সাহিত্যের জগতে রয়েছে বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা ও ধারা, রয়েছে আঙ্গিকগত, স্বাদগত বৈচিত্র্য ও বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য। এগুলোর রূপভেদ এত ব্যাপক যে সাধারণ পাঠক তো বটেই, অনেকসময় অগ্রসর পাঠককেও অতল সংজ্ঞাসমুদ্রে খাবি খেতে হয়। এরকম বিভ্রান্ত অবস্থায় যে প্রকারের বই অনুসন্ধিৎসাকে তৃপ্ত করতে পারে, কূলহারা সন্তরককে তীরের দিশা দিতে পারে সেরকম একটি বই এই ‘সাহিত্য ও সমালোচনার রূপ-রীতি’। রচনা করেছেন বিশিষ্ট চিন্তাবিদ ও সাহিত্য বিশ্লেষক ‘উজ্জ্বলকুমার মজুমদার’।
সাহিত্যতত্ত্বের এই বইয়ের প্রধান প্রসঙ্গ হল সাহিত্যের রূপবৈচিত্র্য স্পষ্টীকরণ; সাহিত্যের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখাকে নির্দিষ্ট সংজ্ঞা কাঠামোয় সংঘবদ্ধ করা। সূচীপত্র দেখলে আলোচনার ব্যাপকতা ও গভীরতা হৃদয়ঙ্গম করা সহজ হবে। মোট আটটি অধ্যায়ে লেখক সাহিত্যতাত্ত্বিক প্রসঙ্গগুলোকে শ্রেণীবদ্ধ করেছেন। প্রত্যেকটি অধ্যায়ে প্রধান প্রসঙ্গের ছায়ায় প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন উপশাখা বা প্রকারভেদের বিশ্লেষণ করেছেন। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখাকে স্পষ্ট করে তুলতে উপশাখাগুলোর বিস্তারিত আলোচনাকে বাহুল্য ভাবেন নি। ফলে আগ্রহী পাঠক বিষয়ের সংজ্ঞার্থ অনুধাবনে বিভ্রান্ত হবেন না। সূচীপত্রকে বিস্তারিত বর্ণনা করলে লেখকের পর্যালোচনা প্রচেষ্টা স্পষ্টতর হবে।
দ্বিতীয় অধ্যায়: নাটক
লেখক নিজের বই সম্পর্কে ভূমিকায় বলেছেনঃ
‘সাহিত্য ও সমালোচনার রূপরীতি’ সাধারণভাবে সাহিত্যের বিচিত্র রূপভেদ এবং সমালোচনার নানা পদ্ধতি নিয়েই আলোচনা। কিছুটা ঐতিহাসিক দিক থেকেই কবিতা, নাটক, উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ ইত্যাদি যে বিচিত্র রূপ সৃষ্টি হয়েছে তার বিবর্তনের ধারাগুলি সংক্ষেপে বলার চেষ্টা করা হয়েছে বইটিতে। তার সঙ্গে সমালোচনার যে পদ্ধতিগুলি প্রাচীনকাল থেকে সাম্প্রতিককাল পর্যন্ত গড়ে উঠেছে তার উল্লেখযোগ্য কিছু পদ্ধতির কথাও সংক্ষেপে বলা হয়েছে। সৃষ্টি ও তার ব্যাখ্যার পেছনে কিছু আন্দোলনও অনেক সময়েই সক্রিয় থেকেছে বলে সেগুলিরও কিছু পরিচয় দেবার চেষ্টা আছে।
সাহিত্যের প্রধান তিনটি শাখা এই বইয়ের মূল অংশ জুড়ে রয়েছে। কবিতা, নাটক ও উপন্যাসের খুঁটিনাটি বিভিন্ন বিষয়কে তিনি নবীন পাঠকের কাজে সহজবোধ্য করে তুলতে চেয়েছেন। প্রয়োজনীয় বিবেচনায় সাহিত্যের আধুনিকতম শাখা ছোটগল্পের রূপবর্ণনাকে তিনি আবশ্যক মনে করেছেন। আর সাহিত্যের এই শাখাগুলোকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সমালোচককে সাহিত্যতত্ত্ব ও সাহিত্যদর্শনের যে বিষয়গুলো আত্মস্থ করতে হবে সেগুলোর পরিচয় দিয়েছেন পঞ্চম অধ্যায়ে। সমালোচনা কী সে বিষয়ে বিস্তারিত মতামত দিয়েছেন অষ্টম অধ্যায়ে। তিনি একে একে সমালোচকের সাহিত্যবোধ জাগরণের কথা বলেছেন, বিশ্লেষণ করেছেন কীভাবে মূল্যবোধ তৈরি হয় তার স্বরূপ। লেখকের ভাষায়ঃ
এই মূল্যবোধ সব সময়ে আরোপিত কোনো শাসনবিধি নয়, সাহিত্য পাঠের স্বতঃস্ফূর্ত সংস্কার থেকেই এই ভালো-মন্দবোধের একটা মাপকাঠি তৈরি হয়ে যায়। শিল্পসৃষ্টির মধ্যে কোনটি মহৎ, কোনটি মাঝারি বা কোনটি তুচ্ছ- এই পার্থক্য যে বোধ গড়ে তোলে তাকেই বলে সাহিত্যবোধ।
একই অধ্যায়ে লেখক সমালোচনার বিভিন্ন রীতিগুলোকে বিশ্লেষণ করেছেন। বিভিন্ন রীতিগুলোর বর্ণনার পাশাপাশি তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ পাঠক-সমালোচককে নিজের সাহিত্যিক বিচার সামর্থ সম্পর্কে সঠিক চিন্তাপদ্ধতির নির্দেশনা দেবে। এলোমেলো ভাবনার ঘূর্ণিবাতে কোন সাহিত্য আলোচনাকে পথ হারাতে দেবে না।
সাহিত্যের প্রসঙ্গগুলোকে পরিস্ফুট করতে এই বইয়ে প্রচুর উদাহরণ ব্যবহার করা হয়েছে। প্রাচীন সাহিত্য থেকে শুরু করে একেবারের সাম্প্রতিক লেখক কবির রচনা থেকে বিস্তর উদাহরণ আছে। প্রসঙ্গক্রমে ইউরোপীয় বিভিন্ন লেখক, সমালোচক, দার্শনিক, পণ্ডিতগণের সংজ্ঞা ও তত্ত্বের বিশ্লেষণ রয়েছে। প্রতিটি অধ্যায়ের শেষে তথ্যসূত্র না দিয়ে যে পৃষ্ঠায় প্রয়োজন সেই পৃষ্ঠার নীচেই ক্রমানুসারে লিখেছেন। ফলে পাঠককে বারবার তথ্যসূত্র মেলাতে গিয়ে একাধিক পৃষ্ঠা উল্টিয়ে অধ্যায়ের শেষে নম্বর খুঁজতে হয় না। গ্রন্থের শেষে রয়েছে একটি মূল্যবান গ্রন্থপঞ্জী। দেশবিদেশের বিভিন্ন পণ্ডিতের লেখা বই মন্থন করে যে সারবস্তুর সংগ্রহ তাঁর বইকে সমৃদ্ধ করেছে, সেসবের উল্লেখ গুরুত্বপূর্ণ বইকী। কবিতা, নাটক ও উপন্যাস সম্পর্কে আলোচনার পর প্রতিটি অধ্যায়ের শেষে মোট তিনটি পীঠিকার (বা ছক) সংযোজন বইটির গুরুত্বকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। এছাড়াও বইয়ের একেবারে শেষে রয়েছে একটি বর্ণানুক্রমিক সূচী। এটি ব্যবহার করে আগ্রহের বিষয়কে সহজে খুঁজে পাওয়া সহজ হয়। এই ধরনের সূচীর ব্যবহার করায় বইটির ব্যবহার উপযোগীতা বেড়েছে সন্দেহ নেই।
সাহিত্যের বিভিন্ন শাখা প্রশাখা সম্পর্কে বিস্তারিত পরিচয় জানতে আগ্রহী পাঠকের এই বই পড়া উচিত। সাহিত্যতত্ত্বের বিভিন্ন তথ্য ও তত্ত্বের সমন্বয়ে জটিল শিল্পপ্রসঙ্গগুলো লেখক সহজ ভাষায় উপস্থাপন করেছেন। আর তাই উৎসাহী পাঠক ‘উজ্জ্বলকুমার মজুমদার’ রচিত ‘সাহিত্য ও সমালোচনার রূপ-রীতি’ বই থেকে সাহিত্য সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞানের চেয়েও বিস্তারিত ও গভীরতর জ্ঞান অর্জনে সক্ষম হবেন।
=====================
সাহিত্য ও সমালোচনার রূপ-রীতি
উজ্জ্বলকুমার মজুমদার
প্রচ্ছদঃ মিলন
প্রকাশকঃ দে'জ পাবলিশিং, কলকাতা
প্রকাশকালঃ প্রথম প্রকাশঃ ২০০৩, তৃতীয় সংকলনঃ ২০০৯
পৃষ্ঠাসংখ্যাঃ ২৫৬
মূল্যঃ ১২৫ টাকা
ISBN: 81-295-0091-4
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম