ধিতে আরও মনোযোগ দেয়া যেত বলে মনে করি। বইটিতে প্রচ্ছদশিল্পীর কোন নাম নেই, লেখক নিজেও কোন ভূমিকা লেখেননি। ফলে সন্দেহের একটি অবকাশ থেকেই যায় যে শুধু বাণিজ্যিক প্রয়োজনে ছাপানোর উদ্দেশ্যেই বইটি প্রকাশ করা হয়েছে না তো?

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ