মস্তিষ্ক, ঘুম ও স্বপ্ন
আরাফাত রহমান
প্রকাশকঃ প্রকৃতি পরিচয়, ঢাকা।প্রচ্ছদঃ সব্যসাচী হাজরা
প্রথম প্রকাশঃ ২০১৫
দ্বিতীয় প্রকাশঃ ২০১৮
পৃষ্ঠাসংখ্যাঃ ৮৬
মূল্যঃ ১৩০.০০ টাকা
ISBN: 9789848882542
মানুষের জীবনের যাবতীয় জ্ঞান ও আবেগের উৎসস্থল হল মস্তিষ্ক। মানুষ তার চিন্তা ও অনুভূতির সংরক্ষণাগার হিসেবেও মস্তিষ্ককে ব্যবহার করে। মস্তিষ্কের আধুনিক গঠন ছাড়া মানুষের মানবীয় গুণাবলী এবং বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতা অর্জন করা সম্ভব হত না। আর চিন্তাগত শৈলী এবং মৌল অনুভূতিসমূহ বিনির্মানে ঘুম ও স্বপ্ন এক অন্যতম ভূমিকা পালন করে।
মানব জীবনে ঘুম হল এক অপরিহার্য দৈহিক অবস্থা। সমগ্র জীবনের তিনভাগের এক ভাগ সময় আমরা ঘুমিয়ে কাটাই। ঘুমের মধ্যে আমরা স্বপ্ন দেখি। স্বপ্নে এমন সব কল্পনাচিত্রের বাস্তবায়ন ঘটে, যা জাগ্রত অবস্থায় আমাদের চিন্তাজগতকে আলোড়িত করে তোলে।
“মস্তিষ্ক, ঘুম ও স্বপ্ন” বইয়ের প্রধান আলোচ্য বিষয় তার নামকরণেই স্পষ্ট। সূচীপত্রেও আলোচ্য বিষয়গুলিকে শুধু শিরোনাম দিয়ে উল্লেখ করা হয়েছেঃ
- প্রথম অধ্যায়ঃ মস্তিষ্ক
- দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ ঘুম
- তৃতীয় অধ্যায়ঃ স্বপ্ন
বিজ্ঞানলেখক আরাফাত রহমান প্রথম অধ্যায়ে 'মস্তিষ্ক' সম্পর্কে বিভিন্ন উপশিরোনামের অধীনে বেশ তথ্যবহুল আলোচনা করেছেন। মস্তিষ্ক বলতে আসলে মগজকেই বোঝানো হয়। বিবর্তনের ধারায় লক্ষ বছর ধরে মানুষের মগজ তৈরি হয়েছে। তিনটি সময়কালে বিকশিত হওয়া মগজ তিন স্তরে বিভক্ত। ১৯৬০ এর দশকে পল ম্যাকলিন Triune brain বা 'একের মধ্যে তিন মস্তিষ্ক' মডেল প্রস্তাব করেছিলেন। এই মডেল অনুযায়ী স্নায়ুরজ্জুর সাথে মেরুদণ্ডের ঠিক উপরে একটি স্তর, তার উপরে মাঝখানে একটি স্তর ও সবার উপরে রয়েছে আর এক স্তরের বৃহত্তর আকারের মগজ। মেরুদণ্ডের উপরে সুষুম্নাকাণ্ডের সাথে সংযুক্ত সবচেয়ে নীচের স্তরটির নাম ‘সরীসৃপীয় মস্তিষ্ক’, মাঝেরটির নাম ‘স্তন্যপায়ীদের মস্তিষ্ক’ আর সবচাইতে উপরের স্তরটির নাম ‘প্রাইমেট মস্তিষ্ক’। বিজ্ঞানী পল ম্যাকলিনের মতে তিন স্তরের মগজ মানুষের তিন প্রকারের সক্রিয়তা পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করে। প্রাথমিক অনুভূতিসমূহ যেমন, কাম-ক্রোধ-লোভ-বংশরক্ষা অর্থাৎ প্রাণী হিসেবে আমরা যে প্রবণতাগুলো (instinct) বোধ করি, তা ঘটে সরীসৃপীয় অঞ্চলে। মাঝের স্তন্যপায়ীর মস্তিষ্কে তৈরি হয় আবেগ-ভালবাসা-হৃদয়াবেগ। আমরা এই অংশের জন্য ভালবাসা, রোমান্টিকতা, হিংসা, পরশ্রীকাতরতা, ঈর্ষা, উৎসাহ ইত্যাদি বোধ করি। আর মগজের তৃতীয় স্তর আমাদের মধ্যে তৈরি করে বুদ্ধিবৃত্তিক-যৌক্তিক চিন্তাভাবনার ক্ষমতা। এই অংশের চিন্তাসামর্থ্যের মাধ্যমেই আমরা নিজেদের প্রাথমিক পাশবিক অনুভূতিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি।
এই মডেলটি মানুষের মগজের বিবর্তনকে খুব সহজভাবে ব্যাখ্যা করে। কিন্তু মগজের গঠনপ্রক্রিয়া ততোটা সরল নয়। বিলিয়ন বিলিয়ন কোষ ও নিউরনের এই জটিল কাঠামোকে এতটা সরলভাবে ব্যাখ্যা করার পদ্ধতি অনেক আধুনিক বিজ্ঞানী সমর্থন করেন না।
একটি জনপ্রিয় কুসংস্কার নিয়ে লেখক আরাফাত রহমান এই অধ্যায়ে মনোজ্ঞ আলোচনা করেছেন। এই কুসংস্কার অনেক বিজ্ঞানমনস্ক মানুষের মধ্যেও রয়েছে। তারা মনে করে মানুষ তার মগজের খুব অল্প কিছু অংশ ব্যবহার করে। বাকী অংশ সারাজীবন অব্যবহৃত থেকে যায়। লেখক উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়েছেন যে আধুনিক মানুষদের এই ধারণা কুসংস্কার মাত্র। বাস্তবে এর কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।
যারা দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন বা যাদের অঙ্গহানি ঘটেছে তাদের মগজের সংশ্লিষ্ট অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্থ অঙ্গের ক্ষেত্রে কীভাবে কাজ করে বা প্রতিক্রিয়া দেখায় সে বিষয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা থেমে নেই। লেখক সহজ ভাষায় কয়েকটি গবেষণার বর্ণনাও দিয়েছেন।
দ্বিতীয় অধ্যায়ে রয়েছে ‘ঘুম’ প্রসঙ্গে আলোচনা। আমরা জীবনের তিন ভাগের এক ভাগ সময় ঘুমিয়ে কাটাই। এটা জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় নাকি জীবনের এক নিদারুণ অপচয়- সেই বিষয়ের উপর আলোকপাত দ্বিতীয় অধ্যায়ের উদ্দেশ্য।
বেশ কয়েকটি উপশিরোনামের অধীনে বিষয়গুলোকে পরিষ্কার করা হয়েছে।
‘ঘুম কেন জরুরী’, ‘ঘুমের কী কাজ’, ‘ঘুম গবেষণার আশ্চর্য আরম্ভ’, ‘ঘুম চক্র ও রেম ঘুম’, ‘মস্তিষ্কের বিকাশ ও স্মৃতি সঞ্চয়’, ‘ঘুম চক্র, স্বপ্ন ও অন্তর্দৃষ্টি’, ‘সার্কাডিয়ান ক্লক’, ‘ঘুম নিয়ন্ত্রণ স্নায়ুবর্তনী’- ইত্যাদি উপশিরোনামগুলো ঘুমের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য, ঘুম নিয়ে গবেষণা, তার ফলাফল, বিভিন্ন ধরণের প্রাণীর মধ্যে ঘুমের পার্থক্য-বৈচিত্র্য ইত্যাদি বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেছে। লেখক জানান ১৯৫০ সালের পূর্ব পর্যন্ত ঘুম সম্পর্কে মানুষের জানাশোনার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ছিল খুবই কম। ১৯৫২ সালে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানী ইউজিন আরিয়েলস্কি আবিষ্কার করেন ঘুমচক্র। পরবর্তীতে বিভিন্ন ধরনের ঘুমের বৈশিষ্ট্য বিজ্ঞানীরা চিহ্নিত করেন। প্রধান দুইটি ভাগ REM ঘুম (Rapid Eye Movement) এবং Non REM ঘুম আবার কয়েকটি ধাপে বিভক্ত। মানুষ সারারাত বিভিন্ন ধাপে REM এবং Non REM ঘুম ঘুমিয়ে থাকে। আগে ধারণা করা হতো যে মানুষ REM ঘুমের সময় স্বপ্ন দেখে। কিন্তু বিজ্ঞানীদের নিরলস গবেষণা সে ধারণাটিকে অসত্য প্রমাণিত করেছে।
তৃতীয় অধ্যায়ে ‘স্বপ্ন’ নিয়ে রয়েছে বিশদ আলোচনা। ‘স্বপ্ন অভিধান’ উপশিরোনামে লেখক স্বপ্নের ব্যাখ্যা করার জন্য মানুষের যে প্রবণতা তার উল্লেখ করেছেন। প্রাচীন মিশর থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত সকল সময়েই মানুষ স্বপ্নের অর্থ জানতে উৎসাহী ছিল। কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ মনে করেছে স্বপ্ন হল ভবিষ্যৎবাণী আর আধুনিক মানুষ যেমন সিগমুন্ড ফ্রয়েড মনে করেছেন স্বপ্ন হল অতীত ও বর্তমানের বিভিন্ন ঘটনা ও কর্মপ্রেরণার প্রতিফলন। কিন্তু স্নায়ুবিজ্ঞানীরা এসব ধারণার কোনটাই সমর্থন করেন না। তারা মনে করেন স্বপ্নের কোন মানে নেই।
স্বপ্ন হল মগজে স্মৃতি-সংরক্ষণের মতো অন্যসব গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়ার উপজাত মাত্র। স্বপ্ন হল ধোঁয়া, আগুন নয়। পৃষ্ঠা- ৭১
‘স্বপ্নজার্নালের কাঁটাছেড়া’, ‘স্বপ্ন জার্নাল গবেষণা’, ‘স্বপ্নের স্নায়ুবিজ্ঞান’, ‘কতিপয় স্বপ্নতত্ত্ব’ প্রভৃতি উপশিরোনামে স্নায়ু ও মনোবিজ্ঞানীদের স্বপ্ন সম্পর্কে বিভিন্ন তত্ত্ব, ধারণা বা অনুমান আলোচিত হয়েছে। ‘কতিপয় স্বপ্নতত্ত্ব’ অধ্যায়ের একটি অনুকল্প বেশ আগ্রহোদ্দীপকঃ
যেসব জীববিজ্ঞানীর মূল আগ্রহ বিবর্তনের তাঁরা প্রস্তাব করেছেন সময়ের সাথে সাথে স্বপ্নের ক্রমবিকাশ ঘটেছে। স্বপ্নে সেই সব আচরণকে নিখুঁত করে তোলার মহড়া ঘটে যারা জেগে থাকার সময়ে টিকে থাকার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্বপ্ন অনেকটা ভার্চুয়াল বাস্তবতার মতো কাজ করে যেখানে একটি নিরাপদ স্থান (যেখানে প্রাণী ঘুমাচ্ছে) জীবনের উপর হুমকি তোলা বিভিন্ন পরিস্থিতির একটি ছদ্ম অনুকরণ করা হয়। পৃষ্ঠা- ৮১
‘স্বপ্ন’ শিরোনামের তৃতীয় অধ্যায়ে লেখক বিভিন্ন ধারার বিজ্ঞানীর দৃষ্টিকোণ থেকে স্বপ্নের ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন। বেশিরভাগ স্বপ্ন নেতিবাচক কেন? এর অর্থ বা বাস্তব জীবনে প্রভাব কীরূপ? ইতিবাচক স্বপ্নগুলো কেন দেখি? স্বপ্নের সাথে অন্তর্দৃষ্টির সম্পর্ক, মগজের কোন অংশের সক্রিয়তা আমাদেরকে স্বপ্ন দেখা, ঘুমের বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন রকম স্বপ্ন ইত্যাদি নানা বিষয় প্রসঙ্গক্রমে সহজবোধ করে লেখক তুলে এনেছেন। তবে বিভিন্ন বিজ্ঞানীর নানামুখী ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের পরে লেখক স্বপ্ন সম্পর্কে নিজে যে কথাগুলো বলেছেন সেটাকেই আমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। তিনি বলেন:
স্বপ্ন আমাদের জাগ্রত অবস্থার বাইরে এমন একটা অভিজ্ঞতা দেয় যেখানে বাস্তব জগতের নিয়মকানুন খাটে না, সেখানে কার্যকারণ ও যৌক্তিক চিন্তা এবং আমাদের বৌদ্ধিক প্রতীতি অকার্যকর হয়ে যায়। স্থান-কাল-পাত্র বদলে যায়, অভিকর্ষসহ অন্যান্য নিয়মকানুন বেয়াড়া আচরণ করে, অদ্ভুতুড়ে আর অযৌক্তিক কাহিনীরা পর পর ভিড় করে। স্বপ্নে এই কাহিনীদের বেয়াড়া ভিড়কে আমরা স্বাভাবিক বলে ধরে নেই। গল্প-বলা-স্বপ্নগুলো মূলত চেনাজানা দুনিয়া থেকে বাইরে কাল্পনিক সব ঘটনা-কাঠামো ও তাদের ব্যাখ্যা হাজির করে। জেগে ওঠার পর আপনি হয়তো স্বপ্ন জগতের বদলানো রূপ গ্রহণ করতে পারেন কিংবা যুক্তি দিয়ে বিশ্লেষণ করতে পারেন অথবা দুইটি জিনিষই মিশিয়ে ফেলতে পারেন। স্বপ্নের কাল্পনিক জগতের অভিজ্ঞতা পর্দার ওপরে চলে গেছে। সেই অভিজ্ঞতাই মূখ্য, আনন্দের। পৃ-৮৫
লেখক আরাফাত রহমান নিজে বিজ্ঞান বিষয়ের শিক্ষক। ফলে তার লিখিত “মস্তিষ্ক, ঘুম ও স্বপ্ন” বইটি কোন অবৈজ্ঞানিক তথ্য দ্বারা ভারাক্রান্ত হয় নি। বৈজ্ঞানিক তথ্যপ্রমাণ নতুন পাঠকের উপযোগী করে যতোটা সহজসাধ্য করা সম্ভব তার চেষ্টা করে লেখা হয়েছে। ফলে বিজ্ঞানের ছাত্র যারা নয়, তারাও এই বই পড়ে বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করতে পারবে। বুঝে নিতে পারবে মস্তিষ্ক, ঘুম আর স্বপ্নের স্বরূপ।
আলোচ্য বইটি ‘জ্ঞান ও সভ্যতা গ্রন্থমালা’র দ্বিতীয় বই। ‘প্রকৃতি পরিচয়’ প্রকাশনীকে এই জাতীয় গ্রন্থমালা বা সিরিজ বই প্রকাশের জন্য ধন্যবাদ জানাই। তারা এই সিরিজে আর কি কি বই প্রকাশ করেছে বা করবে, তার কোন তালিকা বইতে নেই। ফলে অন্য বইগুলোর নাম না জানার একটা আক্ষেপ থেকে যাচ্ছে। তবে নতুন প্রজন্মের কাছে সহজভাষায় অল্প দামে বিজ্ঞান বিষয়ক বই পৌঁছে দেয়ার যে ব্রত তারা হাতে নিয়েছে, এজন্য তাদের উচ্চ প্রশংসা করি। আশা করি কিশোর পাঠকদের জন্য বিজ্ঞান বিষয়ক বই প্রকাশ করার এই কার্যক্রম তারা ধারাবাহিকভাবে চালিয়ে যাবে।
3 মন্তব্যসমূহ
এই সুন্দর পর্যালোচনার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ!
উত্তরমুছুনআপনাকেও ধন্যবাদ।
মুছুনthanks you sir,, for this information
উত্তরমুছুনমার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম