বিজ্ঞান বলতে আমরা সাধারণত ল্যাবরেটরিকেন্দ্রিক কিছু একটা বুঝে থাকি। আর বিজ্ঞানীদের সম্পর্কে আমাদের ধারণা একেবারে অদ্ভূত। কিন্তু বিজ্ঞান তো গবেষণাগারে বন্দী থাকার মতো বিষয় নয়। বরং আমাদের প্রতিটিদিনের প্রতিটি ক্ষণ থেকে শুরু করে পরিপার্শ্বের সবকিছুই বিজ্ঞানের আওতাধীন। মানুষ তার আদিম অবস্থা থেকে বর্তমানের আধুনিক জীবনে পৌঁছাতে সাহায্য পেয়েছে বিজ্ঞানের। জীবনের সাথে সরাসরি সংযুক্ত বলে সাধারণভাবে বিজ্ঞানকে আমরা আলাদাভাবে চিহ্নিত করতে পারি না। আর তাই প্রচলিত ইতিহাসে সাধারণ মানুষের বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের ইতিহাস সেভাবে লিখিত হয় নি। প্রচলিত ইতিহাসে গ্রীসের বিজ্ঞানচিন্তাকে কয়েকজন বিশিষ্ট চিন্তাবিদের নামের সাথে জড়িয়ে লেখা হয়েছে। কিন্তু যারা তাদের মত প্রখ্যাত হয় নি, চিন্তাজগতে নাড়া দেবার মত তত্ত্ব বা প্রযুক্তি আবিষ্কার করে নি, বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে তাদের কী কোনই অবদান নেই? এরকম একটি মনোভঙ্গি থেকে উত্তর খোঁজা হয়েছে “প্রাচীন বিজ্ঞান” বইতে। প্রাঞ্জল ভাষায় বিজ্ঞানের সেই চাপা পড়া ইতিহাসকে পুনরুজ্জীবিত করেছেন ‘খান রুহুল রুবেল’। আটটি অধ্যায়ে লেখক প্রাচীন ইতিহাসের পরতে পরতে লুকিয়ে থাকা বিজ্ঞানের ভূমিকাগুলোকে উন্মুক্ত করেছেন। স্পষ্ট করেছেন সভ্যতার সাথে বিজ্ঞানের গভীর সম্পর্ককে। সূচীপত্র দেখে খানিকটা ধারণা তৈরি করা যাক।
সূচীপত্র
- প্রথম অধ্যায়: বিজ্ঞান, বিজ্ঞানী, বিজ্ঞানের ইতিহাস
- দ্বিতীয় অধ্যায়: সভ্যতার সূচনা ও বিজ্ঞানের বিকাশ
- তৃতীয় অধ্যায়: লিপি
- চতুর্থ অধ্যায়: প্রাচীন মিশরে বিজ্ঞান
- পঞ্চম অধ্যায়: ব্যাবিলনের বিজ্ঞান
- ষষ্ঠ অধ্যায়: প্রাচীন ভারতে বিজ্ঞান
- সপ্তম অধ্যায়: প্রাচীন চীনে বিজ্ঞান
- অষ্টম অধ্যায়: প্রাচীন বিজ্ঞানের অবসান ও অন্ধকার বিরামকাল
সূচীপত্রেই বোঝা যাচ্ছে লেখক বিজ্ঞানচর্চায় ল্যাবরেটরিকেন্দ্রিক কার্যক্রমের চাইতে সাধারণ মানুষের সক্রিয়তার বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন।
আদিম মানুষ প্রয়োজনের তাগিদেই মানবেতর প্রাণী থেকে ক্রমান্বয়ে মানবীয় গুণ অর্জন করেছে। তারা পাথর ব্যবহার করেছে, যা মূলত যন্ত্রশিল্পের প্রথম পদক্ষেপ, আগুন ব্যবহার করেছে যা আসলে রাসায়নিক গবেষণার প্রাথমিক রূপ। তারা প্রকৃতির বিভিন্ন পরিবর্তনে আলোড়িত হয়েছে। তারা মেঘ দেখে বৃষ্টির আভাষ ধারণা করেছে। জন্ম হয়েছে প্রকৃতি বিজ্ঞানের। তারা হয়ত বিজ্ঞানের সংজ্ঞা জানত না। বিজ্ঞান কি তা বুঝত না। কিন্তু অচেতনভাবেই তারা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় ব্যবহার করেছে বিজ্ঞানের প্রক্রিয়া ও ফলাফল। বিজ্ঞানী বা গবেষক বলতে আলাদা কোন বিশিষ্টতা তাদের ছিল না। কারণ বিজ্ঞানী বা Scientist শব্দটি প্রথম ব্যবহৃত হয় ১৮৪০ সালে হোয়েওল এর লেখা ‘আরোহী বিজ্ঞানসমূহের দর্শন’ বইতে। আধুনিক বিজ্ঞান বলতে যা বুঝি তা বেশিদিন আগের নয়। পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকে ইতালীয় রেনেসাঁসের প্রভাবে প্রকৃতিকে পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণের এক প্রচেষ্টা শুরু হয়। বিজ্ঞানের প্রাথমিক এই শর্তসমূহকে প্রথম লিপিবদ্ধ করেন ফ্রান্সিস বেকন। এই ইতিহাসের শিক্ষা এই যে বিজ্ঞান চর্চা প্রথম গ্রীকরাই করেছে। গ্রীসের উত্থানের পূর্বে যা ছিল তা বিজ্ঞান নয়, বড়জোড় জ্ঞান হতে পারে। কিন্তু ইতিহাস ঘাটলে আমরা খ্রিস্টের জন্মের হাজার হাজার বৎসর আগে বিভিন্ন সভ্যতায় বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ডের নিদর্শণ পাই। লেখক ‘খান রুহুল রুবেল’ মূলত এই প্রসঙ্গটিকেই তার বইয়ের প্রধান বিবেচ্য করে তুলেছেন। তিনি প্রথমেই পরিষ্কার করতে চেয়েছেন বিজ্ঞানের সংজ্ঞার্থ। ‘বিজ্ঞান, বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞানের ইতিহাস’ নামক অধ্যায়ে তিনি স্বীকার করেন;-
...আমরা এখনো জানতে পারি নি, বিজ্ঞানের সংজ্ঞাটি কি, বা জ্ঞানচর্চার কোন বিভাগটিকে আমরা বিজ্ঞান বলবো বা বিজ্ঞান বলবো না। সত্যি কথা বলতে কি এই উত্তরটি কিন্তু খুব সহজ নয়। বিশেষায়িত যে কোন জ্ঞানকেই বিজ্ঞান বলা যেতে পারে। যেমন, সমাজবিজ্ঞানও বিজ্ঞান আবার পদার্থবিজ্ঞানও বিজ্ঞান। তবু, বিজ্ঞান বললে এখনকার সময়ে কেউ রাষ্ট্রবিজ্ঞান বা সমাজবিজ্ঞান বোঝেন না। সাধারণ লোকের বোধে, বিজ্ঞান বলতে মূলত প্রকৃতিবিজ্ঞানই বোঝায়… পৃষ্ঠা- ১৭
বিজ্ঞানের সংজ্ঞার্থ বর্ণনাশেষে লেখক প্রাচীন সভ্যতাগুলোর দিকে তাকিয়েছেন। বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক খননে প্রাপ্ত উপাদানসমূহের মধ্যে বিজ্ঞানের চিহ্ন চিহ্নিত করেছেন। তিনি স্পষ্ট উদাহরণ ও ছবিসহ দেখিয়েছেন, বিজ্ঞানের যে জ্ঞান, তা প্রাচীন সভ্যতাসমূহের বিকাশকালেও সক্রিয় ছিল। প্রাচীন মিশর, প্রাচীন ভারত, প্রাচীন চীন প্রত্যেক জায়গায় মানুষ যেভাবে সভ্যতা নির্মাণ করেছে তার পিছনে ছিল অভিজ্ঞতা, চর্চা, পরীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণে প্রাপ্ত বিশেষায়িত জ্ঞান। এই জ্ঞান ব্যবহার করে তারা নিখুঁতভাবে পরিমাপ করতে পেরেছে, প্রকৃতির পরিবর্তনকে অনুধাবন করতে পেরেছে, জনপদে পরস্পরের মধ্যে সমানভাবে প্রযুক্তিকে সহজলভ্য করতে পেরেছে। বিজ্ঞানের যে প্রধান দুটি ধাপ, সেই পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণের প্রতি দায়বদ্ধতা না থাকলে এসব সম্ভব হত না।
লেখক ‘খান রুহুল রুবেল’ গণিতের ছাত্র। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পঠিত বিষয়ের প্রতি তার ভালবাসা সম্ভবত প্রবল ছিল। সেজন্যই তিনি বিজ্ঞানমনস্ক ও যুক্তিপ্রবণ। শব্দচয়নে তিনি সতর্ক, তার শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধ। সব মিলিয়ে তার অনুভূতি ও উপলব্ধির বোধ বর্ণিল। এর স্পষ্ট প্রতিফলন আলোচ্য বইয়ের পাতায় পাতায় স্পষ্ট। শব্দ ব্যবহারে, ভাষাবৈশিষ্ট্যে লেখকের পারঙ্গমতা অসাধারণ। ফলে সাবলীল ভঙ্গিতে বাক্যগুলো যেন একের পর এক চোখের সামনে ভেসে আসতে থাকে। পড়তে গিয়ে কোথাও হোঁচট খেতে হয় না; বইটি পড়তে গিয়ে অভিধান ঘাড়ে করে নিয়ে বসতে হয় না। অনায়াস দক্ষতায় লেখক কাব্যের মাধুর্য মাখিয়ে প্রাচীন সভ্যতাগুলোয় বৈজ্ঞানিক কার্যক্রমের বিভিন্ন ঘটনাবলী বর্ণনা করে যান। বিজ্ঞানীর মণীষা দিয়ে তিনি আমাদের চোখে যা স্বাভাবিক তার অন্তরালের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা তুলে ধরেন। ফলে যিনি বিজ্ঞানের ব'ও জানেন না, তিনিও এই বই পাঠশেষে বিজ্ঞানমনস্কতায় জারিত হয়ে যাবেন, উপলব্ধি করতে পারবেন তার যাপিত জীবনের বৈজ্ঞানিক স্বরূপ।
প্রকৃতি-পরিচয় প্রকাশনী প্রকাশিত জ্ঞান ও সভ্যতা গ্রন্থমালার এটা সপ্তম বই। গ্রন্থগত ওয়েবসাইটে আমরা এই সিরিজের আরও তিনটি বই “প্রাচীন মেলুহা- সিন্ধু সভ্যতার ইতিবৃত্ত”, “প্রত্নচর্চায় বাংলাদেশ” এবং “মস্তিষ্ক, ঘুম ও স্বপ্ন” সম্পর্কে আলোচনা প্রকাশ করেছি। পেপারব্যাক মলাটের এই ‘প্রাচীন বিজ্ঞান’ বইটি ৭.১×৪.৬ ইঞ্চি আকারের হওয়ায় সহজে বহনযোগ্য। প্রচ্ছদ আকর্ষণীয়, ছাপানোর মান ভাল। সব বয়সের উপযোগী এই বইয়ের ব্যাপক পাঠ প্রত্যাশা করি।
প্রাচীন বিজ্ঞান
খান রুহুল রুবেল
প্রচ্ছদঃ সব্যসাচী হাজরা
প্রকাশকঃ প্রকৃতি-পরিচয়
প্রকাশকালঃ ২০১৭
পৃষ্ঠাসংখ্যাঃ ১০০
মূল্যঃ ১৩৫/= টাকা
ISBN:978-984-34-1783-1
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম