শূন্যের ইতিকথা
মূল: দিলীপ এম সালভি
অনুবাদ: শফিকুল ইসলাম
অঙ্কন: রুমা শর্মা
প্রকাশনী: সংঘ প্রকাশন, ঢাকা।
প্রকাশকাল: প্রথম বাংলা সংস্করণ ২০০৮
পৃষ্ঠা: ২৪
মূল্য: ৮০ টাকা
বিজ্ঞানের বিকাশে শূন্য এক বিশাল ভূমিকা রেখেছে। আমাদের কাছে শূন্য অর্থ কিছুই না। কিন্তু গণিতের চোখে শূন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি সংখ্যা। প্রাচীনকালের মানুষ কীভাবে গণনা করতো, শূন্য কীভাবে আবিষ্কার হলো, কীভাবে এর ব্যবহার সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল এর সংক্ষিপ্ত ও তথ্যবহুল কাহিনী নিয়েই দিলীপ এম সালভি রচনা করেছেন ‘শূন্যের ইতিকথা’ বইটি। কিশোরদের উপযোগী করে লেখা বইটি নবীন পাঠককে শূন্য সম্পর্কে আরও বেশি জানতে আগ্রহী করে তুলবে। সহজবোধ্য ভাষায় কিশোর-কিশোরীদের জন্য শূন্যের ইতিহাস বইটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন শফিকুল ইসলাম।
প্রাচীনকালে মানুষ যখন শূন্য আবিষ্কার করতে পারেনি, তখনও গণনাপদ্ধতি ছিল। মানুষ সাধারণ দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনগুলো নিজেদের স্থানীয় গণনাপদ্ধতিতে সেরে নিত। ভারতবর্ষেও ছিল একই অবস্থা। বিভিন্ন এলাকার মানুষ বিভিন্নরকম স্থানীয় গাণিতিক পদ্ধতিতে প্রয়োজনীয় গণনার কাজ সেরে নিত। মহামতি সম্রাট অশোকের সময়েও মানুষ বড় বড় সংখ্যা অংকে না লিখে কথায় লিখত। যেমনঃ সহস্র, অযুত, লক্ষ, কোটি ইত্যাদি।
ভারতীয় গণিতবিদ ব্রহ্মগুপ্ত (৫৯৮-৬৬০ খ্রি.) প্রথম শূন্যের ধারণা প্রকাশ করেন। ৬২৮ খ্রিস্টাব্দে রচিত তার ‘ব্রহ্মসিদ্ধান্ত’ বইতে শূন্যকে একটি সংখ্যার মতো করে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর আলোচনাকে ত্রুটিমুক্ত করে আরও প্রামাণ্য করে তোলেন বিখ্যাত গণিতশাস্ত্রবিদ ও জ্যোতির্বিদ ‘ভাস্করাচার্য (১১১৪-১১৮৫ খ্রি.)’। ‘লীলাবতী’ গ্রন্থে তিনি শূন্যের শক্তিময়তার বিশ্লেষণ করেন। শূন্যের আবিষ্কার শূন্যের চেয়ে ছোট সংখ্যার ধারণা তৈরি করে। ঋণাত্মক সংখ্যা যেমন -১, -২, -৩ ইত্যাদির উদ্ভাবন ঘটে। নতুন অর্জিত এই জ্ঞান উচ্চতর বীজগণিতের বিকাশে প্রভাব ফেলে।
ভারতীয় গণিতশাস্ত্রবিদদের শূন্যের ব্যবহার বিশ্বের অন্য এলাকার পণ্ডিতদের প্রভাবিত করতে শুরু করে। ইরাক, ইরান, সিরিয়া, তুরস্ক, স্পেনের পন্ডিতদের কাছে শূন্যের ব্যবহার জনপ্রিয় হয়। বাগদাদের আল-মামুন বিজ্ঞান একাডেমীর (House of wisdom) মহান গণিতজ্ঞ আল-কোয়ারিজমি (৭৯০-৮৫০ খ্রি.) ভারতীয় গণিতশাস্ত্র খুব আগ্রহের সাথে আত্মস্থ করেছিলেন। তাঁর হাত ধরেই শূন্যের ব্যবহার বহির্বিশ্বের গণিতবিদদের মধ্যে ছড়িয়ে পরে।
অনুবাদক লেখক শফিকুল ইসলামের ‘শূন্যের ইতিকথা’ বইটি ভারতীয় গণিতশাস্ত্রের তথা শূন্যের দিগ্বিজয়ের কাহিনী নিয়েই রচিত। তাঁর বই থেকে জানতে পারি ইউরোপের বিভিন্ন পণ্ডিত যেমন ফিবোনাক্কি, ল্যাপলাস, নিকোলাস কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও, নিউটন প্রমুখ বড় বড় সংখ্যা প্রকাশে শূন্যের ব্যবহার করে উপকৃত হন। মূলত জ্যোতির্বিদরাই বড় বড় সংখ্যা লেখার প্রয়োজনবোধ করতেন। তাই শূন্য আবিষ্কার ও ব্যবহারের সাথে জ্যোতির্বিদদের ভূমিকা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে।
ভারতীয় গণিত অর্থাৎ দশমিক পদ্ধতি ও শূন্য গণিতজগতে সম্ভাবনার অসীম দ্বার খুলে দেয়। তাই দেখা যায় শূন্যের আবিষ্কর্তা ভারতীয়রা যে সময় জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্রসমূহের ধ্বংসকাণ্ড দেখছিল, সে সময় ইউরোপ সেই ভারতীয় সংখ্যা ও শূন্যের ব্যবহার করে জ্ঞানবিজ্ঞানে শনৈঃ শনৈঃ উন্নতি করে যাচ্ছিল। ফলশ্রুতিতে শূন্যের ব্যবহার ঠিক রেখে উদ্ভব ঘটে বাইনারি গণিতে, যার হাত ধরে আসে আজকের কম্পিউটার।
শূন্য অর্থ মূলত 'কিছুই না'। এই কিছুই না বোঝাতে ব্যবহৃত হত একটিমাত্র বিন্দু। এই বিন্দু আরও বৃহদাকার হয়ে বিশ্বের জ্ঞানবিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে একেবারে পাল্টে ফেলেছে। যতদিন শূন্য ছিলনা ততোদিন জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছিল। রোমান সংখ্যা পদ্ধতিতে বড় সংখ্যা প্রকাশ করা অসম্ভব ছিল। ফলে সংখ্যা বিষয়ক কল্পনার সীমারেখা খুব বেশি সম্প্রসারিত হতে পারেনি।
প্রাচীন গ্রীসের দুই পণ্ডিত আর্কিমিডিস ও অ্যাপোলেনিয়াস শূন্যের দেখা পাননি। এ বিষয়ে দুঃখ করে ফ্রান্সের গণিতবিদ ল্যাপলাস (১৭৪৯-১৮২৭) বলেছেন-
“গ্রীক গণিতজ্ঞদ্বয় যদি এই সংখ্যা আবিষ্কার করতে পারতেন, তবে তাঁর সময়কার বিজ্ঞান অনেক বেশী অগ্রসর অবস্থানে থাকতো।"
শূন্য সম্পর্কে ছোটদের জন্য এমন তথ্যবহুল বই বিরল। সাম্প্রতিক ঐতিহাসিক তথ্যসমৃদ্ধ এই বই কিশোর পাঠককে শূন্যের সঠিক ইতিহাস জানতে সাহায্য করবে। শূন্য সম্পর্কে জানতে আরও উৎসাহী করবে। সাত ইঞ্চি×নয় ইঞ্চি আকারের বইটি হাতে ধরে পড়তে বালক বালিকারাও পছন্দ করবে। ঝকঝকে ছাপা, রঙের প্রমিত ব্যবহার, উপযুক্ত ছবি বইটিকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। অনুবাদকের ভাষা সরল। গণিতের জটিল বিষয়সমূহকে এত সহজভাবে বর্ণনা করেছেন যে এক বসাতেই সম্পূর্ণ বই পড়ে শেষ করে দেয়া যায়।
বইয়ের মূল লেখক 'দিলীপ এম সালভি' সম্পর্কে কোথাও দু'এক লাইন পেলাম না। তিনি কোন দেশের অধিবাসী, কোন ভাষায় মূল বইটি লেখা হয়েছিল এরকম দু'একটি তথ্য যে কোন জায়গায় দেয়া যেতে পারতো। এই অতৃপ্তিটুকু থাকা সত্ত্বেও শিশু কিশোরদের জন্য এরকম তথ্যবহুল ইতিহাস নির্ভর বই প্রকাশের জন্য অনুবাদক শফিকুল ইসলাম ও সংঘ প্রকাশনকে ধন্যবাদ জানাই।
1 মন্তব্যসমূহ
ভাল।
উত্তরমুছুনমার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম