মেয়ের কাছে বাবার চিঠি
জওহরলাল নেহেরু
অনুবাদঃ বদিউর রহমানপ্রকাশক: দ্যু প্রকাশন, ঢাকা
প্রচ্ছদ মিতা মেহেদী
প্রথম প্রকাশঃ ১৯২৯
প্রথম দ্যু প্রকাশঃ ২০১৭
দ্বিতীয় দ্যু প্রকাশঃ ২০১৮
পৃষ্ঠাসংখ্যাঃ ১০৪
মূল্যঃ ১২০ টাকা
ISBN: 978-984-92383-5-5
জওহরলাল নেহেরু ভারতবর্ষের রাজনীতিতে একজন প্রবাদপ্রতীম ব্যক্তিত্ব। তাঁর কন্যা ইন্দিরা গান্ধী'র বয়স তখন নয়-দশ বৎসর। ১৯২৮ সালের দিকে এলাহাবাদে তিনি বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত ছিলেন। পরিবার তাঁর সাথে ছিল না। কন্যাকে তিনি খুব ভালবাসতেন। তার জ্ঞানার্জনের কথা সবসময় ভাবতেন। তাই কাজের ফাঁকে ফাঁকে তিনি মেয়ে ইন্দিরা গান্ধীর উদ্দেশ্যে লিখে ফেললেন কয়েকটি চিঠি। ইতিহাস, দর্শন, বিজ্ঞান, ভূগোল, রাষ্ট্রচিন্তা, অর্থনীতি ও মানব সমাজ- সংস্কৃতির বিভিন্ন বিষয়ে মেয়ের বয়সের উপযোগী করে লেখা এই চিঠিগুলো আজ বিশ্বসাহিত্যের অংশ হয়ে গেছে। মোট ত্রিশটি চিঠিতে কন্যার মননে জ্ঞানতৃষ্ণার বীজ বপন করতে চেয়েছেন; আর এই উদ্দেশ্যেই তিনি আকর্ষণীয় বিষয়গুলোকে বেছে নিয়েছেন। সূচীপত্রে বিষয়গুলোকে একটু আস্বাদন করা যেতে পারে।
সূচীপত্র
- প্রকৃতিকে জানা
- যেভাবে প্রাচীন ইতিহাস লিখিত হলো
- পৃথিবীর সৃষ্টি
- প্রথম প্রাণের অস্তিত্ব
- জীবজন্তু এলো
- মানুষ এলো
- আদিম মানুষ
- নানা জাতির সৃষ্টি
- মানুষের জাতি ও ভাষা
- ভাষার সঙ্গে ভাষার সম্পর্ক
- সভ্যতা কী?
- গোত্র বা গোষ্ঠী গঠন
- ধর্মের সূচনা এবং শ্রম বিভাজন
- কৃষির মাধ্যমে যত পরিবর্তন
- যেভাবে গোত্রপতি এলেন
- উন্নতি হলো গোত্রপতির
- গোত্রপতি রাজা হলো
- প্রচীন সভ্যতা
- কয়েকটি বড় প্রাচীন শহর
- মিশর এবং ক্রিট
- চীন এবং ভারতবর্ষ
- সমুদ্রযাত্রা ও ব্যবসাবাণিজ্য
- ভাষা, বর্ণ এবং সংখ্যা
- মানুষের শ্রেণিবিভাগ
- রাজা, মন্দির এবং পুরোহিত
- ফিরে দেখা
- ফসিল এবং ধ্বংসাবশেষ
- আর্যদের ভারত আগমন
- আর্যরা কেন ভারতে এলো
- রামায়ণ ও মহাভারত
শিরোনামগুলো পড়ে আলোচ্য বিষয়গুলোর পরিধি বোঝা যায়। জওহরলাল নেহেরু চেয়েছেন তার মেয়ে পূর্বনির্ধারিত ধারণার ঘেরাটোপ থেকে বের হয়ে আসুক; সুচিন্তিত ও সুপরীক্ষিত বৈজ্ঞানিক তথ্যের সাথে আরোপিত ও কল্পিত সিদ্ধান্তের পার্থক্য নিরূপণ করতে শিখুক। আর এজন্যই বেছে নিয়েছেন এমন সব বিষয় যা শিশুমনের গভীরে অদম্য কৌতুহলের জোয়ার তুলবে।
শুধু শিশুমন কেন, বয়স নির্বিশেষে প্রত্যেক মানুষ অজানাকে জানতে করতে চায়। রহস্যের দুয়ার উন্মোচন করে জ্ঞানের আলোর স্পর্শ পেতে চায়। তবে প্রাপ্ত তথ্যের গ্রহণক্ষমতা বা বিশ্লেষণের সামর্থ্য সবার সমান নয়। আলোচ্য বইয়ে যে বিষয়গুলো পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু বর্ণনা করেছেন তার সবগুলোই কৌতুহলী মানুষের উদ্যোমকে আরও বাড়িয়ে দিবে।
মানসিকভাবে সুস্থ যে কোন মানুষ সত্যের পরীক্ষিত রূপ চিনতে চায়। নিজের পূর্বধারণার সাথে সংগৃহীত তথ্যের পুনর্মিলন ঘটাতে চায়। এজন্য দরকার নিবিড় পাঠের পূর্বঅভিজ্ঞতা। যার প্রভাবে ব্যক্তি পরিণত হয় পূর্ণাঙ্গ মানবে।
মানুষের জীবনের প্রথম কৌতুহল তার পরিপার্শ্ব নিয়ে। তার পরিপার্শের প্রধান উপাদান প্রকৃতি। গাছ-পালা, পশু-পাখি, আকাশ-বাতাস, পাহাড়-পর্বত, নদী-সমুদ্র ইত্যাদি নিয়ে যে চরাচর গঠিত তাকে প্রতিটি মানুষ চিনতে চায়, জানতে চায়। মানুষের সৃষ্টির বহুপূর্বেই সৃষ্ট এই প্রকৃতি নিজে তার ভাঁজে ভাঁজে লিখে রেখেছে নিজের সৃষ্টিতত্ত্ব। এই ভাষা যে পড়তে পারে, সেই বোঝে প্রকৃতির অপার রহস্যের নিগুঢ় অর্থ।
কোন এক অজানা দিনে প্রকৃতির বুকে সৃষ্টি হল প্রাণের প্রথম স্পন্দন। একবিন্দু প্রাণ বিকশিত হতে হতে পরিণত হল বিলিয়ন কোষের পূর্ণাঙ্গ প্রাণীতে। তার ধারাবাহিকতায় এল মানুষ। আদিম মানুষ আধুনিক মানুষের মতো বিভিন্ন যন্ত্রের ব্যবহার জানতো না। অনেক কষ্টে প্রকৃতির সাথে, হিংস্র জীবজন্তুর সাথে যুদ্ধ করে কোনমতে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখত। নিরাপত্তার প্রয়োজনে তারা গোষ্ঠীর সৃষ্টি করল। জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সৃষ্টি হল একাধিক গোষ্ঠীর। আবার পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গার ভৌগলিক ভিন্নতা মানুষের বাহ্যিক গঠনে আনল দৃষ্টিগ্রাহ্য পরিবর্তন। সৃষ্টি হল বিভিন্ন জাতির। পরষ্পরের সাথে ভাবনা বিনিময়ের প্রয়োজনে জন্ম হল ভাষার। পানীয় জলের উৎসকে কেন্দ্র করে জনবসতি গড়ে উঠতে লাগল। ভাষার বিকাশ, যন্ত্রের ক্রমোন্নতি, কৃষির প্রচলন মানুষের জীবনে এনে দিল খাদ্য নিরাপত্তা ও দীর্ঘ চিন্তার সময় ও সামর্থ্য। মানুষের মননে তৈরি হল সম্পত্তির ধারণা। সম্পত্তির অধিকার জন্ম দিল গোত্রপতির। সেই সাথে জন্ম হল শ্রম বিভাজনের। গোত্রপতি নিজেকে শাসক ভাবতে লাগল। গোত্রপতির অবস্থানকে নিশ্চিত করতে তৈরি হল নানা রকম ধারণা। এই ধারণাগুলো গোত্রপতিকে এমন একটি উচ্চ অবস্থানে তুলে ধরল যেখান থেকে তার বিচ্যুতির সম্ভাবনা আর থাকল না। বিশ্বের বিভিন্ন এলাকার পরিশ্রমী মানুষদের মধ্যে চিন্তার বিকাশ ও ফলাফল প্রায় একই ছিল। ফলে বিভিন্ন জায়গায় গড়ে ওঠে নগর সভ্যতা। সৃষ্টি হল শিল্প-সংস্কৃতির নানা উপাদান। মানবজাতির বিকাশের এই ইতিহাস লেখক একাধিক চিঠিতে বর্ণনা করেছেন।
লেখক বংশানুক্রমে ভারতবর্ষের অধিবাসী। তাই শিল্প-সংস্কৃতির চরম বিকাশের পর্যায়ে তিনি শুধুমাত্র ভারতবর্ষের মানুষদের কীর্তির বিবরণ দিয়েছেন। ভারতীয় সংস্কৃতির ঐশ্বর্য আলোচনা করেছেন। প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতাগুলোর গঠন ও বিকাশের স্বরূপ তুলে ধরেছেন। বলেছেন প্রাচীন ভারতীয় বুদ্ধিবৃত্তির সর্বোৎকৃষ্ট সাহিত্যিক নিদর্শন রামায়ণ ও মহাভারতের কথা। বিশ্বের ইতিহাসে মহাকাব্য রয়েছে মাত্র চারটি। ইলিয়াড, ওডেসি, রামায়ণ ও মহাভারত। চারটির মধ্যে দুইটিই ভারতবর্ষের মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষতার পরিচয় বহন করছে।
সংক্ষিপ্ত পরিসরে নয়-দশ বৎসরের শিশুর উপযোগী করে লেখা চিঠিগুলো জটিল তথ্যের ভারে ভারাক্রান্ত নয়। আবার শিশু চিন্তার সামর্থের কথা বিবেচনায় রেখে বিস্তারিত বিবরণ বাদ দেয়া হয়েছে। ফলে কৌতুহল তৃপ্ত হলেও খোলা থেকে যায় প্রশ্নের ঝাঁপি। যা পাঠককে আরও বিস্তারিত জানতে উদ্বুদ্ধ করবে। এগিয়ে নিয়ে যাবে জ্ঞানজগতের বিস্তৃত প্রান্তরে।
প্রতিটি চিঠির আকার বেশ ছোট এবং উপস্থাপন ভঙ্গি খুবই মজার। কৌতুহল ধরে রাখতে লেখক প্রসঙ্গগুলোকে যে পদ্ধতিতে একটার পর একটা টেনে নিয়ে গেছেন তার প্রশংসা না করে পারা যায় না। আমার কাছে “মেয়ের কাছে বাবার চিঠি” বইটি সন্তানকে পড়ে শোনানোর জন্য বেশি উপযোগী মনে হয়েছে। শিক্ষিত সচেতন অভিভাবক তার সন্তানকে জ্ঞানজগতের অসীম সীমানার সাথে পরিচিত করে তুলতে এই বইটিকে ব্যবহার করতে পারেন। প্রায় আশি বৎসর ধরে এই বই বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়ে আসছে। বাংলা ভাষাতেও এই বইয়ের একাধিক মুদ্রণ আমার চোখে পড়েছে। প্রত্যাশা করি “মেয়ের কাছে বাবার চিঠি” বইয়ের পাঠ পরবর্তী অনুভূতি বাঙালির নতুন প্রজন্মকে আধুনিক মননশীল জীবনের প্রতি আগ্রহী করে তুলবে। শিক্ষা সচেতন আলোয় আলোকিত করে দূর করবে হাজার বছরের চেপে বসা অন্ধকার।
মূল চিঠিগুলো কোন ভাষায় লেখা হয়েছিল, তা বইয়ের কোথাও খুঁজে পেলাম না। তবে যে ভাষাতেই হোক না কেন, অনুবাদক বদিউর রহমানের অনুবাদ খুবই সুপাঠ্য হয়েছে। বাক্যভঙ্গি কোথাও হোঁচট খায়নি। পড়তে গিয়ে মনে হয় জওহরলাল নেহেরু বুঝি বাংলাতেই চিঠিগুলো লিখেছেন। এজন্য অনুবাদক কিছুটা বাড়তি ধন্যবাদ পেতেই পারেন।
এই বই শিশু কিশোর ছাড়াও পিতা-মাতাদের অবশ্যপাঠ্য। গল্পের ভঙ্গিতে এই বইয়ের পাঠ তাদের সন্তানকে এক নতুন জগতের সন্ধান দেবে। শিশু-কিশোররা প্রকৃতি সৃষ্টির অপার রহস্যের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠবে। প্রত্যাশা করি বাংলাদেশের প্রতিটি পরিবারে “মেয়ের কাছে বাবার চিঠি” বইটির সমাদর হোক।
* পৃথিবী সৃষ্টির রোমাঞ্চকর ইতিহাসের কাহিনী সত্যেন সেন লিখিত "আমাদের এই পৃথিবী" বইতেও রয়েছে।
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম