মোঃ সাইদুর রহমান
গ্রন্থাগারিক
কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ কুড়িগ্রাম।
জ্ঞানের ইচ্ছা মানুষের একটি আদিম আকাঙ্ক্ষা। আর গ্রন্থাগার গড়ে ওঠার মূলে মানুষের এই আকাঙ্ক্ষা অন্যতম ভূমিকা পালন করেছে এতে সন্দেহ নেই। মাটির ট্যালি, গাছের ছাল, প্যাপিরাস ইত্যাদিতে বিভিন্ন সময়ের পণ্ডিতদের লিখিত পুঁথি ও পুস্তকের সংগ্রহকে সংরক্ষণ করার প্রয়োজনেই ধীরে ধীরে বহুল ঘটনার প্রবাহে গ্রন্থাগার রূপ লাভ করেছে।
প্রাচীন আসুরবনিপাল গ্রন্থাগার (৬৬৮-৬২৭ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) থেকে শুরু করে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার (৪২৭-১১৯৩ খ্রি.), বর্তমান যুগের দি লাইব্রেরি অব কংগ্রেস-এ (১৮০০খ্রিষ্টাব্দ) যে সংগ্রহ গড়ে উঠেছে তা মূলত জ্ঞান-পিপাসু মানুষের আকাঙ্খা ও ইচ্ছার ফসল।
আধুনিক পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গ্রন্থাগার আমেরিকার ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত ”লাইব্রেরি অব কংগ্রেস” -এ রয়েছে ৩ কোটি ২০ লাখ বইয়ের বিশাল সংগ্রহ। লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়াম লাইব্রেরিও একটি পৃথিবী বিখ্যাত লাইব্রেরি। ”বডিলন লাইব্রেরি” তে রয়েছে ১ কোটির বেশি সংগ্রহ। এছাড়াও ফ্রান্সের বিবলিথিক ন্যাশনালি লাইব্রেরি, মস্কোর লেলিন লাইব্রেরি ও কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরি উল্লেখযোগ্য। মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরিও পৃথিবীর প্রাচীন লাইব্রেরির মধ্যে অন্যতম। যা একসময় পৃথিরীর সপ্তাশ্চর্যের মধ্যেও ছিল।
বাংলাদেশের জাতীয় গণগ্রন্থাগার (১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দ) ও জাতীয় গ্রন্থাগার (১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দ) প্রতিষ্ঠার মূলে রয়েছে এদেশের কবি, সাহিত্যিক ও লেখকদের জ্ঞানলব্ধ ধারণার সংগ্রহ গড়ে তোলার আকাঙ্ক্ষা।
গ্রন্থাগার বা প্রকৃত অর্থে পাঠাগার হলো বই, পুস্তক ও অন্যান্য তথ্য সামগ্রীর একটি সংগ্রহশালা। যেখানে পাঠক গ্রন্থ পাঠ, গবেষণা ও তথ্যানুসন্ধান করতে পারে। বাংলা গ্রন্থাগার শব্দটির সন্ধি বিচ্ছেদ করলে ”গ্রন্থ + আগার” পাওয়া যায়। অর্থাৎ গ্রন্থাগার হলো গ্রন্থসজ্জিত পাঠ করার আগার বা স্থান।
Wikipedia লাইব্রেরিকে সংজ্ঞায়িত করেছে- A library is a collection of sources of information and similar resources, made accessible to a defined community for reference or borrowing. It provides physical or digital access to material, and may be a physical building or room, or a virtual space, or both.
গ্রন্থাগার হলো জ্ঞানের এমন এক সমুদ্র যেখানে বিচরণ করে প্রতিটি মানুষ উন্নত মননের অধিকারী হতে পারে। আর তাই গ্রন্থাগারকে তুলনা করা হয় শব্দহীন মহাসমুদ্রের সাথে। এটি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের মাঝে সেতুবন্ধনের এক নীরব সাক্ষী।
গ্রন্থাগারিক হচ্ছেন সেই ব্যক্তি যিনি গ্রন্থাগারে আগত পাঠকের চাহিদা অনুযায়ী পাঠ্যসামগ্রীর সংস্থান করা, সংগ্রহ করা, প্রক্রিয়াকরণ ও সেবাদান করা এবং গ্রন্থাগারের সার্বিক ব্যবস্থাপনার সাথে ওতপ্রতোভাবে জড়িত থাকেন।
Wikipedia অনুযায়ী – A librarian is a person who works professionally in a library, providing access to information and sometimes social or technical programming. In addition, librarians provide instruction on information or information literacy.
গ্রন্থাগারিকের দায়িত্ব, কর্তব্য ও গুণাবলীর মধ্যে পাঠক বা ব্যবহারকারীর প্রতি সুনির্দিষ্ট সমান দৃষ্টি দেয়া, সময়মতো পাঠক চাহিদা মেটানো, প্রত্যেক পুস্তক ও তথ্য সম্পদের মধ্যে দৃষ্টি দেয়া, পেশার প্রতি দায়িত্বশীল, সহকর্মীদের প্রতি সুদৃষ্টি স্থাপন, কৌশলী, পরিশ্রমী ও বিভিন্ন ধরনের বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান থাকা ও পাঠকের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেয়ার ক্ষমতা থাকা।
গ্রন্থাগারের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলোঃ
- আজীবনকাল বিশ্বজনীন শিক্ষায় সহায়তা।
- মানুষের লব্ধ যাবতীয় জ্ঞান ও সংস্কৃতির অনুধাবনে সকলকে সামর্থ করে তোলা।
- শ্রান্তির নিরসন ও চিত্ত বিনোদনকল্পে বই ও অন্যান্য মাধ্যমে মানসিক উৎকর্ষ সাধন করা।
- ছাত্র-ছাত্রীদের পূর্ণাঙ্গ সহযোগিতা করা।
- কারিগরি, বৈজ্ঞানিক এবং সমাজবিজ্ঞান ইত্যাদির সর্বাধুনিক তথ্য পরিবেশন করা।
গ্রন্থাগার মূলত ব্যবহারকারীর বিশেষ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে ভিত্তি করে এবং বিশেষ ব্যবহারকারী গোষ্ঠিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। যেমনঃ
- জাতীয় গ্রন্থাগার
- গণগ্রন্থাগার
- বিশেষ গ্রন্থাগার
- শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা একাডেমিক গ্রন্থাগার
- ব্যক্তিগত গ্রন্থাগার
গণগ্রন্থাগার তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিতরণ, শিক্ষায় সহায়তা প্রদান, পুস্তক লেনদেন, পাঠাভ্যাস সৃষ্টি, বয়স্ক শিক্ষা, সেমিনার- সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করে, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে, বেসরকারি গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠায় সহযোগতিা প্রদান এবং ভ্রাম্যমান গ্রন্থাগারের কার্যক্রম ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করে।
বিশেষ গ্রন্থাগার মূল প্রতিষ্ঠানের গবেষক ও সদস্যদের প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করে যাতে স্বল্প সময়ে সুনির্দিষ্ট বিষয়ে তাৎপর্যপূর্ণ উন্নতি সাধন করতে পারে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গ্রন্থাগারকে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের হৃদপিন্ড বলে অভিহিত করা হয়। তাই গ্রন্থাগার ছাড়া কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চলতে পারে না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গ্রন্থাগার আবার নিম্নরূপঃ
- বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার
- মহাবিদ্যালয়/সিনিয়র মাদ্রাসা গ্রন্থাগার
- স্কুল/ জুনিয়র মাদ্রাসা গ্রন্থাগার
আধুনিক তথ্য প্রবাহের যুগে পূর্বের ধ্যানধারণা থেকে বেরিয়ে এসে কম্পিউটার এবং আধুনিক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি যেমন ইন্টারনেট ও ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব (WWW) প্রযুক্তির মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের একাডেমিক ও গবেষণার কাজ করা যাচ্ছে সহজে। আধুনিক লাইব্রেরির ধারণার মধ্যে ডিজিটাল লাইব্রেরি ও ভার্চুয়াল লাইব্রেরির ধারণা প্রসঙ্গক্রমে চলে আসে।
লাইব্রেরি বলতে আমরা সাধারণত বুঝি এমন একটি স্থান যেখানে মুদ্রিত বই, সাময়িকী, বিভিন্ন ধরনের শ্রবণ-দর্শন সামগ্রীকে নিময়তান্ত্রিক উপায়ে সংরক্ষণ করে পাঠকের ব্যবহার উপযোগী করে রাখা হয়। অপরদিকে ডিজিটাল লাইব্রেরি বলতে বোঝায় ইলেকট্রনিক মাধ্যমে একত্রে সংগঠিত ইন্টারনেট ও সিডি-রম ডিস্কের সহায়তায় সহজলভ্য উপকরণসমূহের সমষ্টি। অর্থাৎ ইন্টারনেটের মাধ্যমে তথ্যের উৎসসমূহে প্রবেশ ডিজিটাল লাইব্রেরির মূল উপাদান।
A digital library is a special library with a collection of digital objects that can include text, audio material, visual material stored as electronic media formats (as opposed to print or other media)
ডিজিটাল লাইব্রেরি ব্যবহারের মাধ্যমে পাঠক অনলাইনের মাধ্যমে বই ও জার্নাল সমূহে প্রবেশ ও সাবস্ক্রিপশন করতে পারে, ওয়েব সাইট এবং ডাটাবেইস হ্যান্ডলিং করতে পারে, প্রচলিত লাইব্রেরির তুলনায় ডিজিটাল লাইব্রেরিতে ইন্টারনেটের মাধ্যমে লাইব্রেরি সার্ভিস খরচ তুলনামূলকভাবে অনেক কম হয়, তাই লাইব্রেরি সংগ্রহ বৃদ্ধি করা সহজ। লাইব্রেরি ক্যাটালগসমূহ অনলাইনে অনুসন্ধান করা যায়। ইন্টারনেটের মাধ্যমে রিসোর্স শেয়ার করা যায়।
ভার্চুয়াল লাইব্রেরি হচ্ছে- A collection of resources available on one or more computer systems, where a single interface or entry point to the collection is provided.
ভার্চুয়াল লাইব্রেরি ব্যবহারের মাধ্যমে সময় ও অর্থের অপচয় রোধ করে লাইব্রেরির সংগ্রহ বাড়ানো এবং বিশ্বের যেকোন ধরনের তথ্য নিমিষেই হাতের নাগালে পাওয়া সম্ভব। এটি হচ্ছে কোন স্থান ছাড়া বিশাল একটি সংগ্রহ ভান্ডার।
বর্তমান বিশ্ব ডিজিটাল ও ভার্চুয়াল লাইব্রেরির যুগে প্রবলভাবে প্রবেশ করেছে। উন্নত বিশ্বের ন্যায় আমাদের দেশ ডিজিটাল ও ভার্চুয়াল লাইব্রেরির যুগে প্রবেশ করলেও দক্ষ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লাইব্রেরিয়ানের অভাবে সঠিকভাবে সেবাদানে ব্যর্থ হচ্ছে। তাছাড়া লাইব্রেরি ব্যবহারকারীরাও এগুলো ব্যবহারে দক্ষ নয়। তাই লাইব্রেরিয়ান ও ব্যবহারকারীদের প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বৃদ্ধি করে এগুলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার সম্ভব।
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম