প্রাণীজগতে মানুষ বুদ্ধিবৃত্তিতে সকলের চাইতে বেশি শক্তিশালী। শারীরিক শক্তিতে মানুষের চেয়ে বলবান প্রাণী অনেক রয়েছে। তাদের বেশিরভাগের সাথে মানুষ শারীরিক শক্তির লড়াইতে পেরে উঠবে না। কিন্তু মানুষ সবচেয়ে অসহায় যে প্রাণীর সামনে, তাকে সামনাসামনি দেখা স্বাভাবিক চোখে কখনই সম্ভব নয়। সেই অদৃশ্য প্রাণীটি হল ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া। মানুষের চর্মচক্ষু এদেরকে দেখতে পারে না; ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ ছাড়া অন্য অনূবীক্ষণ যন্ত্রে দেখাও কঠিন।
দৃষ্টিসীমার আড়ালে থাকা ভাইরাস ব্যাকটেরিয়াগুলো সবসময় মানুষের ক্ষতির চেষ্টা করে। কোন কোন অনুজীব এতই শক্তিশালী ও ভয়ংকর যে তা প্রাণঘাতী হতে পারে। বিশেষ যান্ত্রিক ব্যবস্থা ছাড়া মানুষের পক্ষে এই অনুজীবগুলোর সংস্পর্শ এড়ানো সম্ভব নয়। ঘর, বাড়ি, খাদ্য, পোষাক, পরিচ্ছদ, আসবাবপত্র, বাতাস, জল, গাছ, অন্যান্য পশুপাখি সবকিছুই এক বা একাধিক ভাইরাস বহন করছে। ফলে মানুষ না চাইলেও অনুজীবগুলো দ্বারা আক্রমণের শিকার হয়। ক্ষতিকর অনুজীবগুলো আক্রান্ত মানুষটির কোষে কোষে শুরু করে ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম। আক্রান্ত মানুষটি অতি সহজে দুর্বল হয়ে পড়ে। অনেক সময় ভাইরাসের আক্রমণের মুখে পরাজয় মেনে নিতে হয়। তবে সব ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া যে ক্ষতিকর তা নয়। অনেক প্রকারের অনুজীব আমাদের বেঁচে থাকতে সাহায্য করে। অনুজীবের এরকম বৈচিত্র্যপূর্ণ জগত নিয়ে তথ্যসমৃদ্ধ একটি বই “ভাইরাসের পৃথিবী”; মূল লেখক ‘কার্ল জিমার’, বাংলায় রূপান্তর করেছেন ‘সৈয়দ মনজুর মোর্শেদ’।
লেখক মোট বারটি শিরোনামে মানুষের ভয়ানক ক্ষতি করে এমন কয়েকটি ভাইরাস ও সেগুলোর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কাহিনী বলেছেন। ইবোলা বা সার্স-মার্স ভাইরাসের মত শক্তিশালী ভাইরাসের প্রাণঘাতী আক্রমণের সামনে মানুষ এখনো কোন কার্যকর প্রতিরক্ষা তৈরি করতে পারে নি। মানুষের সাথে ভাইরাসের সরাসরি সংস্পর্শের, যুদ্ধের কাহিনী রচনাগুলোতে সহজ ভাষায় ফুটে উঠেছে। সূচীপত্রপাঠ এ প্রসঙ্গে আবশ্যক।
- ছোঁয়াচে প্রাণরস: টোব্যাকো মোজাইক ভাইরাস এবং ভাইরাস জগতের আবিষ্কার
- রাইনো ভাইরাসের পৃথিবী জয়
- ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের বিরামহীন ছুটে চলা
- পেপিলোমা ভাইরাস এবং মরণঘাতি ক্যানসার
- আমাদের শত্রুর শত্রু: ব্যাকটেরিও ফাজ
- সমুদ্রে ফাজ ভাইরাসের রাজত্ব
- রেট্রো ভাইরাস: ভেতরকার পরজীবী
- যেভাবে এলো এইচআইভি ভাইরাস
- ওয়েস্ট নিল ভাইরাসের বিশ্বায়ন
- কি হতে যাচ্ছে পরবর্তী মহামারী?
- গুটিবসন্তের বিদায়
- বৃহদাকার ভাইরাস ও জীবনের সংজ্ঞা
আমরা আমাদের প্রতিপার্শ্বের মানুষকে নানা অজুহাতে শত্রু বানিয়ে নেই। পরস্পরের বিনাশ প্রত্যাশা আমাদের রাজনৈতিক নীতির অঙ্গ হয়ে গেছে। কিন্তু মানুষের আসল শত্রু মানুষ নয়। বেশ কিছু অনুজীব হাজার হাজার বৎসর থেকে মানুষের ঘাড়ে চেপে বসে আছে। মাঝে মাঝে সক্রিয় হয়ে উঠে মহামারী ঘটায়। মেরে ফেলে অসংখ্য মানুষকে। মানুষ হাজার বৎসর থেকে নানারকম প্রতিষেধক -ঔষধ-রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করেও জীবাণুগুলোকে একেবারে ধ্বংস করতে পারে নি। বরং জীবাণুগুলো মানুষকে নির্বংশ করার জন্য বিবর্তনের মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী হচ্ছে।
ভূমিকায় আর এক বিখ্যাত বিজ্ঞান লেখক আরাফাত রহমান বলেছেনঃ
সাম্প্রতিক বছরগুলোতেই আমরা দেখেছি জিকা ভাইরাস, ইবোলা ভাইরাস, সার্স ভাইরাস, নিপাহ ভাইরাস, সোয়াইন ফ্লু সংক্রমণ প্রাদুর্ভাবের খবর। এ নতুন রোগগুলো আমাদের আতঙ্কিত করে। আমরা ভেবে পাই না হঠাৎ করে এতো নতুন নতুন রোগ-ব্যাধির জীবাণু আসলো কোত্থেকে।
আমাদের সাধারণ দৃশ্যজগতের আড়ালে আত্মগোপন করা ভাইরাসগুলোকে মানুষ খুব সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চিনতে পেরেছে। অনুবীক্ষণ যন্ত্র বিশেষত ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ আবিষ্কারের পূর্বে ভাইরাসের জগত অনাবিষ্কৃত ছিল। মাত্র ১০-২০ বৎসর আগেও নতুন ভাইরাসের দেখা পাওয়া গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে ২০১২ সালে মধ্যপ্রাচ্যে একটি ভয়ানক ভাইরাস আক্রমণ করে। মার্স নামের এ রোগের কারণে মৃত্যুর হার ত্রিশ ভাগেরও বেশি। নির্দয় খুনী এই ভাইরাস সারা পৃথিবীর মানুষকে আক্রমণ করার জন্য ক্রমাগত শক্তিশালী হয়ে উঠছে। যে কোন সময় যে কোন সুযোগে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এই রোগটি আগে পরিচিত ছিল না। ফলে এর কোন প্রতিষেধক বা টীকা আবিষ্কার হয় নি।
ভয়ংকর টোব্যাকো মোজাইক ভাইরাস, রাইনো ভাইরাস, পেপিলোমা ভাইরাসকে মানুষ কেবল চিনতে শিখেছে। জানতে পেরেছে তাদের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য। ভাইরাসেরা তার পোষকের সাথে জিন বদলাতে পারে। নতুন জিনের ডিএনএ পেয়ে তাদের মধ্যে নতুন আরেকটি বৈশিষ্ট্য যোগ হয়। মানুষে ভাইরাসের জগতকে মাত্র চেনা শুরু করেছে। নবলব্ধ জ্ঞান ভাইরাসের সাথে লড়াইয়ে বেশি শক্তি যোগ করছে। ভাইরাসের সাথে মানুষের যৌথ জীবনযাত্রার এই কাহিনীগুলো খুব সাবলীল ভঙ্গিতে উপযুক্ত শব্দ নির্বাচন করে বাংলায় উপস্থাপন করেছেন সৈয়দ মনজুর মোর্শেদ। বিষয় নির্বাচন ও তার প্রকাশে অনুবাদক নিজগুণেই সফল। তার উদ্যোগে বাংলা ভাষা ভাইরাস সম্পর্কে তথ্যবহুল ও সকলের জন্য সহজবোধ্য একটি বই পেল। এই বই সম্পর্কে সম্পাদনা পর্ষদ বলেছেনঃ
কার্ল জিমার বিশ্ব জুড়েই অন্যতম জনপ্রিয় বিজ্ঞান লেখক। সাবলীল ভাষায় জটিলতম বিষয়গুলো নিয়ে অনায়াস আলোচনার বিরল গুণটি তার আছে। এ প্লানেট অব ভাইরাসেস নামের এই ছোট্ট বইটির আলোচনায় ওয়াশিংটন পোস্ট লিখেছিল, জিমার একশ' পাতায় যা গুছিয়ে বলেছেন, অন্যরা তা পাঁচশ পাতায়ও তা পরিষ্কার করতে পারবেন না।
জিমার এই গ্রন্থটিতে আমাদের প্রাত্যাহিক জীবনের গভীরে জীবাণুদের উপস্থিতি বিষয়ে আমাদের ধারণাকে একেবারে বদলে দিয়েছেন।
কিছু ভাইরাস নিজ স্বভাবের বৈশিষ্ট্যগুণে মানুষের উপকার করে। ‘ব্যাকটেরিও ফাজ’ বা ‘ব্যাকটেরিয়া খাদক’ এই ভাইরাস ব্যাকটেরিয়াদের ছিড়ে টুকরো টুকরো করে। ফলে ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে এই ভাইরাস দিয়ে চিকিৎসা একসময় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। এই ভাইরাস এখনও আমাদের উপকার করে চলেছে।
অসংখ্য ছবির ব্যবহার প্রাসঙ্গিক তথ্যগুলোকে সহজবোধ্য করেছে। পাঠক তার পাঠ এগিয়ে নেয়ার সাথে সাথে প্রবেশ করবেন ভাইরাসের রহস্যময় জগতে। কোন কোন বর্ণনা পড়ে যেমন শিহরিত হয়ে উঠতে হয়, তেমনি কোন কোন কাহিনী পড়ে আতঙ্কিত হয়ে যেতে হয়। মানুষ তার সীমাবদ্ধ জ্ঞান নিয়ে নানারকম রাসায়নিক দ্রব্য নিয়ে ভাইরাসকে আক্রমণ করতে থাকে। কিন্তু ভাইরাসগুলো ক্রমাগত নিজেদের কোষ ও তার ভিতরের জিনোম পাল্টাতে থাকে। অর্জন করে নতুন রূপ ও বৈশিষ্ট্য। মানুষ বারবার পরাজিত হতে থাকে। প্রথম সংক্রমণের সময় ভাইরাসরা সাধারণত কোন পশু বা পাখির শরীর থেকে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। মানুষের শরীরের কোষের ভিতরের ডিএনএ'র সাথে অনুজীবদের ডিএনএর পরিবর্তন ঘটায়। ভাইরাসের সাথে লক্ষাধিক বৎসর আগে থেকে মানুষের সহবাস। উপকারী ও অপকারী দুই প্রকারের অনুজীব নিয়ে মানুষ তথা প্রাণীজগতের প্রতিদিনের জীবনযাপন।
ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার সাথে মানুষের সম্পর্ক এত ঘনিষ্ট যে বহুবার তারা পরস্পরের জিন বিনিময় করেছে। ঘটে গেছে অনেক রকমের মিউটেশন। লেখকের ভাষ্যে বিষয়টা এরকমঃ
ভাইরাস ও অন্যান্য জীব এক সূত্রে গাঁথা। ভাইরাসের জীবন আছে কি নেই এই বিতর্কের চেয়ে এই অনুধাবনই আমাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমরা মানুষরা স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং ভাইরাসের জিনের মিশ্রণ। পৃষ্ঠা:- ১১৮
“ভাইরাসের পৃথিবী” বইটি পাঠ করার পর আমার মনে হয়েছে বাংলাদেশের প্রত্যেক পাঠাগারে এই বই থাকা প্রয়োজন। ভাইরাসের সাথে মানুষের এত দীর্ঘ সম্পর্কের বিষয়টি মানুষের জানা থাকা উচিত। মানুষের এই ঘনিষ্ট বন্ধু বা নির্মম শত্রুকে যত চেনা যাবে ততই নিজেকে নিরাপদ রাখা যাবে। মানবজাতি নতুন জ্ঞান নিয়ে পুরনো শত্রুর মোকাবেলায় নিরন্তর গবেষনা চালিয়ে যাবে। একথা নিশ্চিতরূপে বলা যায় যে, এই বইয়ের পাঠ একজন তরুণ কিশোর-কিশোরীকে ভাইরাসের রহস্যময় জগতের প্রতি কৌতুহলী করে তুলবে। সে আরও জানতে, উদ্ভাবন করতে চাইবে নতুন কিছু। বাংলাদেশের তরুণ বিজ্ঞানীরা আগামীর পৃথিবীতে ভাইরাসের সাথে সহাবস্থানের নতুন মূল্যায়ন করতে সক্ষম হোক এই বইয়ের হাত ধরে।
ভাইরাসের চরিত্র চিত্রণে প্রচ্ছদ শিল্পী মোস্তাফিজ কারিগর এর প্রশংসা করতেই হয়। প্রচ্ছদ দেখেই ভাইরাসের রূপ সম্পর্কে একটি প্রাথমিক ধারণা হয়ে যায়। বইয়ের বিষয়ের সাথে প্রচ্ছদের যথেষ্ট মিল আছে। প্রচ্ছদ দেখেই অনেকে ভাইরাসের পৃথিবীর অনাবিষ্কৃত জগৎ সম্পর্কে কৌতুহলী হয়ে উঠবে। আমি এই বইয়ের বহুল প্রচার প্রত্যাশা করি।
-#-#-#-#-#-#-
বই সম্পর্কে কয়েকটি প্রাথমিক তথ্যঃ-
ভাইরাসের পৃথিবী
মূল লেখক: কার্ল জিমারবাংলায় রূপান্তর: সৈয়দ মনজুর মোর্শেদ
প্রচ্ছদ: মোস্তাফিজ কারিগর
প্রকাশনায়: প্রকৃতি-পরিচয়, ঢাকা
প্রকাশকাল: ২০১৭
পৃষ্ঠাসংখ্যা: ১২০
মূল্য: ১৫০ টাকা
ISBN: 978-984-34-1979-8
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম