গণিত আমাদের কী কাজে লাগে?
সফিক ইসলাম
প্রকাশকঃ প্রকৃতি পরিচয়
প্রচ্ছদঃ সব্যসাচী হাজরা
প্রথম প্রকাশঃ ২০১৭
পৃষ্ঠাসংখ্যাঃ ১৪২
মূল্যঃ ১৭০.০০ টাকা
ISBN: 978 984 34 1980 4
গণিতের উন্নতির সাথে সাথে মানব সভ্যতার উন্নতি হয়েছে। এটা আমরা অনেকেই জানি না। আমরা আরও জানি না যে, আমাদের পরিপার্শ্বের যা কিছু নান্দনিক, সৌন্দর্যময় তার অন্তরালে রয়েছে গণিতের যুক্তসমূহের সঠিক প্রয়োগ। অথচ শৈশবে আমাদের সামনে গণিতকে উপস্থাপন করা হয় ভীতিকর বিষয় হিসেবে। আর এর প্রভাব থেকে যায় সারাজীবন। ফলে গণিত আমাদের প্রাত্যাহিক জীবনে কী কাজে লাগে তা আমাদের নিকট অজানাই থেকে যায়। এইসব অজানা থেকে যাওয়া কয়েকটি বিষয় নিয়ে রচিত হয়েছে সফিক ইসলামের “গণিত আমাদের কী কাজে লাগে?” বইটি। ভূমিকাতেই লেখক বইয়ের উদ্দেশ্য স্পষ্ট করেছেনঃ
এ বইয়ে আমরা সাধারণ মানুষের প্রাত্যাহিক প্রয়োজনে গণিত কী কাজে লাগে তারই একটি ফিরিস্তি দেওয়ার চেষ্টা করব। এই বিবরণ কোনো বিশেষজ্ঞ পাঠকের জন্য নয়, নয় গণিতে অভিজ্ঞ কোনো ব্যক্তির জন্যও। এটি গণিতের কোনো স্বয়ংসম্পূর্ণ টেক্সট বইও নয়। উচ্চতর গণিতের ছিটেফোঁটাও এখানে নেই। এ বইয়ে কেবল মাধ্যমিক শিক্ষাস্তর পর্যন্ত গণিতের অল্প কিছু বিষয় নিয়েই আলোচনা করা হয়েছে। কাজেই এই বইটি পড়ে বোঝার জন্য গণিতে খুব অভিজ্ঞ হওয়ার দরকার নেই। কেবল প্রাথমিক গণিত সম্পর্কে যাদের ধারণা রয়েছে তারাই বইটি পড়ার উপযুক্ত। বইটি গণিতের ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় সাজানো হয়েছে। গণিতের উন্নতির সাথে সাথে মানব সভ্যতার উন্নতির স্বরূপ এবং প্রকৃতি সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে এবং সকল আলোচনাই গণিতের ইতিহাসের আলোকে করা হয়েছে। সর্বোপরি গণিত কীভাবে মানুষের মনোজগতকে বিকশিত করতে পেরেছে সেই সম্পর্কেও কিছুটা ধারণা দেওয়া হয়েছে।
সূচীপত্র পাঠে বইয়ের আলোচ্য বিষয়গুলোর মর্মার্থ কিছুটা স্পষ্ট হবে-
- গণিতের স্বরূপ
- প্রাথমিক গণিতঃ পরিমাপের বিজ্ঞান
- সংখ্যাঃ আকার আর নিরাকারের যোগসূত্র
- পাটীগণিতঃ গণিতের রাণী
- সংখ্যাতত্ত্বঃ বন্ধ দুয়ার খোলা
- বিন্যাস ও সমাবেশঃ সংখ্যাতত্ত্বের ভিন্নরূপ
- ম্যাট্রিক্সঃ বিন্যাসের অপর নাম
- সূচক ও লগারিদমঃ সঞ্জীবনী গণিত
- বীজগণিতঃ পাটীগণিতের সাধারণরূ
- জ্যামিতিঃ আকার আকৃতির বিজ্ঞান
- কার্তেসীয় জ্যামিতিঃ নিশ্চিত অবস্থানের খোঁজে
- ত্রিকোণমিতিঃ মেনে চলে সুরতরঙ্গও
- ফাংশনঃ সম্পর্কের বিজ্ঞান
- অন্তরীকরণঃ একের পরিবর্তনে অন্যের পরিবর্তন
- সমাকলনঃ সমগ্রতার সন্ধানে
- বাইনারি সংখ্যাপদ্ধতিঃ গণিতের ভিন্ন জগৎ
- যুক্তিতত্ত্বঃ নতুন গণিত
- বিনোদন গণিতঃ যা বুদ্ধি বাড়ায়
প্রত্যেক মানুষ অল্পবিস্তর গণিত জানে। জীবনকে নিয়মমাফিক পরিচালনার জন্য ন্যুনতম গণিতের জ্ঞান অপরিহার্য। অল্পশিক্ষিত বা অশিক্ষিত যারা তারাও গুণতে জানে। গণিত ছাড়া কোন মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না। শুধু মানুষ নয় পৃথিবীর সকল প্রাণীর মধ্যে ন্যূনতম গণিতের জ্ঞান রয়েছে। আণুবীক্ষণিক ব্যাকটেরিয়া থেকে শুরু করে গাছপালা, আকাশ-বাতাশ, গ্রহ-নক্ষত্র সবকিছুতে গণিতের ছোঁয়া রয়েছে। গাণিতিক নিয়ম ছাড়া কোন কিছুই চলমান রাখা সম্ভব নয়। এজন্য বলা হয় “গণিত সকল বিজ্ঞানের জননী”।
‘গণিতের স্বরূপ’ অধ্যায়টিতে গণিত বিষয়ে বিভিন্ন গণিতবিদের সংজ্ঞাগুলো আলোচিত হয়েছে্ গণিত কী, এর কোন সর্বজনগ্রাহ্য সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা এখনও কেউ দিতে পারে নি। কিন্তু প্রত্যেকেই তার নিজ নিজ অবস্থান থেকে গণিতকে ব্যাখ্যা করতে সংজ্ঞায়িত করতে চেয়েছেন।
গ্রিক ‘ম্যাথেমা’ শব্দ থেকে এসেছে ইংরেজি ‘ম্যাথমেটিক্স’ শব্দটি। গ্রিক ম্যাথেমা এর অর্থ জ্ঞান বা শিক্ষা। জ্ঞানের সমার্থক হবার কারণে গ্রিসে জ্ঞানী বা শিক্ষক প্রত্যেককেই গণিতবিদ বা ম্যাথমেটিসিয়ান বলা হত। আর সেজন্য প্রাচীন ও মধ্যযুগের সকল পণ্ডিত – তিনি ধর্মবিদ, ইতিহাসবিদ, ভূগোলবিদ, দার্শনিক, চিকিৎসক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজতাত্ত্বিক যাই হোন না কেন- প্রায় সকলেই গণিতে দক্ষ হতেন। আসলে গণিত ছাড়া কারোই পেশাগত দক্ষতা অর্জন করা সম্ভব না।
প্রসঙ্গক্রমে গণিত সম্পর্কে এরিস্টটল, কার্ল জ্যাকোবি, কার্ল ফ্রেডরিক গাউস, বেঞ্জামিন পিয়ার্স, অগাস্ট কোঁৎ, লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি, স্টিফেন বানাক, জি এইচ হার্ডি, গ্যালিলিও গ্যালিলি, ইয়ান স্টুয়ার্ট, হেনরি পয়েনকার, বার্ট্রুন্ড রাসেল প্রমুখের মতামতগুলো আলোচিত হয়েছে। কিন্তু আমার কাছে বাঙালি গণিতবিদ মীজান রহমানের মন্তব্যটিই সবচাইতে যথাযথ মনে হয়েছে। তিনি বলেছেন-
গণিত হল প্রকৃতির ব্যাকরণ
“প্রাথমিক গণিতঃ পরিমাপের বিজ্ঞান” অধ্যায়ে পরিমাপ ও পরিমাপক নিয়ে আলোচনা রয়েছে। সব ধরণের প্রাণী পরিমাপ করতে পারে। কম-বেশি, ভারী-হালকা, উঁচু-নীচু, ছোট-বড় ধারণাগুলো প্রত্যেকেই জানে। তাই গণিতবিদেরা বলে থাকেন-
পরিমাপের ধারণাই হচ্ছে গণিতের সবচাইতে প্রাচীনতম ধারণা। পৃষ্ঠা- ২৩
পরিমাণ সম্পর্কে ধারণা আসলে প্রাণীর অস্তিত্ব রক্ষার সাথে সম্পর্কযুক্ত। এই ধারণা না থাকলে সে বেঁচে থাকতেই পারত না। বৃহত্তর পরিসরে পরিমাপের ধারণা মানুষের মধ্যে এসেছে কৃষিজীবী হওয়ার পর থেকে। পরিমাপের ধারণা প্রাচীন সব সভ্যতাতে ছিল। মেসোপটেমীয় বাইজানটাইন সভ্যতা সময়কে ষাট ভাগে ভাগ করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিল; যা এখনও প্রচলিত আছে। ভারতীয় সভ্যতায় সময়কে পল, অনুপল ইত্যাদি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছিল।
তাপ পরিমাপক যন্ত্র আবিষ্কৃত হয় ১৭১৪ সালে। ১৭০৯ সাল থেকে নিরলস গবেষণার পর জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী ড্যানিয়েল গাব্রিয়েল ফারেনহাইট (Daniel Gabriel Fahrenheit, 1686–1736) ১৭১৪ সালে পারদ ব্যবহার করে আবিষ্কার করেন থার্মোমিটার। তার নামেই এই স্কেলের নামকরণ করা হয় ফারেনহাইট স্কেল। একই শতকে সুইডেনের জ্যোতির্বিজ্ঞানী আন্দ্রে সেলসিয়াস (Anders Celsius, 1701–1744) আবিষ্কার করেন সেন্টিগ্রেড বা সেলসিয়াস স্কেল। সেই থেকে তাপমাত্রা গুণবাচক বিষয় থেকে পরিমাণবাচক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। তবে এখনও আমরা ভালবাসা, ঘৃণা, ক্রোধ, হিংসা প্রভৃতি পরিমাপ করতে পারি না। গণিতবিদগণ অবশ্য এগুলোকে পরিমাপ করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
“সংখ্যাঃ আকার ও নিরাকারের সূত্র” অধ্যায়ে সংখ্যার ধারণা কোন সভ্যতায় কেমন, দৈনন্দিন জীবনে সংখ্যার ভূমিকা-প্রভাব ইত্যাদি আলোচিত হয়েছে।
গণিত প্রধানত বিমূর্ত একটি বিষয়, তাকে মূর্ত করে তোলে সংখ্যা। সংখ্যা দিয়েই গণিতকে দৃশ্যমান ব্যবহারযোগ্য করে তোলা হয়। রোমান সংখ্যালিপিতে বিভিন্ন বর্ণ দিয়ে সংখ্যা বোঝানো হত। এই পদ্ধতিতে বড় অংকের গুণভাগ করা যেত না। তাই প্রাচীনকালে ইউরোপে গণিতের খুব বেশি উন্নতি হয় নি। অথচ সমসাময়িক কালে ভারতবর্ষে কোটি, অর্বুদ, নিযুত, অযুত প্রভৃতি বড় অংকের প্রচলন ছিল। আর এটা সম্ভব ছিল ভারতীয় দশমিক সংখ্যা পদ্ধতির কারণে। বর্তমানে সারা পৃথিবী দশমিক গণনা পদ্ধতিকে গ্রহণ করেছে। ভারতীয় ঋষিদের আবিষ্কৃত এই পদ্ধতি পারস্যের পণ্ডিতদের হাত ধরে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পরে। এ প্রসঙ্গে আরও জানতে “শূন্যের ইতিকথা” বইটি পড়া যেতে পারে।
“পাটীগণিতঃ গণিতের রাণী” অধ্যায়ে গণিতের অন্যতম শাখা পাটীগণিত নিয়ে বেশ তথ্যবহুল আলোচনা রয়েছে। পাটীগণিতের ইংরেজি Arithmatic শব্দটি এসেছে গ্রিক Arithmos শব্দ থেকে। Arithmos অর্থ হল সংখ্যা বা Number, আর সেইজন্য ইংরেজিতে বলা হয় The study of number is arithmatic।
পাটীগণিত আমাদের জীবনের প্রায় সকল কাজেই লাগে। ঘুম থেকে উঠে আবার ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত জীবনের প্রতিটি স্তরে আমরা পাটীগণিত ছাড়া চলতে পারি না। প্রাচীন ব্যাবিলনীয় পণ্ডিতগণ পাটীগণিতের নানা শাখা যেমন অনুপাত, সমানুপাত ইত্যাদি সম্পর্কে জানত।
বলা হয় পাটীগণিতের ধারণা মানুষকে যৌক্তিক চিন্তা করতে শিক্ষা দেয়। যে পাটীগণিত বোঝে তার মধ্যে যৌক্তিক পরিণতি মেনে নেয়ার মানসিকতা থাকে। অনুপাতের ধারণা মানুষের মনে ন্যায়বোধ ও সৌন্দর্যবোধ সৃষ্টি করে। সবচাইতে সুন্দর অনুপাত হল ‘স্বর্ণালি অনুপাত’ বা Golden ratio। সুন্দর কোন কিছু আঁকতে বা তৈরি করতে চাইলে স্বর্ণালি অনুপাত সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান থাকতে হবে। স্বর্ণালি অনুপাতের আনুমানিক মান 1.618.1 । গাছের উচ্চতার সাথে তার ডালপালার বিস্তৃতি, মানুষের উচ্চতার সাথে তার দুই হাতের বিস্তারের অনুপাত স্বর্ণালি অনুপাতের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বিখ্যাত চিত্রশিল্প, নান্দনিক স্থাপত্য সবকিছুই স্বর্ণালি অনুপাতের কথা মাথায় রেখে তৈরি করা। পাটীগণিতের এই অসামান্য ভূমিকার জন্যই একে গণিতের রাণী বলা হয়।
“সংখ্যাতত্ত্বঃ বন্ধ দুয়ার খোলা” অধ্যায়ের প্রধান আলোচ্য বিষয় ক্রিপ্টোলজি। তথ্য গোপন ও নিরাপদ রাখতে হাজার বৎসর আগে থেকেই ক্রিপ্টোলজি ব্যবহৃত হত। নবম শতাব্দীর দার্শনিক আল কিন্দি নিরাপত্তার প্রয়োজনে ক্রিপ্টোলজির উন্নয়ন ঘটান। এই ক্রিপ্টোলজির উপর ভিত্তি করে আধুনিক যুগের পাসওয়ার্ড নিরাপদ রাখা হচ্ছে।
“বিন্যাস ও সমাবেশঃ সংখ্যাতত্ত্বের ভিন্নরূপ” অধ্যায়ে কিছু সংখ্যাকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করার যে ধারণা তা নিয়ে আলোচনা রয়েছে। যে কোন কিছুর প্যাটার্ণ বিশ্লেষণ, বিন্যাস ও সমাবেশ করার জন্য গণিতের যে শাখা তাকে কম্বিনেটরিক্স বলে। কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে লেখক আমাদেরকে বিষয়টি সুন্দর করে বুঝিয়ে দিয়েছেন। সংখ্যা দিয়ে সঠিকভাবে বিন্যাসের জ্ঞান মানুষের আছে বলেই বিশ্বকাপ ফুটবলে ৩২টি দলকে দিয়ে ৬৪টি ম্যাচ খেলিয়ে বিজয়ী বের করা যায়। পাটীগণিত না জানলে এই ৩২টি দলের মধ্যে একটি দলকে বিজয়ী ঘোষণা করতে আয়োজকদেরকে ৫৩২টি খেলার আয়োজন করতে হত। জীববিজ্ঞান, অনুজীববিজ্ঞান, বংশগতিবিজ্ঞান এর জেনোটাইপ-ফেনোটাইপ নির্ধারণে সংখ্যার বিন্যাস জ্ঞান না থাকলে চলত না।
“ম্যাট্রিক্সঃ বিন্যাসের অপর নাম” অধ্যায়ে ম্যাট্রিক্স কি তার বিবরণ রয়েছে। অনেকগুলো সংখ্যা বা তথ্য বা উপাত্তকে সঠিকভাবে সাজানোর ধারণা না থাকলে প্রয়োজনীয় কাজের অসুবিধা হতে পারে। লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বিঘ্ন ঘটতে পারে। এই সমস্যা গণিতের যে শাখার মাধ্যমে সমাধান হয়, তার নাম ম্যাট্রিক্স। তাই ম্যাট্রিক্সকে বলা হয় বিন্যাসের গণিত।
“সূচক ও লগরিদমঃ সঞ্জীবনী গণিত” শিরোনামের অধ্যায়ে বড় সংখ্যা প্রকাশের জন্য এবং তার প্রক্রিয়াকরণের জন্য সূচকের ব্যবহার বর্ণনা করা হয়েছে। অনেক বড় সংখ্যা থেকে খুবই ক্ষুদ্র সংখ্যা প্রকাশের জন্যেও সূচকের প্রয়োজন।
যেমন ১ এর পর ১০০টি শূন্য লিখে যে সংখ্যা তাকে গুগল বলে। ১ এর পরে গুগল সংখ্যক শূন্য লিখলে যে সংখ্যা তৈরি হয় তার নাম গুগলপ্লেক্স। এই সংখ্যাটি বাস্তবে লেখা অসম্ভব, কিন্তু সূচক ব্যবহার করে অতিদ্রুত লিখে ফেলা যায়। সূচকের ব্যবহার মানুষ জানে বলে অতিবড় বা অতিক্ষুদ্র সংখ্যা নিয়ে মানুষ চিন্তা করতে পারছে।
ব্রিটিশ গণিতবিদ জন ন্যাপিয়ার (John Napier , Description of the Wonderful Rule of Logarithms) ১৬১৪ সালে লগরিদম আবিষ্কারের প্রয়োজনীয়তা ছাত্রদের উদ্দেশ্যে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছিলেন -
বৃহৎ সংখ্যার গুণ, ভাগ, বর্গমূল, ঘনমূল ইত্যাদি নির্ণয়ের মতো বিরক্তিকর দীর্ঘ প্রক্রিয়া ব্যবহারিক ক্ষেত্রে অনেক বিঘ্ন সৃষ্টি করে, সময়ের প্রশ্নতো আছেই। তাছাড়া ভুলের সম্ভাবনাও অতিশয় মারাত্মক, আর কোথায় ভুল ধরে সংশোধন করাও নিতান্ত সহজ নয়। এই সমস্ত বিবেচনা করে এই অসুবিধা দূর হতে পারে বা লাঘব হতে পারে - এমন সহজ এবং সংশয়মুক্ত প্রক্রিয়ার অন্বেষণ করতে আরম্ভ করলাম। পৃষ্ঠা- ৬৯
তাঁর এই বক্তব্য থেকেই লগরিদম কী, এর প্রয়োজনীয়তা ও ব্যবহার উপযোগীতার বিষয়টি অনুধাবন করা যায়। গ্রন্থলেখক সফিক ইসলামের ভাষ্যে বিষয়টি আরও সহজবোধ্য। তিনি বলেন-
বাস্তব জীবনের অনেক কিছুই সূচক এবং লগরিদম ফাংশনের মতো আচরণ করে। যেমন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার, ইলেক্ট্রনিক দ্রব্যসামগ্রী ব্যবহারের ক্রমবর্ধমান হার, স্মার্ট ফোনের ব্যবহার ইত্যাদি সূচক ফাংশনের নিয়ম মেনে চলে। পৃষ্ঠা- ৭৫
বীজগণিত নিয়ে আলোচনা রয়েছে “বীজগণিতঃ পাটীগণিতের সাধারণ রূপ” শীর্ষক অধ্যায়ে। প্রাচীন মিশর, ভারত, গ্রীক সভ্যতাতে বীজগণিতের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে চিন্তা করার ইতিহাস পাওয়া যায়। পরে আলেকজান্দ্রিয়ার গণিতবিদ ডায়াফোন্টাস (Diophantus) বীজগণিতের নীতিসমূহ উদ্ভাবন করেন। তাঁকে “বীজগণিতের জনক” বলা হয়। এক বা একাধিক অজানা রাশি মনে মনে ধরে নেয়ার যে ধারণা তিনি প্রস্তাব করেছিলেন আজ তা সারাবিশ্বে সাদরে গৃহীত হয়েছে। প্রাচীন ভারতীয় গণিতবিদগণও অজানা রাশিকে বর্ণের মাধ্যমে প্রকাশ করার রীতি চালু করেছিলেন। তবে বীজগণিতকে জনপ্রিয় করার প্রধান কৃতিত্ব পারস্যের গণিতবিদ আল-খাওয়ারিজমি'র।
বীজগণিত কী সে বিষয়ে লেখকের বক্তব্য আমার কাছে অপেক্ষাকৃত সহজবোধ্য মনে হয়েছে। তিনি বলেন-
পাটীগণিতে যেকোন গাণিতিক সমস্যাকে সংখ্যা ও সংখ্যার মধ্যকার বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়। কিন্তু বীজগণিতে কোনো গাণিতিক সমস্যাকে প্রথমে অজানা রাশি বা প্রতীকের মাধ্যমে সমীকরণ আকারে প্রকাশ করা হয়। সংখ্যা এবং বিভিন্ন সাংখ্যিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রকাশ করায় পাটীগণিতে প্রতিটি সমস্যাকে আলাদাভাবে বিবেচনায় নিয়ে সমাধান করা হয়। অন্যদিকে বীজগণিতে একই জাতীয় সকল সমস্যার একটি সাধারণ সমাধান উপস্থাপন করা হয়। তাই বলা চলে ভিন্ন জিনিসকে একই নামে জানার কৌশলই বীজগণিত। পৃষ্ঠা- ৮২
গণিতের আর একটি বিখ্যাত শাখা জ্যামিতি নিয়ে আলোচনা রয়েছে “জ্যামিতিঃ আকার আকৃতির বিজ্ঞান” নামক অধ্যায়ে। গ্রীক গণিতবিদ পিথাগোরাস সংখ্যাতত্ত্বের জনক, কিন্তু জ্যামিতিতে তার বেশ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। প্রাচীন মিশরে জ্যামিতির উদ্ভব হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। জ্যামিতির ইংরেজি জিওমেট্রি (Geometry) শব্দটি এসেছে ‘জিও’ ও ‘মেট্রিয়া’ থেকে। জিও - এর অর্থ পৃথিবী বা ভূমি আর মেট্রিয়া অর্থ পরিমাপ। জ্যামিতি আমাদের মনে স্থান সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা তৈরি করে। জ্যামিতির মাধ্যমে কোন একটি স্থানের অবস্থান, আকার সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে একমাত্রিক, দ্বিমাত্রিক বা ত্রিমাত্রিক ধারণা পাওয়া সম্ভব। জ্যামিতি ভাল বোঝার কারণেই মিশরীয়, ভারতীয়, গ্রীকরা সুউচ্চ নান্দনিক দালান বা স্থাপত্যকলা তৈরি করতে পেরেছে। প্লেটো জ্যামিতিকে উন্নততর বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ বলে মনে করতেন। তাই তার প্রতিষ্ঠিত একাডেমির দরজায় লিখে রেখেছিলেন-
জ্যামিতিতে যার জ্ঞান নেই, এখানে তার প্রবেশ নিষেধ। পৃষ্ঠা- ৮৮
“সফিক ইসলাম” লিখিত “গণিত আমাদের কী কাজে লাগে” বইয়ের অন্যান্য অধ্যায়ে গণিতের আরও কিছু দিক নিয়ে মনোজ্ঞ আলোচনা রয়েছে। আকর্ষণীয় তথ্য, ভাষা ও উপস্থাপনা ভঙ্গির কারণে বইটি পড়তে বসলে ছেড়ে ওঠা যায় না। শুধু নবীন পাঠক নয়, বয়স্ক পাঠকগণও এই বই পাঠে গণিতের মজা অনুভব করতে পারবেন। গণিতের প্রতি তার মনে জেগে উঠবে নতুন আগ্রহ। প্রাত্যাহিক জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গণিতের এত ব্যবহার রয়েছে জেনে তিনি কৌতুহলী হয়ে উঠবেন। গণিতের প্রতি এই কৌতুহল তাকে করে তুলবে যুক্তিপ্রবণ। এই বইয়ের বহুল প্রচার প্রত্যাশা করি।
5 মন্তব্যসমূহ
ভালো লাগলো।
উত্তরমুছুনসুন্দর লেখা হয়েছে। আপনার উদ্যোগের সাফল্য কামনা করি। গণিতের ইতিহাস নামের একটা বই ছিল। কার যেন লেখা, মনে করতে পারছি না। সেই বইটা সম্পর্কেও আলোচনা করতে পারেন।
উত্তরমুছুনবইটি কোথায় পাবো?
উত্তরমুছুনমন্তব্য করার জন্য ধন্যবাদ। রুচিশীল বই রাখে এমন যে কোনো দোকানে পাবেন। এছাড়া সরাসরি প্রকাশকের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন।
মুছুনলেখাটি সুন্দর হয়েছে৷ ওয়েব সাইটটি ভাল লাগল৷ বই আলোচনার ওয়েবসাইট, তাও বাংলা ভাষায়৷ ধন্যবাদ কর্তপক্ষ৷
উত্তরমুছুনমার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম