তিব্বতে সওয়া বছর
রাহুল সাংকৃত্যায়ন
অনুবাদক: মলয় চট্টোপাধ্যায়
পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন বিরচিত 'দর্শন দিগদর্শন' বইটি পড়েননি এমন পাঠক খুঁজে পাওয়া ভার। তাঁর প্রজ্ঞা, চিন্তাশৈলী, পাঠাভ্যাস ও সক্রিয়তা আমাদের অন্তর্লোককে উন্মোচিত করে। মনে আঁধার, কালিমা দূর করতে সহায়তা করে। কোনো বই পাঠের ক্ষেত্রে সাধারণত দুটো দিক প্রধান বিচার্য বলে বিবেচিত হয়। বইয়ের লেখক ও বইয়ের বিষয়। পাঠ উপযোগীতা বিবেচনায় রাহুল সাংকৃত্যায়ন নামটিই যথেষ্ট। বোধকরি তাঁর রচিত বই সম্পর্কে অতিরিক্ত ব্যাখ্যা বাহুল্য মাত্র।
রাহুল সাংকৃত্যায়ন যখন শ্রীলঙ্কায় ছিলেন তখন জার্মানবাসী সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত রুডলফ অটো তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন -
আপনার রচনায় এ রকম আধুনিক বিশ্লেষণ পদ্ধতি কিভাবে এল?
উত্তরে রাহুল সাংকৃত্যায়ন বলেছিলেন-
দেখুন মাত্র কয়েকমাস ইংরেজি লেখাপড়া শেখার সুযোগ হয়েছিল, তাই আধুনিক পদ্ধতি বলে আপনি যা বোঝাতে চেয়েছেন তার উৎস কি তা বলতে পারব না।
- এখানেই তাঁর স্বকীয়তা, তাঁর চিন্তা ও রচনার মৌলিকতা।
রাহুল সাংকৃত্যায়ন শ্রীলঙ্কায় ছিলেন ১৯২৭-২৮ সালের দিকে। অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা দুটোই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। এর আগে ১৯২৬ সালে একবার তিনি লাদাখে কয়েকদিনের জন্য গিয়েছিলেন। শ্রীলংকায় থাকাকালীন তিনি দর্শনশাস্ত্রের বিভিন্ন প্রয়োজনীয় বইয়ের অভাব বোধ করছিলেন। তাঁর ভাষায়-
সিংহলে অধ্যয়নকালেই দেখেছিলাম যে ভারতের প্রাচীন দর্শন-শাস্ত্রসমূহ এবং বৌদ্ধযুগের বহুবিধ শাস্ত্রবিচার ইত্যাদি বিষয়ের বহু অজানা তথ্য একমাত্র তিব্বতে গেলেই পেতে পারি। অতএব সিংহলে পালি ভাষায় লিখিত বৌদ্ধ গ্রন্থাদির অধ্যয়ন সমাপ্ত করে তিব্বত যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম।
তিব্বতে যাওয়ার জন্য তিনি সোজা পথ ব্যবহার করেননি। সরকারি পাসপোর্ট-ভিসাতে ঝামেলা হবে এটা জেনেই তিনি অবৈধ ভাবে নেপালে ঢুকে সেখান থেকে তিব্বতে যাওয়ার মনস্থ করেন। শিবরাত্রীর সময়ে নেপালে প্রচুর তীর্থযাত্রীর আগমন ঘটে। সেই সময়ে তাদের সাথে মিশে নেপালে প্রবেশের পরিকল্পনা ছিল তার। বই ছিল তাঁর জীবনের অন্যতম অনুষঙ্গ। ভ্রমণকালীন সময়েও তিনি বইয়ের সঙ্গ ছাড়তেন না। সিংহল থেকে নেপালে আসার সময় তিনি সাথে করে যে পরিমাণ বই এনেছিলেন তার মোট ওজন ছিল ৫ মণ। শিবরাত্রীর অনুষ্ঠান হতে আরও কয়েকমাস বাকী আছে বলে তিনি এই ফাঁকে পশ্চিম ও উত্তর ভারতের প্রসিদ্ধ তীর্থস্থান যেমন ইলোরা, অজন্তা, কনৌজ কোশাম্বী, সারনাথ, নালন্দা, বৈশালী লুম্বিনী প্রভৃতি জায়গায় ভ্রমণ করেন। ইলোরার সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে তাঁর উপলব্ধি-
আসলে এগুলোকে গুহা না বলে পাহাড়ের গায়ে খোদাই করা প্রাসাদ বললেই যথোচিত বর্ণনা দেয়া হয়।
সুথর নামক আমেরিকার ওহিও ওয়েসলীন বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মতত্ত্ব বিভাগের প্রধানের সাথে তাঁর এখানে দেখা হয়। অজন্তা ভ্রমণকালীন সময়ে আলোচনা প্রসঙ্গে বলেন-
ধর্ম এবং জাতীয়তাবোধ এ দুটো সম্পূর্ণ পৃথক ব্যাপার। অনেক সময় একটার প্রভাব আর একটার ওপর হয়ত পড়ে এবং সেটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু যখন কোনো ধর্ম সুদূর অতীত থেকে চলে আসা জাতীয় চেতনাবোধ এবং বহমান সংস্কৃতিকে বিনষ্ট করে তার ধ্বংসস্তুপের ওপর নতুন কিছু স্থাপন করতে চায় তখনই দেখা দেয় সংঘর্ষ।
এপ্রসঙ্গে তিনি ভারতবর্ষে আগত বিভিন্ন বিদেশী ধর্ম ও সাম্রাজ্যবাদী সংস্কৃতির স্থানীয় ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রতি বিদ্বেষ, আক্রমণপ্রবণতা ও ধ্বংসাত্মক আচরণ প্রসঙ্গে বেশ কিছু সুচিন্তিত মন্তব্য করেন। তিনি স্বদেশী সংস্কৃতির মহত্ত্ব ও ঐশ্বর্য সম্পর্কে সচেতন; তাই বিদেশী সংস্কৃতির বিজ্ঞাপন ও আস্ফালন যে তাঁকে বিভ্রান্ত করতে সক্ষম নয়, সেকথাই তার চিন্তা ও সমাজ বিশ্লেষণের প্রধান বিষয়।
ধ্বংসাবশেষে পরিণত হওয়া নালন্দার সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর মনে হয়েছিল-
নালন্দা আমার স্বপ্ন, আমার প্রেরণা। এখানে কৃতবিদ্য মণীষী পণ্ডিতদের চরণস্পর্শে পবিত্র হয়েছিল যে পথ, আমাকেও সেই পথেই তিব্বত যাত্রা করতে হবে।
বিভিন্ন রাজনৈতিক কারণে নেপালবাসীরা ভারতীয়দেরকে সে সময় সন্দেহের চোখে দেখত। তাই নেপালে প্রবেশ করে তিব্বতী ভোটদের ভাষা তিনি শিখে নেন এবং তাদের মতো পোষাক পরা শুরু করেন। তিব্বতীদের মতো স্নান করাও ছেড়ে দিয়েছিলেন।
নেপালে লুকিয়ে থেকে বন্ধুর পাহাড়ী পথ অতিক্রম করে অনেক ক্লেশ স্বীকার করে তিনি তিব্বতে প্রবেশ করেন। তিব্বতের শিক্ষাব্যবস্থা, সমাজে নারীদের অবস্থান, ভিক্ষু জীবন, মঠের জীবন প্রণালী, আহার বিহার, বেশ-ভুষা প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে রাহুল সাংকৃত্যায়ন তাঁর 'তিব্বতে সওয়া বছর' বইয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। চীন, ভুটান, নেপাল, মঙ্গোলিয়ার সাথে তিব্বতের সম্পর্ক, তথা দ্বন্দ্ব, বৃটিশ সরকারের ভূমিকা তার অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টির আড়ালে থাকেনি। তিব্বতের রাজধানী লাসায় তিনি পৌছেন ১৯২৯ সালের ১৩ই জুলাই, আর ছেড়ে আসেন ১৯৩০ সালের ২৪শে এপ্রিল তারিখে। যাওয়ার সময় ভেবেছিলেন ১৪-১৫ বৎসর থাকবেন। কিন্তু তিনি যে উদ্দেশ্য অর্থাৎ অধ্যয়ন ও অধ্যাপনার জন্য তিব্বতে গিয়েছিলেন তা ততোটা পূরণ হয় নি। তাই প্রত্যাশিত সময়ের আগেই ফিরে আসতে বাধ্য হন।
তিব্বতে সওয়া বছর বইয়ের 'বাংলা অনুবাদ প্রসঙ্গে' শীর্ষক অংশে অনুবাদক মলয় চট্টোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন -
লেখকের অনুরাগী বন্ধু শ্রীজয়চন্দ্র বিদ্যালঙ্কারের মতে এটি হিন্দী সাহিত্যের প্রথম ভ্রমণ কাহিনী।... রাহুলজীর বাসনা ছিল যে তাঁর এই ভ্রমণ বৃত্তান্তটি যেন ১৯৩৩ সালের মধ্যে প্রকাশিত হয় কিন্তু নানা কারণে বইটির প্রকাশে আরও কিছু সময় লেগে যায়। ইতিমধ্যে রাজনৈতিক কারণে যে প্রেসে বইটির মুদ্রণ কাজ চলছিল সেখানে হামলা হয় এবং তার ফলে গ্রন্থের একটি অধ্যায় খোয়া যায়। যতদূর মনে হয় পরবর্তী কালে সেই অধ্যায়টি পুনরায় আর লেখা হয়নি। তবে গ্রন্থ-সম্পাদক তাঁর লেখা ভুমিকায় ঐ অধ্যায়ে কি ছিল তা সংক্ষিপ্তভাবে জানিয়ে দিয়েছেন। আজ থেকে অর্ধশতাব্দী আগে, যখন তিব্বত ছিল এক নিষিদ্ধ দেশ, তখন পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন এক মহৎ সঙ্কল্পে ব্রতী হয়ে, প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে গোপনে সে দেশে পাড়ি দিয়েছিলেন, তাঁর সেই নিষিদ্ধ যাত্রার বর্ণনা আজও আমাদের মুগ্ধ করবে নি:সন্দেহে।
সুখপাঠ্য ও তথ্যবহুল এই বইটি প্রকাশ করেছে চিরায়ত প্রকাশন, ভারত। ভ্রমণপিয়াসী, তথ্যসন্ধানী পাঠক বইটিকে আগ্রহভরে লুফে নেবে একথা বলা অতিশয়োক্তি নয়।
রাহুল সাংকৃত্যায়ন লিখিত 'তিব্বতে সওয়া বছর' বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছে ১৯৮২ সালে এবং দ্বিতীয় প্রকাশ হয়েছে ১৯৮৯ সালে;আর অর্থবহ প্রচ্ছদ করেছেন প্রবীর সেন।
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম