সুশান্ত বর্মন
রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন
ডক্টর আশরাফ সিদ্দিকী
ভূমিকাঃ
বাংলাদেশের এক প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল থেকে লেখক ডক্টর আশরাফ সিদ্দিকী পড়াশোনা করতে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত বিখ্যাত শান্তিনিকেতনে। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ লেখকের চিন্তাভাবনা তথা জীবনদর্শনে এক সামগ্রিক পরিবর্তন এনে দিয়েছে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্যক্তিজীবনে সৌন্দর্য, আনন্দ ও বাঙালি সংস্কৃতির সাধনায় নিরন্তর রত ছিলেন। বিশ্ব ভ্রমণে ঋদ্ধকবি যে বৈশ্বিক আদর্শ অন্বেষণ করেছেন, নিজের মনে মননে তার প্রতিফলন অনুভব করেছেন, তার বাস্তবায়ন করেছেন স্বপ্রতিষ্ঠিত 'শান্তিনিকেতন' নামক প্রতিষ্ঠানটিতে।
গ্রন্থকার ডক্টর আশরাফ সিদ্দিকী তাঁর উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীতে পাঠকালীন সময়ে শান্তিনিকেতনের শিক্ষাপদ্ধতি, সাংস্কৃতিক উদারতা, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক, প্রতিদিনের জীবনাচরণ, প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রতি ঘনিষ্ঠতা ইত্যাদির সাথে পরিচিত হয়ে মুগ্ধ হয়েছেন। মানুষ ও প্রকৃতির প্রতি এক অপার ভালোবাসার বীজ নিজের হৃদয়ে রোপন করেছেন। বিশ্বমানবতার আত্মিক জয়গান নিজের হৃদয়ে অনুভব করেছেন। এইসব বিবিধ বিষয় নিয়েই আলোচ্য গ্রন্থ "শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ"। লেখকের সাংস্কৃতিক অন্বেষণ পূর্ণতা পেয়েছে এই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা গ্রহণ করতে এসে। সেটাই তিনি আলোচনা করেছেন গ্রন্থের পাতায় পাতায়।
বস্তুতঃ উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণীতে পাঠকালীন সময়ে শান্তিনিকেতন থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা এই গ্রন্থটির বিভিন্ন রচনাগুলির প্রধান আলোচ্য বিষয়। আমি আমার আলোচনায় বিষয়টিকে উপস্থাপন করার প্রচেষ্টা নিয়েছি।
গ্রন্থের মূল উপজীব্যঃ
আলোচ্য গ্রন্থটির মূল উপজীব্য বিষয় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত "শান্তিনিকেতন"। এই বিশ্বখ্যাত শিক্ষাকেন্দ্রে লেখক ডক্টর আশরাফ সিদ্দিকী তাঁর ছাত্র জীবন কেমন কাটিয়েছেন, তা আগ্রহভরে বর্ণনা করেছেন এই বইটিতে। ১৯৪৫ সালের জুলাই মাসের ৩ তারিখে লেখক উপস্থিত হন শান্তিনিকেতনে। অসংখ্য পাখ-পাখালির ডাকে তিনি প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠতেন। আম-জাম, কাঁঠাল-লিচু, হরিতকী, শাল, শাতিম তলায় ছায়াঘন পরিবেশে ক্লাশ করতেন। এক মুগ্ধ আবেশে সারাটা দিন কিভাবে কেটে যেত লেখক যেন তা বুঝতেই পারতেন না। শান্তিনিকেতনের প্রাকৃতিক পরিবেশ তথা রাস্তা, গাছ, পাখি, মানুষ, ছাত্র, শিক্ষক, ক্লাশ, অবারিত নৈসর্গিক দৃশ্য, গ্রাম, নদী ইত্যাদি নিয়েই সমৃদ্ধ হয়েছে লেখকের ছাত্রজীবন।
বইটির গুরুত্ব, তাৎপর্য ও প্রাসঙ্গিকতাঃ
বাংলা গ্রন্থ তালিকায় বইটির গুরুত্ব একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতনের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাঙালিরা আর একটিও তৈরি করতে পারেনি। এই বিদ্যানিকেতনের শিক্ষাদান পদ্ধতি, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক, ছাত্র-ছাত্রী সম্পর্ক বাঙালি সংস্কৃতির চর্চা, প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা, অসাম্প্রদায়িক চেতনার চর্চা সবকিছুই ছিল অনন্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্যক্তিজীবনে যে উদার ও বৈশ্বিক মানবতার লালন নিজ জীবনে প্রয়োগ করেছেন, প্রাত্যাহিক জীবনাচারে মেনে চলতেন- তার প্রতিফলন দেখি শান্তিনিকেতনের সামাজিক জীবনে। এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা পাওয়া ছাত্র-ছাত্রীরা নিজেদের ব্যক্তিজীবনেও রবীন্দ্রনাথের আদর্শকে বহন করে চলতেন। শিক্ষার্থীদের জীবনগঠনপ্রক্রিয়ার সামগ্রিক রূপ জানা সম্ভব এই গ্রন্থটি পাঠের মাধ্যমে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেসব দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর আদর্শ ও পরিচালনা পদ্ধতির সাথে পরিচিত হবার চেষ্টা করতেন। ফলে শিক্ষার আদর্শ ও লক্ষ্যের মূলভাব তিনি অনুভব করতে পেরেছেন। এছাড়াও প্রাচীন ভারতীয় আশ্রমের বৈশিষ্ট্য রবীন্দ্রভাবনায় সমুজ্জ্বল ছিল। ফলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতনে প্রাচীন ঋষিগণের শিক্ষাভাবনার সাথে বৈশ্বিক আদর্শনিষ্ঠ শিক্ষাপদ্ধতির অভূতপূর্ব মিলন ঘটেছে। ফলে শান্তিনিকেতন হয়ে উঠেছে এক উন্নত রুচিশীল মানবাদর্শের তীর্থক্ষেত্র।
লেখক আশরাফ সিদ্দিকীর সমাজচেতনার বিনির্মাণ শান্তিনিকেতনের জল-আলো-বাতাসে সমৃদ্ধ হয়েছে। তিনি পুরাতন জীর্ণ-জ্বরা ত্যাগ করে এক ঐশ্বর্যময় সংস্কৃতির আলোকিত ভূবনে পরিভ্রমণ করেছেন। বুঝেছেন বাঙালি মর্মবাণীর সার্থকতার স্বরূপ।
প্রাসঙ্গিকতাঃ
বর্তমানকালের নতুন প্রজন্ম এক অস্বাভাবিক সামাজিক বিকাশমানতার মধ্য দিয়ে শিক্ষালাভ করে চলেছে। ফলে তারা শিক্ষার মর্মবাণী গ্রহণে সক্ষম হচ্ছে না। মৌলিক চিন্তা করতে পারা তো দূরের কথা, তাদের মধ্যে মানবীয় গুণগুলোর প্রতিফলন তেমনভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। বর্তমানকালের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ছাত্রদের সার্টিফিকেট প্রদানের বাণিজ্যকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। সত্যিকারের মানুষ হবার গুণাবলী ছড়িয়ে দিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যর্থতা দিনে দিনে প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে।
বিপরীতে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতন একটি সম্পূর্ণ বিদ্যাশিক্ষার আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত। এখানে সমাজ ও সমকাল সম্পর্কিত বিষয়াদি সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান আহরণের পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা মানবীয় গুণাবলির চর্চা করতো। শিক্ষকদের কাছে মানবমন্ত্রে দীক্ষা নেবার সুযোগ পেত। শান্তিনিকেতনের শিক্ষার্থীরা তাদের ছাত্রত্বকালেই আদর্শ ও জ্ঞানের সম্মিলিত রূপ অনুধাবন করতে পারত। ছাত্রদের আত্মদর্শনের এই বিষয়টিই আলোচ্য গ্রন্থের মূল উপজীব্য।
শান্তিনিকেতনে প্রতিদিনের ক্লাশগুলো হত গাছের ছায়ায়। লেখক অন্য ছাত্রদের সাথে ঘাসের উপরে বসে শিক্ষকদের বক্তৃতা শুনতেন। একাসনে মেয়েরা বসলেও পরস্পরের সম্পর্ক ছিল সহজাত বন্ধুভাবাপন্ন।
বর্ষাকাল এলেই শান্তিনিকেতনে হত 'বৃক্ষরোপন উৎসব'। বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিভিন্ন কবিতা, গল্প তথা সাহিত্য ও আলোচনায় একাধিকবার ব্যক্ত করেছেন। যার যথাযথ প্রতিফলন ঘটিয়েছেন নিজের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আঙ্গিনায়। প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রী নিজ হাতে শান্তিনিকেতনের মাটিতে কমপক্ষে একটি গাছ রোপন করতো। ফলে এক মায়ার বন্ধনে শান্তিনিকেতনের সাথে শিক্ষার্থীর গাঁটছড়া বাঁধা হয়ে যেত।
শান্তিনিকেতনে মাঝেমধ্যেই প্রখ্যাত কবি-সাহিত্যিক- গবেষকরা বেড়াতে আসতেন। শিক্ষার্থীরা তাঁদের সাথে সকলে মিলে সৌজন্য সাক্ষাৎকার বা আনন্দমিলন অনুষ্ঠানে মিলিত হত। আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিকভাবে মত বিনিময়ের মাঝে সাহিত্য বা গবেষণা জগতের নানারকম জ্ঞানের ভান্ডারের দেখা পেত। আশরাফ সিদ্দিকী দেখা পেয়েছেন এরকম বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের মধ্যে অন্যতম হলেন – ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়, কবি নরেন্দ্র দেব, ক্ষিতিমোহন সেন, সৈয়দ মুজতবা আলী, কবি জসীম উদদীন, সাগরময় ঘোষ প্রমুখ।
আশরাফ সিদ্দিকীর স্মৃতিচারণমূলক এই গ্রন্থের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হল তার শিক্ষকদের পাঠানো চিঠির বিষয়টি। শান্তিনিকেতনের শিক্ষক কিংবা অধ্যক্ষ সবার সাথে তাঁর চিঠির বিনিময় হত। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরও চিঠি বিনিময় বন্ধ হয়ে যায়নি। শান্তিনিকেতনের শিক্ষকরা ছাত্রদের সাথে মত বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে চিঠিকে খুব প্রাধান্য দিতেন।
লেখক তাঁর বইতে এরকম বেশ কিছু চিঠি প্রকাশ করেছেন। চিঠিগুলি পাঠ করে আমরা জানতে পারি শিক্ষকরা ছাত্রদেরকে কতটাই না ভালোবাসতেন, স্নেহ করতেন। ছাত্রদের ব্যক্তিজীবনের সুখ-দুঃখকে তারা নিজেদের জীবনে যেভাবে জড়িয়ে নিতেন, তা এই বই না পড়লে জানা হত না।
বইটি প্রণয়নের ক্ষেত্রে অনুসৃত পদ্ধতিঃ
ডক্টর আশরাফ সিদ্দিকী তাঁর "রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন" বইটিকে মোট ২৬টি খণ্ডে ভাগ করেছেন। কিন্তু কোন অংশের নামকরণ করেননি। সংখ্যাবাচক ক্রম ব্যবহার করে তিনি পর্বগুলোকে বিন্যস্ত করেছেন। আসলে আত্মস্মৃতিমূলক এই রচনাগুলি ১৯৪৫ থেকে শুরু করে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন পত্রিকায় কখনও নিয়মিত কখনও অনিয়মিতভাবে প্রকাশিত হয়েছে। বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে লেখা রচনাগুলো একত্র করে আলোচ্য গ্রন্থের প্রকাশ। ফলে কোন আলাদা নামকরণের প্রয়োজনীয়তা লেখক অনুভব করেননি। কিন্তু আমি মনে করি প্রতিটি পর্বের আলাদা আলাদা শিরোনাম থাকলে বুঝতে ও আলোচনা করতে সুবিধা হত। যাহোক, পর্বগুলোর বিষয় সংক্ষেপে নিম্নে উল্লেখ করছিঃ-
- পর্ব- ০১ = লেখকের শান্তিনিকেতনে আগমন এবং কয়েকদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পরিভ্রমণ।
- পর্ব- ০২ = ছায়া সুনিবিড় শান্তিনিকেতনের পরিবেশ বর্ণনা।
- প্রখ্যাত লেখক-গাল্পিক ও ঔপন্যাসিক তারাশঙ্করের শান্তিনিকেতনে আগমন ও তাঁর সঙ্গে লেখকের ও অন্যান্যদের আলাপচারিতা।
- পর্ব- ০৩ = শান্তিনিকেতনের শিক্ষাপরিবেশের বর্ণনা। কোপাই নদীতে বন্যার আগমন, দল বেঁধে নদীভ্রমণ। শান্তিনিকেতনের লাইব্রেরির বিস্তৃত বর্ণনা।
- পর্ব- ০৪ = শান্তিনিকেতনের বিভিন্ন উৎসব। বিশেষ করে বৃক্ষরোপন উৎসবে লেখকের সক্রিয় অংশগ্রহণ।
- পর্ব- ০৫ = বৃক্ষরোপন উৎসব শেষে আনন্দ অনুষ্ঠান।
- পর্ব- ০৬ = খেলাধুলার পরিবেশ। একটি ফুটবল ম্যাচের মনোজ্ঞ বর্ণনা।
- পর্ব- ০৭ = শান্তিনিকেতনের পৌষ উৎসব।
- পর্ব- ০৮ = পৌষমেলা ও বাউল উৎসব। লেখক ও তাঁর বন্ধুদের একদিনের জন্য বাউল হয়ে যাওয়া।
- পর্ব- ০৯ = ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক। পৌষমেলা শেষে বাৎসরিক ভ্রমণসূচী অনুযায়ী পুরী ভ্রমণ।
- পর্ব- ১০ = এই পর্বটি সবচেয়ে বড়। ৫৬ থেকে ৯৫ পৃষ্ঠা পর্যন্ত এর ব্যপ্তি। এই পর্বে শান্তিনিকেতনের শিক্ষকদের কাছ থেকে যেসব চিঠি লেখক আশরাফ সিদ্দিকী পেয়েছেন, সেসব চিঠির উল্লেখযোগ্য অংশসহ লেখকের অনুভূতি- ভাবনা বর্ণিত হয়েছে।
- পর্ব- ১১ = বাইশে শ্রাবণ উদযাপন।
- পর্ব- ১২ = এই পর্বের নাম লেখক রচনা অংশে লিখেছেন। নাম - “একটি কবিতা রচনার অক্ষমতা"।
- পর্ব- ১৩ = “আনন্দবাজার" উৎসব পালন ও অংশগ্রহণ।
- পর্ব- ১৪ = শান্তিনিকেতনের ক্যাফেটেরিয়া সম্পর্কে আলোচনা।
- পর্ব- ১৫ = শান্তিনিকেতনের ছাত্র-শিক্ষকদের সাহিত্য সংস্থা "সাহিত্যিকা"- এর সভায় কবিতাপাঠ।
- পর্ব- ১৬ = ভোজনশালার অন্যতম কর্ত্রী 'সরোজিনী দেবী'র স্মৃতিচারণ।
- পর্ব- ১৭ = শান্তিনিকেতনের স্কুলে পড়া ছোট মেয়েদের সাথে লেখকের সুমধুর সম্পর্কের বর্ণনা।
- পর্ব- ১৮ = এক বৈষ্ণব প্রেমের করুণ পরিণতি।
- পর্ব- ১৯ = শান্তিনিকেতনে মহাত্মা গান্ধীর আগমন।
- পর্ব- ২০ = সৈয়দ মুজতবা আলী প্রসঙ্গ।
- পর্ব- ২১ = রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিজীবনের কিছু মজার গল্প।
- পর্ব- ২২ = 'হলকর্ষণ' উৎসব। পল্লীপুনর্গঠন প্রচেষ্টা।
- পর্ব- ২৩ = রবীন্দ্রভৃত্য 'বনমালী' সম্পর্কে আলোচনা।
- পর্ব- ২৪ = রবীন্দ্রনাথের 'পাগলা ফাইল'।
- পর্ব- ২৫ = রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিজীবনের আরও কিছু মজার ঘটনা।
- পর্ব- ২৬ = শান্তিনিকেতন থেকে বিদায় নেবার পরও আবার সেখানে ভ্রমণ। স্মৃতিচারণ।
সংক্ষিপ্তাকারে মূল বিষয়বস্তুঃ
লেখক আশরাফ সিদ্দিকী যখন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন, তখন খেয়ালের বসে নববর্ষ উপলক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে চিঠি লিখেছিলেন শুভেচ্ছা জানিয়ে। রবীন্দ্রনাথ এর উত্তর স্বহস্তে লিখে আশীর্বাণী পাঠিয়েছিলেন।
সেই থেকে লেখকের ইচ্ছা ছিল শান্তিনিকেতনে পড়ার। ১৯৪৫-৪৬ এর সেশনে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হবার সুযোগ পেলেন। এই সময়কালে তাঁর যা অভিজ্ঞতা হয়েছে, তার বর্ণনাই আলোচ্য গ্রন্থের মূল উপজীব্য। আত্মজীবনীর ঢঙে লেখা রচনাগুলিতে শান্তিনিকেতনের শিক্ষকদের সাথে ছাত্রের সম্পর্ক, শান্তিনিকেতনের অবকাঠামোগত বর্ণনা, পরিপার্শ্ব, আশেপাশের গ্রামজীবনের বর্ণনা, কোপাই নদী, বিভিন্ন অনুষ্ঠান, ভ্রমণকাহিনী, খেলাধুলা ইত্যাদির অভিজ্ঞতা গ্রন্থের প্রাণ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যক্তিজীবনে ঘটে যাওয়া কিছু মজার ঘটনা, তাঁর কাছে লেখা মানুষদের আবেগপ্রবণ চিঠি ও লেখকের কাছে শান্তিনিকেতনের অধ্যাপকদের লেখা চিঠিগুলোও গ্রন্থের আলোচ্য বিষয়। রবীন্দ্রনাথের ভৃত্য ও শান্তিনিকেতনের কর্মীরাও লেখকের রচনার বিষয় হিসেবে যথেষ্ট মনোযোগ পেয়েছেন। শান্তিনিকেতন থেকে পাঠশেষে চলে আসার পর লেখক একাধিকবার সেখানে ভ্রমণে গিয়েছেন। সে সম্পর্কিত অভিজ্ঞতাও লেখক মুক্তচিত্তে বর্ণনা করেছেন।
এক কথায় বলা যায় বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক কিশোর বালক শান্তিনিকেতনে পড়তে গিয়ে তার অবারিত আনন্দমুখর পরিবেশ দেখে কিরকম বিস্ময়াভিভূত হয়ে পরেছিল- এই বইটি তার একটি প্রামান্য দলিল।
সার্বিক আলোচনাঃ
লেখক শৈশব থেকে বাংলাদেশের এক গ্রামে বাস করে কৈশোরকে স্পর্শ করেছেন। শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা করেবন এমন স্বপ্ন কখনও দেখেননি। কৈশোরের দুরন্ত সময়ে মনের খেয়ালে একদিন নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে চিঠি লিখেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। কিশোর ভক্তের চিঠির উত্তর রবীন্দ্রনাথ দিয়েছিলেন স্বহস্তে লিখে। এই চিঠিখানি কিশোর আশরাফ সিদ্দিকীর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তিনি স্বপ্ন দেখেন শান্তিনিকেতনে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করার। আগ্রহ জানিয়ে অধ্যক্ষকে চিঠি লেখেন। অধ্যক্ষ তাঁকে উৎসাহিত করে। ফলে অভিভাবকের উৎকণ্ঠাকে অগ্রাহ্য করে ১৯৪৫ সালের ৩ জুলাই তারিখে লেখক শান্তিনিকেতনের মাটিতে পা রাখেন। প্রবেশ করেন এক অভূতপূর্ব ভালোবাসাময় মায়াবী শিক্ষাঙ্গনে।
শান্তিনিকেতনের ছাত্রজীবনে শিক্ষকদের কাছ থেকে লেখক যে ব্যবহার পেয়েছেন, তা ছিল অকল্পনীয়। শিক্ষকেরা প্রচলিত অর্থে মাস্টারি করতেন না। ছাত্রদের সাথে ছিল তাদের বন্ধুর মতো গভীর ও আন্তরিক সম্পর্ক। শিক্ষকেরা গাছতলায় ক্লাশ নিতেন। প্রকৃতির অবারিত বাতাস, পাখির কলকাকলী, ঝরা পাতার মর্মর, সবুজ ঘাসের গালিচা, বাগানের রঙিন ফুল, ফুলের উপর নেচে চলা প্রজাপতি অর্থাৎ সবমিলে এক মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ তাদের ক্লাশের সঙ্গী ছিল। উপভোগ্য জীবনযাত্রায় লেখকের ছাত্রজীবন আনন্দে উচ্ছ্বলতায় কখন কেটে গেছে তা তিনি বুঝতেই পারেননি। আলোচ্য বইটির পাতায় পাতায় শান্তিনিকেতনের পরিপার্শ্ব বর্ণনায় লেখকের মুগ্ধ দৃষ্টিভঙ্গী সহজেই দৃষ্টিগোচর হয়। লেখকের স্মৃতিকাতরতা আমাদেরকেও স্পর্শ করে।
শান্তিনিকেতনে থাকাকালীন লেখক বিভিন্নরকম বাঙালি উৎসবের সাথে পরিচিত হয়েছেন। ঋতুবন্দনা, বৃক্ষরোপন, আনন্দমেলা, পৌষউৎসব, বসন্তউৎসব ইত্যাদি অনুষ্ঠান তাঁর কাছে অপরিচিত ছিল। কৃষির উন্নয়ন করতে আগ্রহী রবীন্দ্রনাথ প্রচলন করেছেন হলকর্ষণ উৎসবের। পাশ্বর্বর্তী কোপাই নদীতে বন্যা আসতো হঠাৎ করে। লেখকেরা সবান্ধবে সেখানে বেড়াতে যেতেন। পার্শ্ববর্তী সাঁওতাল গ্রামের সাঁওতালরা শান্তিনিকেতনে অবাধে যাতায়াত করত। সাঁওতাল জীবনের অভ্যন্তরভাগ তাই লেখকের নিকট অপরিচিত থাকেনি।
শান্তিনিকেতনে বিভিন্ন প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব বেড়াতে আসতেন। মহাত্মা গান্ধী, তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়, জসীম উদদীন, সৈয়দ মুজতবা আলী প্রমুখের জ্ঞানালোকে লেখক নিজেকে আলোকিত করতে পেরেছেন।
রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত জীবনের মজার ঘটনাগুলি যা কখনও গ্রন্থবদ্ধ হয়নি, তা লেখক জেনেছেন শান্তিনিকেতন থেকেই।
রবীন্দ্রনাথের ভৃত্য বনমালীর সাথে অনেক সময় একসাথে কাটিয়ে তার প্রভুপ্রেমের গভীরতা লেখক বুঝতে পেরেছেন।
বস্তুতঃ শান্তিনিকেতন আর রবীন্দ্রনাথ লেখককে, তার মানসলোককে যেভাবে সমৃদ্ধ করেছেন, তাই এই বইটির মূল বিষয়।
উপসংহারঃ
তুলনামূলক আলোচনাঃ
শান্তিনিকেতন নিয়ে আর একটি বই আমার পড়া হয়েছে। নওগাঁ নিবাসী, 'অঞ্জলী লহ মোর' পত্রিকার সম্পাদক 'জাহিদ আনোয়ার' বৎসরে একবার না একবার ভারতে যাবেনই। বইমেলায় বই বিক্রি, কোনো সাহিত্যসভায় অংশগ্রহণ; একটা না একটা কারণ থাকতোই। এরকমভাবে ভারত ভ্রমণকালীন তিনি একবার শান্তিনিকেতনে বেড়াতে যান। যা দেখেছেন, যে অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন তার সারাৎসার দিয়ে লিখেছেন "গুরুদেবের আশ্রমে"। মূলত এটা একটি ভ্রমণকাহিনী। বিপরীতে আশরাফ সিদ্দিকীর বইটি আত্মকথামূলক স্মৃতিচারণের বই। জাহিদ আনোয়ারের ভাষাশৈলী ভিন্নরকম, বর্ণনাভঙ্গীতেও নিজস্বতা আছে। তিনি সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে ভ্রমণ করতে করতে যা দেখেছেন, যা বুঝেছেন তাই গ্রন্থভুক্ত করেছেন। কিন্তু আশরাফ সিদ্দিকী শান্তিনিকেতনে বছরের পর বছর বাস করে যে অভিজ্ঞান লাভ করেছেন, যা আত্মস্থ করেছেন, মর্মে যা গেঁথে নিয়েছেন, তাই প্রকাশ করেছেন তার "রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন" বইটিতে।
বইটি পাঠ করে যে জ্ঞান অর্জন করলামঃ
বর্তমান কালের নীতিহীন শিক্ষাব্যবস্থার দারিদ্র্য দূরীকরণে বইটি একটি আলোকবর্তিকা হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। পাঠদানের পদ্ধতি, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক, সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা, প্রকৃতির প্রতি দায়বোধ ইত্যাদি বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাবনার সাথে পরিচিত হওয়া গেল। প্রাচীনকালের ভারতবর্ষের নিজস্ব শিক্ষাকেন্দ্র আশ্রম ধারণাটির সাথে আধুনিক শিক্ষাদর্শনের যে সমন্বয় তিনি শান্তিনিকেতনে ঘটিয়েছেন, তার প্রয়োগ যদি একালের শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থার সাথে মেলানো যায়, তাহলে তা আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতি জীবনকে আরও সমৃদ্ধ করবে বলেই আমার বিশ্বাস।
বইটিতে লেখকের বিরল সাহিত্য প্রতিভার স্পর্শে শান্তিনিকেতনে অবস্থানকালীন সময়গুলির চিত্র একেবারে স্পষ্ট। লেখকের সাবলীল বর্ণনা, ঘটনা পরম্পরা আমাদেরকে সেকালের শান্তিনিকেতনের মায়াবী গাছতলায় নিয়ে যায়। শব্দ দিয়ে চিত্র তৈরিতে লেখক কতটা সিদ্ধহস্ত, তা বইটি পাঠ করাকালীন সময়েই অনুধাবন করা যায়। শুধু কবিতা নয়, গদ্য রচনাতেও যে লেখকের মুন্সিয়ানা রয়েছে তা বইটির মনোযোগী পাঠকমাত্রই স্বীকার করবেন। আর এজন্যে বোধহয় বিশ্বভারতীর সাবেক উপাচার্যসহ অনেকে "রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন" বইটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে মন্তব্য করেছেন-
“এ গ্রন্থে ৪০ দশকের কবিতীর্থ শান্তিনিকেতনের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও জীবন সম্পর্কে একটি সুষিত চিত্র ফুটে উঠেছে।"
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম