গ্রন্থ পর্যালোচনার দুইটি লক্ষ্য রয়েছেঃ-
বর্ণনামূলক পর্যালোচনাঃ একটি বই সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদান করে। বর্ণনা ও বিশ্লেষণ পদ্ধতি প্রয়োগ করে লেখকের উদ্দেশ্যে ও ব্যক্তিগত প্রবণতার বিবরণ এবং আলোচ্য বই থেকে কাঙ্ক্ষিত অংশ উদ্ধৃত করে এ কাজ করা হয়।
সমালোচনামূলক পর্যালোচনাঃ এটা বইয়ের বর্ণনা ও মূল্যায়ন করে। সর্বজনগ্রাহ্য সাহিত্যিক ও ঐতিহাসিক মানদণ্ডের বিচারে বই থেকে উপযুক্ত উদ্ধৃতিকে প্রামাণ্য ধরে এই মূল্যায়ন প্রতিষ্ঠা করা হয়।
নিম্নোক্ত নির্দেশকগুলিকে কোন বইয়ের সমালোচনামূলক পর্যালোচনার সহায়ক হিসেবে মনে করা যেতে পারে।
প্রাথমিকভাবে অপরিহার্য বিষয়সমূহঃ
কোন গ্রন্থের সমালোচনামূলক আলোচনা পর্যালোচনা করতে গিয়ে বিশ্লেষককে দুইটি জিনিস অবশ্যই জানতে হবে।
১। আলোচ্য বই সম্পর্কে বিস্তারিত জানাঃ শুধুমাত্র লেখকের উদ্দেশ্যকে বোঝা নয়, বইয়ের লিখিত অংশগুলো সেই উদ্দেশ্য গঠনে কতটা সাহায্য করেছে- সেই সাথে লেখকের পরিচিতি, তার জাতীয়তা, সময়কাল, অন্যান্য রচনা ইত্যাদিও জানা থাকা প্রয়োজন।
২। বইয়ের ধরণ/ শ্রেণীঃ এটা বুঝতে পারা মানে শিল্পের উৎস ও শৈলী সম্পর্কে ধারণা থাকা। এই জ্ঞান ছাড়া মূল্যায়নের ভিত্তি যে প্রামাণ্য ইতিহাস ও সাহিত্য, সেই বিষয়ে আলোচকের অজ্ঞতা প্রকাশ পাবে।
আলোচনার জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়সমূহঃ
বইয়ের বর্ণনাঃ পর্যাপ্ত বর্ণনা দিন যেন পাঠক লেখকের ভাবনা-চিন্তাকে বুঝতে পারে। এটা শুধুমাত্র সারাংশ হলে হবে না। সমালোচনার যোগ্য উপাদানগুলোকে ঠিকঠাকভাবে বিস্তারিত তুলে ধরুন।
লেখকের পরিচয় দিনঃ লেখকের ব্যক্তিগত পরিচয় গ্রন্থ আলোচনায় প্রাসঙ্গিক। আলোচ্য বইটি বুঝতে লেখকের পরিচিতি পাঠককে সাহায্য করবে।
বইটির মূল্যায়নঃ একটি গ্রন্থ আলোচনা নিম্নোক্ত দিকগুলোর আলোকে বিচার্য হতে হবে।
- লেখকের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আলোচকের উপলব্ধির বিবরণ।
- লেখকের উদ্দেশ্য যতটা অর্জিত হয়েছে আলোচক তা কতটুকু হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছেন?
- লেখকের সাফল্যকে আলোচক কতটা মূল্যায়ন করতে পেরেছেন তার প্রামাণিকতা।
যখন বইটি পড়তে থাকবেনঃ
- আন্তরিকতার সাথে বইটি পড়ুন।
- উদ্ধৃত করার মতো বাক্য বা পংক্তিসমূহকে চিহ্নিত করুন।
- পড়তে পড়তে আপনার মধ্যে কী প্রতিক্রিয়া হচ্ছে তা লিখে রাখুন।
- যা পড়েছেন তা আত্মস্থ হতে সময় দিন। ফলে ভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে দেখা সম্ভব হবে।
- পাঠকের নিকট পরিষ্কারভাবে তুলে ধরা যাবে এমন সামান্য অনুভূতির কথাও মাথায় রাখুন।
আলোচনার রূপরেখাঃ
- একটি রূপরেখা সম্পূর্ণ আলোচনাটিকে সঠিকভাবে সাজিয়ে তোলার ধারণা দেবে। এই রূপরেখাটিকে আপনার আলোচনার প্রধান বিবেচ্যকে চিহ্নিতকরণ, অপ্রয়োজনীয় ও অপ্রাসঙ্গিক অংশগুলোকে বর্জন এবং কোনো অসম্পূর্ণ অংশ পূরণ করতে সাহায্য করবে।
- বইটি পড়তে পড়তে যা লিখে নিয়েছিলেন তার থেকে আপনার প্রধান আলোচ্য বিষয়ের সাথে যা মেলে না তা বাদ দিন।
- আপনার আলোচনাকে প্রসঙ্গ অনুযায়ী বিভিন্ন ভাগে ভাগ করুন। বইয়ের সার্বিক প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠবে। (যেমনঃ মূল বিষয়, চরিত্র, কাঠামো ইত্যাদি)
- রূপরেখার সব অংশ যেন আপনার রচনার প্রধান লক্ষ্যকে সমর্থন করে।
প্রথম খসড়া বা পূর্বলেখঃ
উপক্রমণিকা দিয়ে রচনাটির সুর বোঝা যায়। সম্ভাব্য ভূমিকায় যে বিষয়গুলো নিয়ে বক্তব্য দেয়া যেতে পারে সেগুলো হলঃ
- আলোচ্য প্রসঙ্গ
- লেখার উদ্দেশ্য
- কাজটির উপযোগীতা অথবা এর তাৎপর্য
- লেখকের একই জাতীয় অন্যান্য লেখা অথবা একই বিষয়ে অন্য লেখকের লেখার সাথে তুলনা।
- লেখকের পরিচিতি
গ্রন্থ পর্যালোচনার শরীরটাই আপনার আলোচনাকে যৌক্তিকতা দেবে। আপনার তৈরীকৃত 'আলোচনার রূপরেখা'টি অনুসরণ করুন অথবা যুক্তিকে প্রতিষ্ঠা করতে রূপরেখার পরিসীমাকে বাড়িয়ে দিন। উল্লেখযোগ্য বাক্য বা পংক্তিগুলোকে উদ্ধৃতিচিহ্নের মধ্যে অথবা মার্জিনের পাশে অথবা পাদটীকা হিসেবে লিখে রাখুন।
সমাপ্তিসূচক অনুচ্ছেদঃ
উপসংহারে কোন নতুন তথ্য বা ভাবনা উপস্থাপন করবেন না। সারাংশ টানুন, আপনার সমস্ত আলোচনাকে অল্প কথায় উপস্থাপন করুন অথবা এটাই হয়তো আপনার চূড়ান্ত বিবেচনায় পরিণত হবে।
খসড়াটির পুনর্পাঠঃ
- সমস্ত আলোচনাটি আরেকবার পড়ার আগে সময় নিন। অন্তত একদিন। সময়কে বয়ে যেতে দিন।
- ব্যাকরণ ও বানানগত যে ভুলগুলোকে দেখতে পাচ্ছেন সেগুলো সংশোধন করুন।
- লেখার ধারাবাহিকতা, কাঠামোবদ্ধতা এবং যৌক্তিক ভিত্তিকে শক্তিশালী করার জন্য আপনার আলোচনাটিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ুন।
- প্রয়োজনবোধে বড় অংশ কেটে পুনর্লিখন করতে দ্বিধা করবেন না।
- উদ্ধৃতিগুলোর নির্ভুলতা, সজ্জাশৈলী এবং তথ্যসূত্রের উপাদান নিখুঁতভাবে পরীক্ষা করুন।
সমালোচনার সময় বিবেচ্যসমূহ
উপন্যাস/গল্প (Fiction)
প্রথম নিয়ম হচ্ছে গল্পটাকে হুবহু বলে দেওয়া যাবে না।
চরিত্র (Character)
- কোন উৎস থেকে চরিত্রগুলোকে নিয়ে আসা হয়েছে?
- নিজ সৃষ্ট চরিত্রগুলো নিয়ে কী করার প্রবণতা লেখকের রয়েছে?
- চরিত্রগুলো কি একঘেঁয়ে নাকি জীবন্ত?
- চরিত্রগুলোর কোন উন্নতি ঘটে কি?
- চরিত্রবর্ণনা কি প্রত্যক্ষ নাকি পরোক্ষ?
মূলভাব (Theme)
- প্রধান বিষয় কোনটা অথবা কোনগুলো?
- সেগুলো কীভাবে বিকশিত ও প্রকাশিত হয়েছে?
- মূল কাহিনী কি চেনাজানা পরিচিত কোন পারিবারিক, সামাজিক বিষয়ে নাকি একেবারে নতুন ও মৌলিক কোনো বিষয়ে?
- মূল কাহিনীটি উদ্দেশ্য ও বৈশিষ্ট্যগতভাবে কি নীতিমূলক, মনস্তাত্ত্বিক, সামাজিক বিনোদনমূলক নাকি পলায়নী প্রবৃত্তিমূলক?
কাহিনী/ ঘটনাপরম্পরার খণ্ডাংশ (Plot)
- কাহিনীর বিভিন্ন খণ্ডাংশক যেমন- উপস্থাপনা, চূড়ান্ত মুহূর্ত, চরম পরিণতি, সমাপ্তি কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে?
- চরিত্র বৈশিষ্ট্যের সাথে কাহিনীর যোগসূত্র কতটা?
- জটিল করে তোলা অথবা সমাধানের উদ্দেশ্যে জোর করে কোনো অঘটনকে ব্যবহার করে কাহিনীকে টেনে লম্বা করা হয়েছে কি?
- রহস্যময়তা ও চূড়ান্ত মুহুর্তগুলো কোন কোন উপাদান দিয়ে সাজানো হয়েছে?
- কাহিনীর আরও কি কি উপাদান ব্যবহার করে জটিলতা সৃষ্টি ও তার সমাধান করা হয়েছে?
- উপকাহিনী রয়েছে কি? থাকলে তা মূল গল্পের সাথে কতটা প্রাসঙ্গিক?
- চরিত্র অথবা নির্মাণশৈলী অথবা গল্পভঙ্গির মতো মূলগল্পের প্রধান উপাদানগুলো বিকাশের জন্য কাহিনীকে ব্যবহার করা হয়েছে কি?
ধরণ/ রীতি/ কৌশল (Style)
- লেখাটির বুদ্ধিবৃত্তিক বৈশিষ্ট্য কোন প্রকারের? (উদাহরণঃ সরল, প্রাঞ্জল)
- লেখাটির আবেগগত দিক কোন প্রকারের? (উদাহরণঃ কৌতুক, ব্যাঙ্গাত্মক, বিদ্রুপাত্মক)
- লেখাটির রুচি বা সৌন্দর্যগত বৈশিষ্ট্য কী রকম? (উদাহরণঃ সঙ্গতিপূর্ণ, ছন্দোবদ্ধ)
- কোন প্রকারের রীতিপদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে? (উদাহরঃ প্রতীকীবাদ, প্রহসন, উপকরণবাদ নাকি রূপক?)
- সংলাপ কতটা প্রভাব ফেলেছে?
বিন্যাস/ সজ্জাশৈলী (Setting)
- কাহিনীর বিন্যাস কতটা শক্তিশালী? এটা কি সম্পূর্ণ কাজটার পিছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে?
- পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির যথাযথ বোধ উপস্থাপিত হয়েছে কি, হলে কীভাবে?
- কোন ধরণের নাটকীয়তা ব্যবহার করা হয়েছে? এটা কতটা প্রয়োজনীয় ও কার্যকরী ছিল?
- বিন্যাস বা সজ্জাশৈলী চরিত্রগুলো অথবা কাহিনীটিকে কতটা প্রভাবিত ও বিনির্মাণ করেছে?
জীবনী
- যার জীবন আলোচনা করা হচ্ছে তার পূর্ণ জীবনচিত্র আলোচ্য বইতে রয়েছে কি?
- যার জীবনী তিনি জীবনের কোন কোন স্তরে সফলতা পেয়েছেন? তার এই সাফল্য লাভ কি অনিবার্য ছিল?
- জীবনচরিত লেখকের দৃষ্টিকোণ কীরূপ?
- বিষয়ের উপাদানগুলোকে কীভাবে সাজানো হয়েছে? কালানুক্রমিকভাবে নাকি স্মৃতিমন্থনের মতো করে?
- যার জীবনী রচিত হয়েছে তার সম্পর্কে লেখকের ধারণা কেমন? ভাসাভাসা নাকি গভীর?
- জীবনীটি রচনা করতে কোন কোন উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে?
- জীবনী রচনা করতে যেসব তথ্য সন্নিবেশ করা হয়েছে তার দালিলিক প্রমাণাদি উল্লেখ করা হয়েছে কি?
- যার জীবনী রচনা করা হয়েছে তার জীবনের কোনো গোপন অধ্যায় লেখক উন্মোচন করার চেষ্টা করেছেন কি?
- আলোচ্য ব্যক্তিত্বের জীবনের নতুন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বইটিতে স্থান পেয়েছে কি?
- সমকালীন ইতিহাসের সাথে আলোচ্য ব্যক্তিত্বের কোন ধরণের প্রভাব বা সম্পর্ক আছে?
- একই ব্যক্তি সম্পর্কে অন্য কোন লেখকের লিখিত জীবনীগ্রন্থের সাথে আলোচ্য বইটির কীভাবে তুলনা করা যাবে?
- একই লেখকের লিখিত অন্যান্য বইয়ের সাথে আলোচ্য বইটি কীভাবে তুলনীয় হবে?
- নির্দিষ্টভাবে ঠিক কোন সময়কাল নিয়ে বইটি রচিত?
- আলোচনা কতটা বিস্তারিত?
- তথ্যের জন্য কোন ধরণের উৎস ব্যবহার করা হয়েছে?
- বইটি কি বিস্তারিতভাবে নাকি শুধু প্রধান প্রধান ঘটনাগুলি সম্পর্কে লিখিত?
- লেখার ভঙ্গি কীরূপ? পত্রিকার মতো নির্দিষ্ট আঙ্গিকবদ্ধ নাকি বিস্তারিত ব্যাখ্যাসহ?
- লেখক কোন দৃষ্টিকোণ থেকে বইটি রচনা করেছেন?
- বইটি হালকা নাকি গভীর চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত?
- কোন ধরণের পাঠকগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে বইটি লেখা হয়েছে?
- আত্মজীবনীর মতো কোন অংশ কি বইটাতে কোন ভূমিকা রেখেছে?
- সামাজিক নাকি রাজনৈতিক – কোন ধরণের ইতিহাস রচনার দিকে লেখকের ঝোঁক বেশি?
- সন তারিখের ব্যবহার কি ব্যাপক? যদি হয়ে থাকে তাহলে তা যথাযথভাবে হয়েছে কি?
- এই বইটি কি কোন নতুন সংস্করণ? যদি হয়ে থাকে তাহলে পূর্ববর্তী সংস্করণের সাথে তুলনীয় কোথায়?
- ম্যাপ, ছক, ছবি কি ব্যবহার করা হয়েছে? সেগুলো কীভাবে মূল্যায়িত হবে?
কবিতা পর্যালোচনা
- এটা কি একটি শক্তিশালী, মৌলিক, স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত একটি কাজ?
- কি ধরণের কবিতা আপনি আলোচনা করছেন (মহাকাব্য, গীতিকাব্য, শোকগাথা)?
- কোন কাব্যিক উপাদান ব্যবহৃত হয়েছে (মিত্রাক্ষর, ছন্দময়, বাক্যবহুল, চিত্রকল্প ইত্যাদি), এবং এর ফলাফল কীরূপ?
- কবিতার কেন্দ্রিয় প্রবণতা কোন দিকে? এটা কি ঠিকঠাক প্রকাশ পেয়েছে?
- লেখাটি অনুমতিক্রমে প্রকাশিত হল
- অনলাইনে এর পিডিএফ কপির এর ডাউনলোড লিংক
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম