বাংলা ভাষার সূচনালগ্ন থেকেই সাহিত্যে প্রবাদ প্রবচনের দেখা পাাওয়া যায়। লেখকগণ অনেক সময় সচেতন ভাবে আলাদা করে প্রবাদ না লিখলেও তাদের কোনো কোনো বাক্য বা বাক্যাংশ প্রবাদের মর্যাদা পেয়েছে। প্রাচীনতম বাংলা সাহিত্যকীর্তি চর্যাপদ থেকে শুরু করে আধুনিক কালে রচিত সাহিত্যকর্মেও প্রবাদের দেখা মেলে। প্রবাদ এমন একটি বাক্যাংশ যা নিরাভরণভাবে সত্যি কথাটি জনসম্মুখে প্রকাশ করে। মানবীয় অনুভূতি, উপলব্ধ জ্ঞানের চরম সীমায় পৌঁছে একজন চিন্তাবিদ যে সত্য অনুধাবন করেন, যার বিকল্প খুঁজে পাওয়া যায় না, যা থেকে আর মুক্তি ঘটে না, তাই প্রবাদ। বাংলা ভাষায় প্রবাদ ও প্রবচন প্রায় সমার্থক শব্দ। প্র অর্থাৎ প্রকৃষ্ট এবং বাদ বা বচন অর্থাৎ বাক্য। অর্থাৎ প্রকৃষ্ট বাক্য বা বচনকে প্রবাদ বা প্রবচন বলে। হুমায়ুন আজাদ মনে করেন প্রবচন হল “এক ধরনের সংহত, তীক্ষ্ম, শাণিত, অন্তর্ভেদী মন্তব্য”।
ইংরেজি ভাষাতেও রয়েছে সাহিত্যের এই বিশিষ্ট রূপটির অনেক উদাহরণ। ফরাশী (French) ভাষাতেও সাহিত্যের এই বিশিষ্ট অনুষঙ্গের নানান রূপ দেখা যায়। তার মধ্যে একটি হল ম্যাক্সিম (Maxim)। অনেকের লেখাতে বিচ্ছিন্নভাবে ম্যাক্সিমের দেখা মেলে। তবে স্বতন্ত্রভাবে ম্যাক্সিম লেখার জন্য যিনি বিখ্যাত হয়েছেন, তাদের মধ্যে ‘লা রোশফুকো’ অন্যতম। তাঁর বিখ্যাত ম্যাক্সিমগুলো বাংলায় অনুবাদ করেছেন 'চিন্ময় গুহ'। ১৬৬৫ সালে প্রকাশিত প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় লা রোশফুকো লিখেছিলেন -
এ হল মনুষ্যহৃদয়ের এক আলেখ্য। এগুলি সবাইকে খুশি করবে না কারণ, এগুলি বড় বেশি বাস্তব, এগুলি তত তোষামুদে নয়। পৃ- ১
প্রকাশের সাথে সাথে লা রোশফুকোর ম্যাক্সিমগুলো প্যারিসের বিদ্যোৎমহলকে সচকিত করে তুলেছিল। ইংল্যান্ডের শিক্ষিত সমাজ হয়েছিল স্তম্ভিত। বেশিরভাগ পাঠকই প্রাথমিক পাঠে ম্যাক্সিমগুলোকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। কারণ রোশফুকো তার জীবনব্যাপী অভিজ্ঞতার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে এমন সব কথা উচ্চারণ করেছেন যা পাঠককে এক অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে ফেলে দেয়। আত্মসমালোচনার নির্মম দংশন বারবার ক্ষতবিক্ষত করতে থাকে। আঁদ্রে জিদ পর্যন্ত মনে করেন -
মন্তব্যগুলি আমাদের একটুও শান্তি দেয় না। পৃ- ২
কৌতুহল নিবারণের জন্য লা রোশফুকোর জীবৎকালে রচিত কয়েকটি ম্যাক্সিম পড়া যেতে পারে।
- আত্মাভিমানের মতো অত বড় তোষামোদকারী আর কেউ নেই।
- রাজপুরুষদের উদারতা ও দয়াশীলতা অনেক সময়ই জনগণের মন জয় করার ফন্দি ছাড়া আর কিছু নয়।
- অন্যের দুঃখ সহ্য করার মতো ক্ষমতা আমাদের আছে।
- সূর্য ও মৃত্যুর দিকে সরাসরি তাকিয়ে থাকা যায় না।
- সত্যিই যদি আমরা নির্দোষ হতাম, অন্যের দোষ দেখিয়ে অতটা উল্লসিত হতাম না।
- নিজেরা অহঙ্কারী না হলে অন্যের অহঙ্কার নিয়ে আমরা অভিযোগ করতাম না।
- নিজের সমস্ত যুক্তিকে অনুসরণ করার ক্ষমতা আমাদের নেই।
- সকলেই তাদের স্মৃতিশক্তি নিয়ে আক্ষেপ করে, কিন্তু বিচারশক্তি নিয়ে নয়।
- পরস্পরকে ঠকাতে না পারলে লোকে সমাজে টিকতে পারত না।
- তাঁরা যে আর খুব খারাপ উদাহরণ নন এই সান্তনাটুকু পাওয়ার জন্যই বৃদ্ধেরা অমন লম্বাচওড়া উপদেশ দিতে ভালোবাসেন।
- অন্যদের সামনে আত্মগোপন করে থাকতে আমরা এতই অভ্যস্ত যে শেষ পর্যন্ত নিজেদের কাছেও আমরা আত্মগোপন করে থাকি।
- প্রশংসা পাওয়ার জন্যই সাধারণত আমরা অন্যের প্রশংসা করে থাকি।
- অধিকাংশ লোকের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের পেছনে থাকে আরো বেশি সুবিধে আদায় করার গোপন ইচ্ছে।
- আমরা আমাদের ছোটখাটো দোষত্রুটিগুলি স্বীকার করি, যাতে লোকের ধারণা হয় যে আমাদের চরিত্রে কোনো বড় দোষ নেই।
- যাদের সঙ্গে আমাদের মতের মিল আছে শুধুমাত্র তাদেরই আমরা বিচক্ষণ মনে করি।
- আমরা যখন বিভিন্ন বয়সে পৌঁছাই তখন আমরা সেখানে আনকোরা নতুন, ফলে বয়স যাই হোক আমরা অনভিজ্ঞই থেকে যাই।
- যার প্রেম আগে সেরেছে সে বেশি সুস্থ।
- প্রেম ও বন্ধুত্ব দুটি ক্ষেত্রেই আমরা যতটুকু জানি তার চেয়ে যা আমাদের অজ্ঞাত তা নিয়ে আমরা বেশি সুখী।
- সত্যিকারের প্রেম যতই দুর্লভ হোক, সত্যিকারের বন্ধুত্বের চেয়ে নয়।
- মানুষে মানুষে ঝগড়াঝাঁটি মোটেই এত দীর্ঘস্থায়ী হত না, যদি দোষটা সত্যিই একপক্ষের হত।
এবার লেখকের মৃত্যুর পরে প্রকাশিত কয়েকটি ম্যাক্সিম পড়া যাক -
- মানুষের হৃদয়ের উপর আলোকপাত করা ম্যাক্সিমগুলি নিয়ে আমাদের এত চাপান উতোর, কারণ আমরা আবিষ্কৃত হতে ভয় পাই।
- শুধুমাত্র মুনাফা লোটার উদ্দেশ্যে আমরা অন্যের প্রশংসা করে থাকি।
- আমাদের আবেগগুলি বিভিন্ন রুচির আত্মাভিমান ছাড়া কিছু নয়।
- সুখের ভান করার জন্য আমরা যতটা কষ্ট করি সুখী হওয়ার জন্য ততটা করি না।
- খাঁটি বন্ধুত্বের মতো বড় ঐশ্বর্য আর নেই। অথচ আমাদের প্রিয় জিনিসগুলির ভেতর সেটিই সবচেয়ে কম আকাঙ্ক্ষিত।
- প্রেম ও বিচক্ষণতা একে অপরের জন্য নয়। ভালোবাসা বাড়লে বিচক্ষণতা কমে যায়।
- বই এর চেয়ে মানুষকে পড়া অনেক বেশি জরুরি।
- অন্যেরা আমাদের ভালোবাসে এটা ভাবার মতো স্বাভাবিক ও প্রতারক আর কিছু নেই।
আসলে মানুষ ও সমাজ সম্পর্কে সম্পূর্ণ নির্মোহ দৃষ্টি আত্মস্থ করতে পেরেছিলেন লা রোশফুকো। রাজকীয় জীবনযাপনের এক পর্যায়ে চরম নৈরাশ্য ও কর্মহীনতার অতল গহ্বরে নিমজ্জিত হয়েছিলেন। নিজের উদ্বেগ, শারীরিক অসুস্থতা ও মানসিক অবসাদকে ভুলতে শুরু করেছিলেন ম্যাক্সিম লেখা। এটা ছিল সে সময়ের শিক্ষিত অভিজাত সমাজের এক প্রিয় অবসর বিনোদন। ধারণা করা হয় কয়েকজন বন্ধু মিলে তারা ম্যাক্সিমগুলোকে রচনা করেছিলেন। তবে পরিমার্জনা করার ভার ছিল রোশফুকোর উপর। ৩৭১টি ম্যাক্সিম নিয়ে প্রথম সংকলন প্রকাশিত হয় ১৬৬৫ সালে। পরে বইটির আরো চারটি সংস্করণ বের হয় ১৬৬৬, ১৬৭১, ১৬৭৫ ও ১৬৭৮ সালে। ১৬৭৮ সালে ৫০৪টি ম্যাক্সিম নিয়ে প্রকাশিত পঞ্চম সংকলনটিই রোশফুকোর জীবিতাবস্থার শেষ সংস্করণ।
রোশফুকো মানবীয় চরিত্রের অন্ধকার দিক - যেমন ন্যাকামি, কাপট্য, নীচতা, ঈর্ষা, স্বার্থপরতা ও চাতুরিকে তাঁর ম্যাক্সিমগুলোতে বড় স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। বন্ধুত্বের প্রতি তার প্রবল আগ্রহ ছিল। বন্ধুত্বের মর্যাদা রক্ষার জন্য তিনি অনেক ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছিলেন। কিন্তু বন্ধুরা তার বিশ্বাসকে মূল্য দেয়নি। মানুষের প্রতি অকুণ্ঠ ভালবাসা তাকে যে আঘাত দিয়েছিল তার প্রতিবাদে রোশফুকো চেয়েছিলেন মানুষের মুখোশ খুলে ফেলতে। চেয়েছেন যুক্তি ও নীতির আড়ালে লুকিয়ে থাকা গুঢ় কারণগুলিকে উন্মোচন করতে। ফলে তাঁর ম্যাক্সিমগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে আমরা ত্রস্ত হয়ে উঠি। আমাদের আত্মাভিমান ও আত্মম্ভরিতার অন্তঃসারশূন্যতা সকলের সামনে নগ্ন হয়ে যায়।
বাংলা ভাষায় লা রোশফুকোর ম্যাক্সিমগুলো নিয়ে সম্ভবত খুব বেশি বই বের হয়নি। আজকের আলোচ্য বইটি রচনা করে চিন্ময় গুহ বাংলা সাহিত্যের অনুবাদ শাখায় বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি সংযোজন করেছেন। বইটিতে রোশফুকোর জীবৎকালের ৫০৪টির মধ্যে মোট ৩২৩টি ম্যাক্সিম প্রকাশ করা হয়েছে। রোশফুকো মারা যাবার পর আরও বেশ কয়েকটি ম্যাক্সিম বিভিন্ন বই ও নোট খাতায় খুঁজে পাওয়া গেছে। তার মধ্যে থেকে বাছাই করা আরও ৩৬ ম্যাক্সিম বইটিতে জায়গা পেয়েছে। যে ম্যাক্সিমগুলোকে অনুবাদ করা হয়েছে সেগুলোর মূল ক্রমসংখ্যার একটি তালিকা বইয়ের শেষে রয়েছে। বইয়ের শেষে রয়েছে ‘ফরাসী সাহিত্যে ক্লাসিসিজমের যুগ’ শিরোনামের একটি ঐতিহাসিক ঘটনাপঞ্জী। এই তালিকাতে ঐতিহাসিক ঘটনার পাশাপাশি ফ্রান্সের সমকালীন প্রধান সাহিত্যকর্মের শিরোনামটিও উল্লেখ করা হয়েছে। ফলে পাঠক এই অংশ থেকে ফ্রান্সের সাহিত্যিক বিবর্তনের একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র এক নজরে জেনে নিতে পারবেন।
চিন্ময় গুহ'র অনুবাদ ঝরঝরে। মূল ফ্রেঞ্চ ভাষা থেকে তিনি অনুবাদ করেছেন। ফলে ভাষার গতিময়তা কোথাও হোঁচট খায়নি। বাংলাভাষী পাঠকের এই বইটি পড়া উচিত। বাঙালি আত্মজীবনী লিখতে ভয় পায়। তার কারণ অনেকের কাছেই অজানা নয়। যারা জানে না যে কেন বাঙালি আত্মজীবনী লিখতে অনুৎসাহী তাদের লা রোশফুকোর ম্যাক্সিম পড়া উচিত। তাহলে অন্তত বুঝতে পারবে আমাদের অন্তসারশূন্যতার স্বরূপ কিরকম।
==============
লা রোশফুকোর ম্যাক্সিম
অনুবাদঃ চিন্ময় গুহ
প্রমা প্রকাশনী, কলকাতা
প্রথম প্রকাশঃ ১৯৯০
দ্বিতীয় সংস্করণঃ ১৯৯৭
পৃষ্ঠাসংখ্যাঃ ৪৮
মূল্য ২০ টাকা (রূপী নয়, টাকা লেখা আছে)
4 মন্তব্যসমূহ
বই অনলাইন পাওয়া যাবে কি
উত্তরমুছুনমন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। অনলাইনে পাওয়া যাবে কি না বলতে পারছি না। দুঃখিত।
মুছুনদাদা আমরা যখন বইটি কিনতে যায় বইটির(হার্ডকপি) বর্তমান বাজারমূল্যই ১৬০-১৮০টাকা করে রাখে দোকানীরা সেখানে ২০ টাকা বাজারমূল্য হয় কিভাবে?
উত্তরমুছুনধন্যবাদ। যে বইয়ের আলোচনা, সেটার প্রকাশকাল ১৯৯৭ সাল লেখা আছে। দামটাও সেই সময়ের।
মুছুনমার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম