শামীমা সীমা
উপন্যাসের প্রধান চরিত্র অনিমেষ গাঁয়ের আর দশটা মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তানের মতোই, দ্বন্দ্ব সংশয়ে যার বুকের গোপন কথা চড়ের মত নদীর বুকে জেগে উঠার আগেই বুকে মিলিয়ে যায়। লক্ষ্যহীন, গন্তব্যহীন অনেকটা ভীরু প্রকৃতির যুবক। একেবারেই গ্রামের সাদামাটা পরিবেশে নানান টানাপোড়নে যার বেড়ে উঠা। কৈশোরে মাধ্যমিকে ভর্তি হয়েই যে প্রেমে পড়ে উপন্যাসের নায়িকা সুরঞ্জনার। সুরঞ্জনা, আরেক মধ্যবিত্ত পরিবারের গোছানো, দৃঢ় সর্বংসহা ও বুদ্ধিমতী মেয়ে। অনিমেষ তথা অনি, সুরঞ্জনা তথা সুরোকে ভালবাসলেও স্থির হতে পারছিল না, বলতে পারছিল না নিজের ভালবাসার কথা, ভয় ও দ্বিধায়। অবশ্য অনি'কে দোষ দিয়ে লাভ নেই, অনেক বীরপুরুষও এহেনো কর্ম করতে যেয়ে হাত পা'য়ের কাঁপাকাপিতে গলদঘর্ম হয়ে ফিরে এসেছেন। অবশেষে ষষ্ঠ শ্রেণীর প্রেমের কুঁড়ি সমস্ত দ্বিধা সংশয় আর প্রতিকূলতা কাটিয়ে ফুল হয়ে ফুটল এস.এস.সি'র পূবালী বায়ে। নানা ঘাত-প্রতিঘাতে অনি টালমাটাল, লক্ষ্যহীন হয়েছে বারবার; কিন্তু সুরো ছিল পর্বতের মতোই অটল,ছায়ার মতো মিশে থেকেছে অনির সমস্ত ঝড়-ঝঞ্জায়।উপন্যাসে লেখক আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে চিত্রিত করেছেন নব্বই দশকের কোঠার মধ্যবিত্ত পরিবারের পারিবারিক জীবন, প্রেম ও শিক্ষা ব্যবস্থা। প্রকাশ পেয়েছে সে কালের এস.এস.সি ও এইচ.এস.সি পরীক্ষা ব্যবস্থা ছিল কতোটা জটিল ও এ্যাডভেঞ্চারাস।
নিজের উপর আস্থাহীনতা অনি'কে বারবার হতাশ করেছে, জীবন থেকে, সুরো'র থেকে বারবার পালাতে বাধ্য করেছে। বুকের ভিতর যার বাস তার থেকেই নিজেকে আড়াল করতে চেয়েছে,অথচ এর কোন সুনির্দিষ্ট জোরালো কারণ ছিল না। অন্যদিকে সুরো আপন ভালবাসার জোরে আত্মবিশ্বাসে বারবারই ক্ষমা করে গেছে অনি'কে, টেনে বের করে এনেছে নৈরাশ্য আর হতাশা থেকে, নিজের প্রাইভেট টিউশনির টাকা অনির গ্রাজুয়েশন এডমিশন ফী হিসেবে অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে অনির হাতে তুলে দিয়েছে। অথচ জোরালোভাবে অনিকে কখনো ঘর বাঁধার কথা বলেনি। ভিতরে ভিতরে নিজে ক্ষয়ে গেছে, তবু মুখ ফুটে অনি'র কাছে কিছুই চায়নি। এ যেন বাংলার চিরায়ত নারীরূপ। অঞ্জলি ভরে কেবল দিয়ে যেতে জানে। অনির এই টানাপোড়ন জীবনে আরেক বটবৃক্ষ ছিলেন অনি'র কাকীমা যাকে মা থেকে খুব একটা আলাদা করা যায় না।
অনি ও সুরোর প্রেমের অদৃশ্য বটবৃক্ষ হয়ে ছিলেন অনির পিসতুতো বোন পিংকিদি। এও এক অদ্ভুত চরিত্র। বাইরেটা শামুকের খোলসের মত শক্ত, ভিতরটা আবার শামুকের দেহের মতোই নরম। সময়ের পরিক্রমায় ওদের প্রেমের দুঃসময়ে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে সাদিয়া, অনির ক্লাসমেট। অনি খুব ভাল করেই জানত সুরো ছাড়া তার এজীবনে আর কোন গন্তব্য নেই। আর সুরোও জানত জীবনে মরনে সেও অনি'র, সে অনি যত দূরেই থাক না কেন। লেখক অবশেষে সুরোর আঁচলেই অনিকে বন্দি করেছেন।
হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া একটি উপন্যাস অসম্ভব দক্ষতার সাথে লেখক প্রতিটি চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। এ যেন সেই সময়ের প্রতিটি মানুষের নিজের জীবন, নিজের প্রেম, নিজের প্রতিদিনের কথা। তবে হ্যাঁ, পাঠক হিসেবে আমার একটু খারাপ লাগাও আছে। যেমন কিছু ঘটনা তিনি এড়িয়ে যেতে পারতেন, এতো কথা এত ঘটনার অবতারণা না করলেও পারতেন যেটা পাঠকে অনাগ্রহী করে ফেলতে পারে। এই উপন্যাস পড়ার পর লেখক পলাশ দেবকে একজন কথাসাহিত্যিক বলা যেতেই পারে।
===================
পোড়া চাঁদ
পলাশ দেব
প্রকাশনী: মুক্তচিন্তা, ঢাকা
প্রকাশ কালঃ ফেব্রুয়ারি ২০১৮
পৃষ্ঠাসংখ্যা: ১১২
মূল্যঃ ২১০ টাকা।
ISBN: 978-984-91762-3-7
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম