প্রাচীন মেলুহা
সিন্ধু সভ্যতার ইতিবৃত্ত
ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী
প্রকাশকঃ প্রকৃতি পরিচয়, ঢাকা।প্রচ্ছদঃ সব্যসাচী হাজরা
প্রথম প্রকাশঃ ২০১৫
পৃষ্ঠাসংখ্যাঃ ৮৮
মূল্যঃ ১০০ টাকা
ISBN: 978-984-888-2511
মানুষের সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশের ইতিহাস বেশ আকর্ষণীয় একটি বিষয়। আমরা কেমন করে আধুনিক যুগে এলাম; ধাপে ধাপে অগ্রসরের কাহিনী কিরূপ তা আমাদের অনেকেরই জানতে ইচ্ছে করে। স্কুল-কলেজে ইতিহাস বিষয়ে পড়তে গিয়ে সভ্যতা বিকাশের ধারাগুলো খুব সংক্ষেপে জানা হয়ে যায়। এর মধ্যেই আমরা জেনে যাই কয়েক হাজার বৎর আগে সারা পৃথিবীর বেশ কয়েকটি জায়গায় মানুষ নগর তৈরি এবং সুশৃঙ্খল জীবন যাপনের চর্চা করেছিল। পাশাপাশি শৈল্পিক সক্ষমতা ও দক্ষতার নিদর্শনস্বরূপ ভাষা, সাহিত্য, দালান-কোঠা তৈরি করেছিল। প্রাচীন মানুষের এরকম কয়েকটি সভ্যতার নাম আমরা কমবেশি সকলেই জানি। যেমন- সিন্ধু সভ্যতা, গ্রীক সভ্যতা, মিশরীয় সভ্যতা, চৈনিক সভ্যতা ইত্যাদি। ক্লাশের বইতে এই সভ্যতাগুলোর সাথে পরিচিত হতে গিয়ে তাদের কিছু সংক্ষিপ্ত বর্ণনাও আমরা জেনেছি। কারও কারও মধ্যে প্রাচীন সভ্যতাগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানার আগ্রহ থাকলেও তেমন সুযোগ হয়ত ছিল না। আসলে বাংলা ভাষায় এই প্রাচীন সভ্যতাগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে এমন বই খুব কম। প্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে আলোচনা করে শুধুমাত্র প্রত্নতত্ত্ব ও নৃতত্ত্ব। জ্ঞানরাজ্যের এই দুটি ধারার সমন্বয়ে চিন্তাশীল প্রত্নতত্ত্ববিদ ও নৃতাত্ত্বিকগণ প্রাচীন সভ্যতা ও তার সংস্কৃতির স্বরূপ উন্মোচন করেন। এর ফলাফল লিখিত হয় ইতিহাসরূপে। আজ আমরা ব্রোঞ্জযুগে বিকশিত প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতা সম্পর্কে মোটামুটি বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে এমন একটি বাংলা বইয়ের সাথে পরিচিত হব।
“প্রাচীন মেলুহা, সিন্ধু সভ্যতার ইতিবৃত্ত” বইয়ের লেখক ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী বাংলাদেশের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সহযোগী অধ্যাপক। কিন্তু ইতিহাসের প্রতি তার আগ্রহ রয়েছে প্রচুর। ইতিহাসের প্রতি তার এই ব্যক্তিগত আগ্রহের ফসল “প্রাচীন মেলুহা, সিন্ধু সভ্যতার ইতিবৃত্ত” বইটি। পেপারব্যাক মলাটের এই বইতে তিনি সিন্ধু সভ্যতার বিভিন্ন রকম বৈশিষ্ট্য ও উৎকর্ষের আকর্ষণীয় বর্ণনা দিয়েছেন, প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে নানা আকারের চিত্র, ম্যাপ ও নকশা ব্যবহার করেছেন, একাধিক প্রত্নতত্ত্ব বিশেষজ্ঞের মতামত উল্লেখ করেছেন। ফলে বইটি মাত্র আশি পৃষ্ঠার হলেও তাতে প্রচুর তথ্যের সমাবেশ রয়েছে। আলোচ্য বইতে কোন সূচীপত্র নেই। বিষয়ভিত্তিক আলোচনাকে কোন শিরোনাম দিয়ে নির্দিষ্ট করা হয় নি। শুধুমাত্র সংখ্যা দিয়ে চিহ্নিত করে আলোচনাকে প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
যেহেতু সিন্ধু সভ্যতা ভারতবর্ষের অংশ, সেহেতু বইটি শুরু হয়েছে এই অঞ্চলে মানুষের আদিম বসবাসের চিহ্ন দিয়ে। বিভিন্ন নিদর্শন থেকে ধারণা করা যায় প্রায় সাত লক্ষ বৎসর পূর্বে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন অংশে হোমো ইরেকটাস নামের মানুষেরা বসবাস করত। নর্মদা নদীর উপত্যকা, ঝিলম নদীর তীরসহ বিভিন্ন জায়গায় হোমো ইরেকটাসের ব্যবহৃত পাথরের অস্ত্র, মাথার খুলি পাওয়া গেছে। ইতিহাসের ধারাবাহিক পথ ধরে উদ্ভব ঘটে হোমো স্যাপিয়েন্সদের। এই আধুনিক মানুষেরা ভারতবর্ষে পদার্পণ করে চৌত্রিশ হাজার বছরেরও অনেক আগে। প্রাচীন মানুষদের বিভিন্ন শিল্পকীর্তি ও সাংস্কৃতিক বিনির্মাণ পরবর্তীতে ভারতবর্ষে সিন্ধু সভ্যতা তৈরিকে সরাসরি প্রভাবিত করেছে। সমান মাপের পোড়া মাটির ইট তৈরি, পাথরের কুঠার, টারকুইজের পুঁতি (Turquoise), চকমকি পাথরের টুকরো বিভিন্ন প্রাচীন সমাধিতে পাওয়া গেছে। খ্রিষ্টপূর্ব চার হাজার পাঁচশত বৎসর আগে যখন মানুষ তাম্রযুগে প্রবেশ করে তখন জনবসতিগুলো গ্রাম হিসেবে বিস্তৃত হতে থাকে। মেহেরগড়ে (৭০০০-২৫০০খ্রি.পূ.) প্রাপ্ত নিদর্শনে দেখা যায় মানুষ এই সময় কৃষিকাজে পশুতে টানা লাঙল, চাকাওয়ালা গাড়ি, পালতোলা নৌকা, কুমোরের চাকা, প্রাথমিক ধাতু শিল্প, প্রাথমিক সৌর পঞ্জিকা ইত্যাদি খুব দ্রুত আবিষ্কার করতে থাকে। পরবর্তীতে নগর স্থাপনের পর তারা ভাষা ও লিপি, সংখ্যাগণনা, ওজন পরিমাপ উদ্ভাবন করে। অর্থাৎ সিন্ধু সভ্যতার (৩৩০০-১৭০০খ্রি.পূ.) বিকাশের পূর্বে তার প্রস্তুতি ভালমতোই হয়েছিল।
বইয়ের নামটি অভিনব। প্রাচীন সরস্বতী নদীর তীরে বিকশিত হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো সভ্যতাকে পণ্ডিতগণ সিন্ধুসভ্যতা নামকরণ করেছেন। কিন্তু সিন্ধুসভ্যতাবাসীগণ নিজেদেরকে কি নামে অভিহিত করত? প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে অনেক মাটির পাত্র ও সিলমোহর আবিষ্কৃত হয়েছে। সেগুলোর গায়ে বিভিন্ন চিহ্ন সম্বলিত আঁচড়, কারুকার্য রয়েছে। ধারণা করা হয় এগুলোই তাদের ভাষার লিপি। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে এই ভাষার পাঠোদ্ধার এখনও সম্ভব হয় নি। তাদের লিখিত কোন বৃহৎ রচনার সন্ধানও পাওয়া যায় নি। ফলে সিন্ধুসভ্যতাবাসীদের ভাষ্যে নিজেদের বর্ণনা কোথাও পাওয়া যায় না। তবে ৩০০০ খ্রিষ্টপূর্ব সময়কালের একটি খোদিত লিপি মেসোপটেমিয়াতে পাওয়া গেছে। সেখানে ‘মেলুহহা’ নামের কোন এক নগরীর কথা জানা যায়। বেশ কয়েকটি কিউনিফর্ম লিপিতে ‘মেলুহহা’বাসীর কথা উল্লেখ আছে। সম্রাট সারগন এর লিপি থেকে জানা যায় ‘মেলুহহা’ নামের কোন এক দেশের সাথে তার বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানী ও ইতিহাসবিদদের অধিকাংশ সরাসরি মহেঞ্জোদারোকে ‘মেলুহহা’ নামের দেশ বলে মনে করেন। তাই ধারণা করা হয় প্রাচীন সিন্ধুবাসীরা নিজেদেরকে ‘মেলুহহা’ নামেই পরিচয় দিত।
সিন্ধুবাসীগণ কেমন রাষ্ট্রতন্ত্রে বাস করত, সে সম্পর্কে কোন বিবরণ কোথাও পাওয়া যায় নি। আসলে বর্ণনামূলক কিছু তারা লিখেছেন কী না সে সম্পর্কে ইতিহাসবিদগণ নিশ্চিত নন। ফলে শাসক ও শাসনকার্যের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে একটি ধোঁয়াশা থেকেই গেছে। তবে ধারণা করা হয়, অন্যান্য সভ্যতার মত রাজা বা এই জাতীয় কোন শাসকের অধীনে তারা ছিল না। কারণ অহংকারপ্রকাশী কারুকার্যখচিত কোন সুউচ্চ দালান বা মিনার বা সৌধ বা অবকাঠামো সিন্ধু সভ্যতাতে একেবারেই অনুপস্থিত। তবে তারা যে একটি গণরাষ্ট্র জাতীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা নির্মাণ করেছিল তা বোঝা যায়। একই মাপের বাটখারা, একই ধরণের নগর পরিকল্পনা হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো দুই জায়গাতেই মিলেছে। কৃষিভিত্তিক গ্রামে ঘেরা নগরগুলোতে বসবাসকারীদের বেশিরভাগ ছিল শিল্পী। তারা ছোট আকারের বিভিন্ন কারুকার্যখচিত মনোহারী পণ্য তৈরি করত। এই পণ্যগুলোর কারণে গড়ে উঠেছিল ব্যবসায়ী শ্রেণী। পণ্যগুলো নিয়ে তারা সিন্ধুর বিভিন্ন উপনদী, সরস্বতী নদী ও তার বিভিন্ন শাখা নদী দিয়ে পালতোলা নৌকায় করে, নক্ষত্রের সাহায্যে দিক নির্ণয় করে মেসোপটেমিয়া, আধুনিক বাহরাইন, ওমান, ইরান, ইরাক, আফগানিস্থান প্রভৃতি জায়গায় যেত।
বৃহত্তর ভারতবর্ষের সাথে তাদের ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল। ভারতের তামা-রূপার খনি থেকে সংগৃহিত আকরিক মেলুহহাতে নিয়ে আসা হত। পৃথিবীর প্রাচীনতম কাঁচের নিদর্শন (১৭০০ খ্রি.পূ.) হরপ্পায় পাওয়া গেছে (পৃ-৩৯)। এইসব খনিজ ও মিশ্রিত বস্তু দিয়ে উৎপাদিত অলংকার ও বিনোদন দ্রব্যাদি ক্রয়ের উপযুক্ত রুচিশীল ও বিদগ্ধ অভিজাত মানুষ সিন্ধু সভ্যতাতে ছিল। নিত্য ব্যবহার্য ছোট ছোট প্রয়োজনীয় জিনিষের উৎকর্ষ সাধনের দিকেই সিন্ধু সভ্যতার মানুষের মনোযোগ বেশি ছিল।
সিন্ধু সভ্যতার পরিধি (সবুজ অংশ)। চিত্রসু্ত্র: উইকিপিডিয়া |
হাজারেরও বেশি ছোট বড় শহর ও বসতি নিয়ে সিন্ধু সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। পরিণত অবস্থায় এই সংস্কৃতির প্রভাববলয় ছিল প্রায় ১০০০০০০ বর্গ কিলোমিটার (পৃষ্ঠা-৩০)। এটা প্রাচীন মিসর ও মেসোপটেমিয়ার সম্মিলিত আয়তনের চাইতেও বড় ছিল। সিলমোহর, পোড়া ইট, আদর্শ ওজন, কুম্ভকারের ঘুরন্তচাকা, মাটির পাত্রে ময়ুর ও গাছের পাতার নকশা, সোজা ও চওড়া রাস্তা, বৃষ্টির জল নিষ্কাশনের ড্রেন, বাঁধানো কূপ, জলাধার, শস্যাগার, সুনির্দিষ্ট সুপরিকল্পিত শহর ছিল সিন্ধুসভ্যতার প্রধান পরিচয়। তাদের আরও বিশিষ্টতা এই যে, বহির্বিশ্বের সাথে তাদের কখনও যুদ্ধবিগ্রহ হয়নি, অন্তত তার কোন প্রমাণ পাওয়া যায় নি।
ছোট আকারের নৃত্যরতা নারীর মূর্তি পাওয়া গেলেও সংস্কৃতির অন্যান্য উপাদান যেমন সঙ্গীত, সাহিত্য ইত্যাদি সম্পর্কে সিন্ধু সভ্যতাবাসীদের সক্রিয়তার কোন নিদর্শন এখনও পাওয়া যায় নি। ১৮৪২ সালে চার্লস মেসন এর ভ্রমণ কাহিনীতে হরপ্পা নামক এক গ্রামের কাছে প্রাচীন শহরের ধ্বংসাবশেষের কথা জানা যায়। সে সময়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী লাহোর-মুলতান রেললাইন বসানোর কাজ করছিল। তারা প্রাচীন শহরের ধ্বংসাবশেষ থেকে পোড়া মাটির শক্ত ইট দিয়ে লাহোর-করাচির ১৫০ কিলোমিটার রেললাইনের কাজ করে। আশেপাশের গ্রামবাসীরা পূর্ববর্তী হাজার হাজার বৎসর ধরে পুরনো শহরের ইট নিজেদের গৃহ নির্মাণে ব্যবহার করত। নানারকম ধাতব বস্তু, শিল্পকর্ম অজ্ঞতাহেতু ধ্বংস করে ফেলত; বিভিন্ন লিপি ও চিত্র সম্বলিত পাথর বা ধাতুখণ্ড ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলত। ফলে ভূমির উপরে যে সব প্রাচীন নিদর্শন পাওয়া গেছে তা থেকে সাংস্কৃতিক পরিচয় বের করা দুষ্কর ছিল। তবে মাটির নীচে যা পাওয়া গেছে তাও কম নয়। ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত সিন্ধু অববাহিকায় হরপ্পার মত ১০৫৬টি (রামশরণ শর্মার মতে ২৮০০টি, পৃ-২৭) পুরনো শহর আবিষ্কৃত হয়েছে; এদের মধ্যে খনন হয়েছে মাত্র ৯৬টি। অর্থাৎ সিন্ধু সভ্যতার সম্পূর্ণ পরিচয় এখনও উদঘাটিত হয় নি।
সিন্ধু সভ্যতার পতন কীভাবে হল সে সম্পর্কে বিভিন্ন উৎস থেকে অনুমিত ধারণা বইতে রয়েছে। বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত নন, কিন্তু ব্রোঞ্জ যুগে ব্যবসা-বাণিজ্য কমে যাওয়া, যক্ষ্মা, কুষ্ঠ ইত্যাদি রোগের প্রকোপ এবং জলবায়ু পরিবর্তনকে প্রধান কারণ বলে তারা মনে করেন। বিশেষত জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে বৃষ্টি কমে যাওয়া, ফলে নদীর গতিপথ পরিবর্তন; সরস্বতী নদীর বিলুপ্তি আর এর ফলে নগরের চারপাশের কৃষিজমির উর্বরতা হ্রাস, খাদ্যের যোগান কমে যাওয়া, ঘনবসতির কারণে মহামারীর প্রাদুর্ভাব ইত্যাদিকে বিজ্ঞানীরা সিন্ধু সভ্যতা অবসানের কারণ বলে মনে করেন।
বইয়ের শেষে ইরফান হাবিবের ২টি ও রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ১টি মোট তিনটি রচনার সংযোজন বইটিকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
‘নগর বিপ্লব- এর অভিমুখে’ শীর্ষক রচনায় ইরফান হাবিব নগর হিসেবে বিকশিত হবার প্রসঙ্গগুলো আলোচনা করেছেন। ‘সিন্ধু সভ্যতা ও ঋগবেদ’ নামের রচনায় তিনি সিন্ধু সভ্যতায় ঋগবেদ এর প্রবাব না থাকা অর্থাৎ এটা বৈদিক সভ্যতার নিদর্শন নয় এ প্রসঙ্গে তথ্যসমৃদ্ধ আলোচনা করেছেন। ‘মুহেন-জো-দড়ো’ নামের রচনায় রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে তার অভিযান ও বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের বর্ণনা দিয়েছেন। মহেঞ্জোদারো প্রত্ন এলাকার গবেষণায় তিনি কিভাবে সংশ্লিষ্ট হলেন ও যেসব প্রত্ননিদর্শন পাওয়া গেছে তার একাংশের বিশ্লেষণ এই রচনার প্রধান আলোচ্য।
“প্রাচীন মেলুহা, সিন্ধু সভ্যতার ইতিবৃত্ত” বইটির প্রধান আলোচ্য বিষয় সিন্ধু সভ্যতা। ফলে সরস্বতী নদী তীরবর্তী হরপ্পা মহেঞ্জোদারো অঞ্চলে বিশেষজ্ঞদের সক্রিয়তা ও প্রাপ্ত নিদর্শনের আলোচনাই মূল প্রসঙ্গ। লেখক নিষ্ঠার সাথে প্রাপ্ত তথ্য ও তত্ত্বের সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন ৯টি অধ্যায়ে; এ পর্যন্ত সংগৃহীত নমুনা ও অনুমিত ধারণাগুলোর বিবরণ দিয়েছেন। আলোচনা প্রসঙ্গে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, রামশরণ শর্মা, শিরিন রত্নাগর, রণবীর চক্রবর্তী, দিলীপকুমার চক্রবর্তী, আবদুল হালিম ও নুরুন নাহার প্রমুখের উল্লেখে করেছেন। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ইরফান হাবিবের মতকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। মনে হয়েছে ইতিহাসবিদ ইরফান হাবিব দ্বারা লেখক বেশি প্রভাবিত বা অনুপ্রাণিত।
সর্বোপরি বইটি সম্পর্কে বলতে হয় প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার ইতিহাস হিসেবে বইটি মনোযোগ আকর্ষণের দাবী রাখে। প্রধানত অল্পবয়সী পাঠকের উদ্দেশ্যে রচিত হলেও অভিজ্ঞ পাঠক এই বই পাঠে সমৃদ্ধ হবেন। বিস্মৃতির গহ্বরে হারিয়ে যাওয়া সিন্ধু সভ্যতার ঔজ্জ্বল্যকে নতুনভাবে অনুধাবন করতে পারবেন।
প্রকৃতি পরিচয় প্রকাশন প্রকাশিত এই বইটি “জ্ঞান ও সভ্যতা গ্রন্থমালা” সিরিজের প্রথম বই। এই সিরিজে আর কি কি বই বের করা হবে তার কোন তালিকা বইয়ের কোথাও নেই। তবে এই গ্রন্থমালা সম্পর্কে পাঠকগণকে ধারণা দেয়ার জন্য “জ্ঞান ও সভ্যতা গ্রন্থমালা পরিচিতি” অংশে সম্পাদকদ্বয় ড. ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী এবং ফিরোজ আহমেদ যা বলেছেন তা পাঠ করা যেতে পারে। তারা বলেছেন-
মাতৃভাষায় বৈশ্বিক জ্ঞানের এক নির্বাচিত ভাণ্ডার নিয়ে এই ‘জ্ঞান ও সভ্যতা গ্রন্থমালা’। বৈশ্বিক জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং মানবসভ্যতা-সংস্কৃতির বিবিধ রতন এখানে থাকছে খুব সহজ ভাষায় লিখিত ছোট ছোট বইয়ের ভেতরে। গ্রন্থমালার ভাষা সহজ, কিন্তু ভাবনায় ঋদ্ধ। রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছেন তাঁর ‘বিশ্ববিদ্যাসংগ্রহ’ কিংবা ‘লোকশিক্ষা’ গ্রন্থমালার ভূমিকায়, বর্তমান গ্রন্থমালার উদ্দেশ্যও ‘বিদ্যার বহুবিস্তীর্ণ ধারার সঙ্গে শিক্ষিত-মনের যোগসাধন’ কিংবা ‘শিক্ষণীয় বিষয় মাত্রই বাংলাদেশের সর্বসাধারণের মধ্যে ব্যাপ্ত করে দেওয়া’। আধুনিক চিন্তার সাথে পরিচয় ঘটানো এই গ্রন্থমালার উদ্দেশ্য।
প্রকাশক ও সম্পাদকদ্বয়ের এই উদ্দেশ্য সফল হোক। বাঙালী পাঠকসমাজে জ্ঞানচর্চার আগ্রহ ও পরিধি বাড়ুক এই প্রত্যাশা করি। উল্লেখ্য যে গ্রন্থগত ওয়েবসাইটে এই ‘জ্ঞান ও সভ্যতা গ্রন্থমালা’র দ্বিতীয় বই আরাফাত রহমানের “মস্তিষ্ক, ঘুম ও স্বপ্ন” বইটি সম্পর্কে আমরা পূর্বেই আলোচনা করেছি। ঔৎসূক্য বোধ করলে দেখে নিতে পারেন “মস্তিষ্ক, ঘুম ও স্বপ্ন” প্রসঙ্গে বিজ্ঞানী “আরাফাত রহমান” -এর আলোচনা।
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম