আজ আমি জানাতে চাই মশিউল আলম অনূদিত সক্রেটিসের আগে বইটার কথা। সক্রেটিসের পূর্ববর্তী যুগ সম্পর্কে আমরা খুব কম জানি। সে সময়ে মানুষের জিজ্ঞাসার বিকাশ কিভাবে হয়েছিল সে সম্পর্কে বাংলা ভাষায় বইপত্রের সংখ্যা বেশ কম। এই বইটি সে অভাব অনেকাংশে পূরণ করেছে। মূল গ্রন্থের কিছু অংশের অনুবাদ এটা। মূল বইটি লিখেছেন বার্ট্রান্ড রাসেল, নাম হিস্টরি অব ওয়েস্টার্ন ফিলোসফি (History of western philosophy)। অনুবাদকের কথা থেকে কিছু উল্লেখ করি-
এতে প্রাক-সক্রেটিস যুগের গ্রিক দর্শনের স্বরূপ তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। প্লেটো আর অ্যারিস্টটলের হাতে পাশ্চাত্য দর্শনের যে ভাণ্ডার গড়ে উঠেছে, দুই-আড়াই হাজার বছর ধরে সেই ভাণ্ডারে যা-কিছু জমা পড়েছে, তার সমস্ত কিছুর বীজ রোপণ করে গেছেন প্রাক-সক্রেটিস যুগের গ্রিক চিন্তাবিদগণ। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য থেলিস, অ্যানাক্সিমেন্ডার, অ্যানোস্কিমেনিস, পিথাগোরাস, হেরাক্লিটাস, পারমিনাইডিস, এম্পিডক্লিস, অ্যানাকেক্সগোরাস, লুসিপ্পাস, ডেমোক্রিটাস, জেনোফেনিস, প্রোটাগোরাস প্রমুখ। হোয়াইটহেড বলেছিলেন, পাশ্চাত্য দর্শনের সমগ্র ইতিহাস প্লেটোর দর্শনের পাদটীকা ছাড়া কিছু নয়। প্রাক-সক্রেটিস যুগের চিন্তাবিদদের খোঁজখবর নেওয়ার পর দেখা যাবে, প্লেটোর দর্শন গড়ে উঠেছে তাঁদের চিন্তাভাবনা থেকেই। প্লেটোর ওপর পিথাগোরাস, পারমিনাইডিস ও হেরাক্লিটাসের প্রভাব ছিল অত্যন্ত গভীর। পিথাগোরাসের কাছ থেকে তিনি পেয়েছেন ধর্মীয় প্রবণতা, অমরত্বে বিশ্বাস, পরজাগতিকতা, পুরোহিতের মেজাজ।.... যাই হোক, সরলভাবে বললে, প্রাক-সক্রেটিস যুগের দার্শনিকগণ যেসব প্রসঙ্গ উত্থাপন করে গেছেন সমগ্র পাশ্চাত্য দর্শনে দুই হাজার বছর ধরে তারই আলোচনা, সমালোচনা, পর্যালোচনা চলছে। আমাদের কৌতুহলের সমস্ত বিষয়ই তাঁরা স্পর্শ করে গেছেন।.... যেমন, পারমিনাইডিসবলেছেন, 'যে জিনিস সম্পর্কে চিন্তা করা যায় এবং যে-জিনিসের কারণে চিন্তার অস্তিত্ব আছে তা একই। কারণ অস্তিত্বমান কোনো বস্তু ছাড়া তা সম্পর্কে উচ্চারিত কোনো চিন্তা হতে পারে না।' বার্ট্রান্ড রাসেল এই যুক্তির সারকথা ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে: যখন তুমি কিছু সম্পর্কে চিন্তা কর, অবশ্যই কোনো-একটা বস্তু সম্পর্কে চিন্তা কর; যখন তুমি একটা নাম ব্যবহার কর অবশ্যই তা একটা-কিছুর নাম। সুতরাং চিন্তা ও ভাষা উভয়েরই এমন বিষয় প্রয়োজন যা তাকে চিন্তা ও ভাষার বাইরে। আর, একটা বস্তু সম্পর্কে যে কোনো সময় চিন্তা করা বা কথা বলা যায় মানে, যে-বস্তু সম্পর্কে চিন্তা করা বা কথা বলা যায় তার অস্তিত্ব সর্বদা বিরাজমান থাকে।
পুরাতন গ্রিক চিন্তাবিদদের মধ্যে চিন্তার প্রতি কোন রকমের বিরূপ মনোভঙ্গী বা বিদ্বেষ ছিল না। এর প্রমাণ কয়েকজন দার্শনিকের মধ্যে পাওয়া যায়। অ্যানাক্সিমেন্ডার প্রাণীর বিবর্তন সম্পর্কে চিন্তা করেছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে অ্যানাক্সিমেন্ডার মনে করতেন প্রাণীজগত বিকশিত হয়েই সৃষ্টি হয়েছে। তিনি মনে করতেন মানবপ্রজাতি মাছ থেকে উৎপত্তি হয়েছে। এ সম্পর্কে তার বক্তব্য ছিল- মানুষ গোড়া থেকেই এই মানুষ ছিল না, নিশ্চয়ই ভিন্ন প্রকৃতির কোনো জীব থেকে মানুষের উদ্ভব ঘটেছে। কারণ, এখন তার শৈশবকাল এত দীর্ঘ যে, আদিতে এরকম থাকলে বর্তমান অবস্থা পর্যন্ত সে কোনোভাবেই টিকে থাকতে পারত না।
গ্রিক চিন্তাবিদগণ কেউ কেউ ছিলেন ভাববাদী, কেউ বা ছিলেন যুক্তিবাদী। এরা সবাই সাধারণত যুবকদের বিনাপয়সায় শিক্ষা দিতেন। কেউ কেউ অর্থের বিনিময়ে শিক্ষা দিতেন। তাদের বলা হত সফিস্ট। তারা তর্কবিতর্কের বিভিন্ন কৌশল শিক্ষা দিতেন। এরা মোটামুটি বিজ্ঞানমনস্ক ছিলেন। পরবর্তীতে সক্রেটিসের পরে প্লেটোর সময়ে এসে এই মতবাদ ভাববাদী মতাদর্শের নিকট পরাজয় বরণ করতে বাধ্য হয়।
গ্রিক দার্শনিকদের মরমীবাদ, বুদ্ধিবাদ, বিজ্ঞানসচেতনতা ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে হলে এই বইটি বেশ ভাল একটি তথ্যবহুল উৎস হিসেবে বিবেচিত হওয়ার যোগ্যতা রাখে।
সূচিপত্র নিম্নরূপ:
- গ্রিক সভ্যতার অভ্যুদয়
- মিলেসীয় ধারা
- পিথাগোরাস
- হেরাক্লিটাস
- পারমিনাইডিস
- এম্পিডক্লিস
- সংস্কৃতিক্ষেত্রে এথেন্স
- অ্যানাক্সেগোরাস
- পরমাণুবাদীগণ
- প্রোটাগোরাস
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম