যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি
প্রকাশক: ভূর্জপত্র, কলকাতা
প্রথম প্রকাশ: ১৩২০-২২ বঙ্গাব্দ
পুনঃপ্রকাশ: দোলযাত্রা, ১৩৯৭ বঙ্গাব্দ
মূল্য: ৩০০ টাকা
পৃষ্ঠা: ৯৭৯
বিংশ শতকের সূচনাংশে আধুনিক বাংলা ভাষায় লিখিত মানসম্পন্ন অভিধানের সংখ্যা কম ছিল। বস্তুত সেই সময়টাই ছিল ভাষা গঠনের, শিল্প-সংস্কৃতি-বোধ নির্মাণের। ইউরোপীয় নবজাগরণের প্রভাবে ভারতবর্ষেও নবআলোকের উত্তাপ অনুভূত হচ্ছিল। আর এর প্রতিক্রিয়া স্পষ্টরূপে প্রত্যক্ষ হয়েছিল বাংলাভাষী অঞ্চলে। ফলে নিত্য নতুন সাংস্কৃতিক-সামাজিক পরিবর্তনের পাশাপাশি ভাষা ও সাহিত্যেও লেগেছিল বিনির্মাণের উৎসাহ। এই প্রতিক্রিয়ায় ভাষা-সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষেরা নিজেদের প্রতিভার সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটাতে সচেষ্ট ছিলেন।
রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী মনে করতেন 'অপুর্ব্ববস্তুনির্মাণক্ষমাপ্রজ্ঞা' হল প্রতিভা আর বিচিত্র বিষয় বিচারের দক্ষতা হল 'পাণ্ডিত্য'। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর সংজ্ঞাকে মান্য করে বলা যায় আচার্য যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি (১৮৫৯-১৯৫৬) ছিলেন পণ্ডিতদের মধ্যে অন্যতম। প্রকৃতি ও মানবরচিত ইতিহাসের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে তিনি সুবিস্তৃত ও সুগভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন।
প্রকাশক তার ভাষ্যে জানান-
আয়ুর্বেদ, ইতিহাস, উদ্ভিদবিদ্যা, জ্যোতির্বিজ্ঞান, দর্শন, পুরাণ, প্রাণীতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব, রসায়ন, সমাজতত্ত্ব, সামুদ্রিক বিদ্যা, উৎসব-পার্বণ-লোকাচার:মানবিক সভ্যতায় বিজ্ঞান ও বিশ্বাস- এই দুই মেরুর মধ্যে বিদ্যার বিস্তৃত বিশ্ব ছিল তাঁর নখদর্পণে। বিশেষায়নের আগের যুগের ভাবুক তিনি। বিচিত্র বিদ্যায় তাঁর পারঙ্গমতা একদিকে যেমন তাঁর দৃষ্টিতে এনেছিল এক বিশ্বকোষী সমগ্রতা, অন্যদিকে সে-জ্ঞানের অন্যোন্য সংশ্লেষ দিয়েছিল আশ্চর্য এক বিশ্লেষণী গভীরতা। এক বিদ্যার চর্চায় অন্য বিদ্যার প্রয়োগপদ্ধতি ব্যবহারে কোন শুচিবায়ু ছিল না তারঁ; আর এই চিন্তাসঞ্চার থেকে তৈরি হয়েছিল তাঁর মেধার অনন্যতা।
শতাধিক বৎসর আগে যে কটি বাংলা ভাষার অভিধান প্রকাশিত হয়েছিল, তার মধ্যে যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি'র এই অভিধানটি অন্যতম। অন্যান্য অভিধানগুলোতে বাংলা শব্দের সাথে অনেকাংশেই সংস্কৃত শব্দকে গুলিয়ে ফেলা হচ্ছিল। অর্থাৎ কথোপকথনে ব্যবহৃত অপ্রচলিত সংস্কৃত শব্দগুলোকেও বাংলা শব্দ মনে করে অভিধানে স্থান দেয়া হচ্ছিল। যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি মনে করেন সংস্কৃত শব্দের জন্য রয়েছে সংস্কৃত শব্দকোষ। কিন্তু বাংলা ভাষায় আত্মীকৃত হয়ে যে সকল শব্দের অর্থান্তর ঘটেছে, সেগুলো অন্তত বাংলা শব্দ হিসেবে বাংলা ভাষার অভিধানে স্থান পাওয়ার যোগ্য।
সেইসময় অভিধান রচনার সময় বর্ণবিন্যাসরীতি নিয়ে সমস্যা ছিল। পণ্ডিতগণ নিজ নিজ ভাবনা ও ইচ্ছানুযায়ী বাংলা বর্ণগুলোকে সাজাতেন। তিনি নির্দিষ্ট করে বলেছেন-
ক- কারের শেষে ক্ষ- কারের স্থান যুক্তিসিদ্ধ।
শব্দের উৎস নিয়ে সেকালেও পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ ছিল। বাংলা ভাষায় আগত সংস্কৃত, ইংরেজি, ফারসি, আরবি (অভিধানে বানান ফার্সি, আর্বী লেখা হয়েছে) শব্দ নিয়ে মতভেদ ছিল না। কিন্তু কোনটা দেশী (লেখকের ভাষায় 'দেশজ') শব্দ তা নিয়ে যোগেশচন্দ্র রায় এর দ্বিধা ছিল। তাই তিনি শব্দের উৎপত্তি নির্দেশ করতে গিয়ে কোথাও 'দেশজ' বুৎপত্তি উল্লেখ করেন নি। তবে কখনও কখনও তিনি বিভ্রান্তি দূর করতে ওড়িয়া, হিন্দী, মারাঠী শব্দের উল্লেখ করেছেন।
যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি সংকলিত বাঙ্গালা শব্দকোষ অভিধানটি সেকালে কতটা জনপ্রিয় হয়েছিল বা লেখক-সাহিত্যিক-পণ্ডিত ও সাধারণ মানুষের কাছে কতটা গ্রহণীয় হয়েছিল সে বিষয়ক কোন বিবৃতি এখন আর সহজলভ্য নয়। তবে এই অভিধানটি বাংলা ভাষা ও বাংলা শব্দভাণ্ডার বিনির্মাণে অবদান যে রেখেছিল তা অনস্বীকার্য।
সেকালে প্রচলিত কিন্তু বর্তমানে অপ্রচলিত এমন শব্দের অর্থ জানতে যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি সংকলিত বাঙ্গালা শব্দকোষ বইটি কৌতুহলী পাঠকের তৃষ্ণা মেটাবে। প্রত্যেকটা শব্দের পাশে শব্দের মূল উৎস উল্লেখ করা আছে। সংস্কৃত, ইংরেজি, আরবি, ফারসি, ওড়িয়া, হিন্দি ভাষা থেকে কোন শব্দ বাংলায় আত্মস্থ হয়েছে তা সহজে বোঝা যায়। শব্দার্থ লিখতে গিয়ে কখনও কখনও একাধিক সমার্থকশব্দ ও বিস্তৃত বিবরণ দেয়া হয়েছে; বিভিন্ন শব্দের পাশে কবিতা-ছড়ার লাইন উল্লেখ করা হয়েছে। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করে পাঠকের আগ্রহকে তৃপ্ত করার বিশেষ চেষ্টাও লক্ষ্যনীয়।
শব্দার্থসন্ধানী উৎসাহী পাঠক যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি সংকলিত বাঙ্গালা শব্দকোষ বইটি হাতে নিয়ে আনন্দিত ও কৌতুহলী হয়ে উঠবেন। পুরনো বাংলা শব্দের অর্থ, বুৎপত্তি, সমার্থকশব্দ খুঁজতে গিয়ে বৈচিত্র্যময় শব্দসম্ভারের ভীড়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে দ্বিধা করবেন না।
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম