‘চেতনায় ঐতিহ্য’ এ স্লোগানকে ধারণ করে সৃজনশীল প্রকাশনা সংস্থা দেশ পাবলিকেশন্স প্রতিবছরের ন্যায় এবারও তাদের ‘দেশ পান্ডুলিপি পুরস্কার ২০১৮’ ঘোষণা করেছে। এবছরের পুরস্কারপ্রাপ্ত পান্ডুলিপি ‘জলছাপ অন্তরজলে’ নিয়ে কিছু কথা বলবো। পাণ্ডুলিপিটি কবি হাসান হামিদের। তিনি প্রাণোচ্ছল এক তরুণ। একাধারে কবি, গবেষক ও কলামলেখক। যদিও এখন পর্যন্ত তাঁর কোনো কবিতার বই প্রকাশ হয়নি, না হলেও, দেশের প্রতিষ্ঠিত নানা দৈনিক পত্রিকা, সাহিত্য পত্রিকা ও লিটল ম্যাগাজিনে ছাপা হওয়া বেশকিছু কবিতার জন্য ইতিমধ্যেই তিনি পাঠকপ্রিয় হয়েছেন। এবং উঠতি তরুণ কবি হিসেবে কাব্যপাঠকের কাছে নিজের গ্রহণযোগ্যতা ও আগ্রহ তৈরি করতে পেরেছেন। এভাবে আমিও তাঁকে চিনি; আর বলতে দ্বিধা নেই তিনি আমার প্রিয় কবিদের অন্যতম।
কবি হাসান হামিদ পাণ্ডুলিপির এক কোণায় লিখেছেন,
আমার এই কবিতাগুলো বড়ো যত্নের, আদরের ও অত্যন্ত নাজুক। সমালোচলা তো নয়ই; একটু বকলেই কেঁদে ফেলবে। অতএব সাবধান।কোনো বিষয়ে আলোচনা মানে প্রশংসা ছাড়া আর কিছুই উচ্চারণ করা যাবে না এটা নয়। কথিত বিষয়ে মতপার্থক্য থাকলে তা খোলাখুলি প্রকাশের অধিকারও আলোচনা সমালোচনারই অংশ হওয়া চাই। আর সমালোচনা মানে গঠনমূলক আলোচনা; নিন্দা অবশ্যই নয়। তাই সমালোচনায় না পেলেই হয় ভয়। তবে সমালোচনা অবশ্যই গঠনমূলক আর প্রণোদনায়পূর্ণ হওয়া চাই। নিন্দা আর সমালোচনার বিষয়টা আলাদা। তবে আমি সজনীকান্তের মতো নেতিবাচক নির্দয় আর নিন্দুক হতে পারছি না। তবে আমাদের সমসাময়িক আত্মপরতার সামাজিক বাস্তবতায় জীবন ও সমাজে আজকাল মানুষের প্রতিভা বা যোগ্যতার যথাযথ স্বীকৃতি এখন খুবই বিরল। ‘সেলফি আর সেলফিস’ সমাজে আমি বা আমিত্বই বড় কথা। আমি একথা আজ না বলেই পারছি না যে, কবির মনের মধ্যে বয়ে যাওয়া ‘কবিতার এই বানের স্রোতকে’ সামাজিক যোগাযোগের ফেসবুকের এই মাধ্যমে সবটুকু প্রকাশ না করেই তিনি বোধহয় ভালো করেছেন এবং নিজের লেখা বইয়ের পান্ডুলিপিকে অত্যন্ত আত্মবিশ্বাস ও মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে থেকে নিজেকে যাচাই করতে একটা স্বনামধন্য প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের প্রতিযোগীতায় নিজেকে ঠেলে দিয়ে নিজের এবং কবিতার মঙ্গল করেছেন। তাঁর এই আত্মবিশ্বাস আমাকে মুগ্ধ না করে পারে না।
কবিতা যদিও একজন মানুষের কবি মনের তাৎক্ষণিক প্রকাশ, তারপরেও লেখালেখি আর তার প্রকাশ করার বিষয়ে, আমাদের বাংলা ভাষার অন্যতম পথিকৃৎ ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগে’র প্রতি নিবেদন, বা ‘যশের জন্য লিখিবেন না’ এর এক জায়গায় বলেছেন, ‘যদি বুঝতে পারেন যে লিখিয়া দেশের বা মানুষ্যজাতির কিছু মঙ্গল সাধন করিতে পারেন, অথবা সৌন্দর্য সৃষ্টি করিতে পারেন, তবে অবশ্যই লিখিবেন’। তিনি আবার বলেন, ‘যাহা লিখিবেন, তাহা হঠাৎ ছাপাইবেন না। কিছু কাল ফেলিয়া রাখিবেন। কিছুকাল পরে উহা সংশোধন করিবেন। তাহা হইলে দেখিবেন, প্রবন্ধে অনেক দোষ আছে। কাব্য-নাটক-উপন্যাস দুই-এক বৎসর ফেলিয়া রাখিয়া সংশোধন করিলে বিশেষ উৎকর্ষ লাভ করে। যাহারা সাময়িক সাহিত্যের কার্যে ব্রতী, তাঁহাদের পক্ষে এই নিয়ম রক্ষাটি ঘটিয়া ওঠে না। এ জন্য সাময়িক সাহিত্য, লেখকের পক্ষে অবনতিকর’।
আবার বলেছেন, ‘বিদ্যা প্রকাশের চেষ্টা করিবেন না। বিদ্যা থাকিলে তাহা আপনিই প্রকাশ পায়, চেষ্টা করিতে হয় না। বিদ্যা প্রকাশের চেষ্টা পাঠকের অতিশয় বিরক্তিকর এবং রচনার পারিপাট্যের জন্য বিশেষ হানিজনক’। আরও বলেছেন, ‘অলংকার-প্রয়োগ বা রসিকতার জন্য চেষ্টিত হইবেন না। স্থানে স্থানে অলংকার বা ব্যঙ্গের প্রয়োজন হয় বটে; লেখকের ভান্ডারে এ সামগ্রী থাকিলে, প্রয়োজনমতে আপনিই আসিয়া পৌঁছিবে—ভান্ডারে না থাকিলে মাথা কুটিলেও আসিবে না। অসময়ে বা শূন্য ভান্ডারে অলংকার প্রয়োগের রসিকতার চেষ্টার মতো কদর্য আর কিছুই নাই’।
আরেক জায়গায় বলেছেন, ‘সকল অলংকারের শ্রেষ্ট অলংকার সরলতা। যিনি সোজা কথায় আপনার মনের ভাব সহজ পাঠককে বুঝাইতে পারেন, তিনিই শ্রেষ্ঠ লেখক। কেননা লেখার উদ্দেশ্য পাঠককে বুঝান’। ‘সকল অলংকারের শ্রেষ্ট অলংকার সরলতা’; হাসান হামিদের কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে এই সরলতা আর চেনা শব্দের সহজ সরল আর মোহনীয় উপস্থাপনা। কবি হাসান হামিদও তাঁর কবিতায় সৌন্দর্য ও নান্দনিকতা তৈরিতে ব্যাপ্ত আছেন বলেই মনে করি।
একজন কবি, লেখক বা শিল্পী কি লিখবেন, কি আঁকবেন, কি প্রকাশ করবেন এটা নির্ভর করে তাঁর নিজস্ব স্বাধীন চিন্তাভাবনার উপর। তবে কাউকে এ ব্যাপারে পরামর্শ দেয়া নেহায়েত অযাচিত বিষয়। লেখা বা আঁকা যেমন শেখানো যায়না, তেমনি কবিকেও বলা যায় না তিনি কি লিখবেন বা তাঁর লেখার কতটুকু প্রকাশ করবেন। কবিতার বিষয় বৈচিত্র্য, সেটা নির্ভর করে তার সমসাময়িক প্রভাবনির্ভর প্রতিবেশের উপর। আর কবির নিজের উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতাই কবিতা সৃষ্টির প্রেক্ষাপট তৈরি করে। তবে কবিদের সর্বাধিক আকর্ষনের বিষয় সর্বকালেই যে নরনারীর চিরন্তন প্রেম ভালোবাসা ও বিরহের বিচিত্রভাষ্যে তা তাঁর লেখায় প্রকাশ পায়। যেখানে তিনি প্রকাশ করেন তাঁর মহিমাময় দীপ্তি ও তাঁর হৃদয়ের নিবেদনের নৈবদ্য। সেখানে তিনি ভাসাবেন পূর্ণিমা জ্যোৎস্নাজলে ভালোবাসার কুড়ানো বকুল। আবার ছলনাভরা ব্যথার দহনে আহত অভিমানে তিনিই ফোটাবেন নীলাদ্র যন্ত্রনার দশপদ্মফুল। তারপরেই চলে আসে তার স্বদেশপ্রেম ও প্রকৃতিপ্রেম আর তার চারপাশের যাবতীয় ঘটনা দুর্ঘটনা যুদ্ধবিগ্রহ আর্থ-সামাজিক মূল্যবোধের যে কোনো ক্ষয় অবক্ষয়, জীবনযুদ্ধের জয় পরাজয়ের বিষয়। আর যা হতে পারে তার দেশকালের বাইরের বিষয়ও।
একজন কবির প্রত্যেকটা কবিতা জন্মের সাথে সৃষ্টির যন্ত্রনাবোধ থাকাই স্বাভাবিক। সে যন্ত্রণার বহুবিচিত্র রূপ, গভীর থেকে গভীরতর তার দগ্ধ অনুভূতি। আছে আশা, হতাশা, বিরহ, বিষণ্ণতা, বিষাদ, নিঃসঙ্গতা বা একাকিত্ব বোধের অসাধারণত্ব। আছে বহুবর্ণিল এক স্বপ্ন। সে স্বপ্ন যেমন সীমাহীন ভালোবাসার ও নতুন পৃথিবী গড়ার, তেমনি তাতে থাকে অপূর্ণতার বেদনা, থাকে নানা অনুভূতি নিয়ে নানা প্রকাশ। প্রত্যেক কবির কবিতায় তার নিজস্ব জীবন ও জগৎকে প্রকাশ করেন। একজন কবি যখন তার শৈল্পিক চোখে দেখা ও জানার পরিণামেই তো কবিতার জন্ম হয়। আর সে জন্মের সঙ্গে রয়েছে যেমন আনন্দ, তেমনি এক সৃষ্টির প্রসব যন্ত্রনাবোধ। এজন্য কবিই হচ্ছেন তাঁর কালের কথক আর শ্রেষ্ঠ অগ্রগন্য মানুষ।
কবি হাসান হামিদ তাঁর ‘জলছাপ অন্তরজলে’ কবিতার পান্ডুলিপি বই আকারে মলাটবদ্ধ হয়ে বেরুবার আগেই একটা স্বনামধন্য প্রকাশনা সংস্থার পুরস্কার লাভ করায় তিনি কবি হিসেবে অনেক সৌভাগ্যবান বলতেই হয়। এবং এই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানই তাঁর বই মলাটবদ্ধ করে বৃহত্তর পাঠকের কাছে তাঁকে পৌছে দেবে। অথচ এখন এমনি এক সময় চলছে যে, এখনকার সময়ের তরুণেরা ‘যেকালে পদ্য রচনায় হাতেক্ষড়ি নেবার সঙ্গে সঙ্গেই কবিতার বই প্রকাশ করার জন্য অস্থির হয়ে পড়েন কবিযশোপ্রার্থী’। সেক্ষেত্রে হাসান হামিদ একজন ব্যতিক্রম তরুণ।
এই দেশে মুক্তচিন্তার মানুষদের জীবন এখন ‘শেকল পড়া হাত আর সেলাই করা ঠোঁট’ নিয়ে বেঁচে থাকার জীবন। তারপরেও এ দেশের তরুণেরা লিখছেন মাতৃভাষায় এবং কবিতার মতো শ্রেষ্ঠ শিল্প মাধ্যমে তাঁদের প্রেম ভালোবাসা দ্রোহ আর চারপাশের সমসাময়িক সমাজবাস্তবতাকে প্রকাশ করছেন কবিতায়। এজন্যই হয়তো বলা হয় কবি মানেই কালের কথক। তিনি তাঁর সময়কে, সময়ের সঙ্গতি অসঙ্গতিকে ধরে রাখেন তার কবিতায়।
কবি হাসান হামিদের প্রকাশিতব্য এই পান্ডুলিপিতে ছোট-বড় প্রায় অর্ধশত কবিতা স্থান পেয়েছে। কবিতাগুলোর মধ্যে অধিকাংশই উৎকৃষ্ট প্রেমের কবিতা। কোনো রকমের ভূমিকা বা ভনিতা না করেই তিনি তাঁর উৎসর্গপত্রে যেমন বলেছেন,
যে আমায় কবিতা লিখতে বলেছে,তাঁর প্রেম বড় বিচিত্র সরলতায় ভরপুর। পান্ডুলিপির শেষের ‘বঙ্গবন্ধু’ কবিতায় তিনি যখন বলেন,
সে হয়তো জানে না—
তার ভালোবাসা পেলেই
আমি একবাক্যে স্বীকার করবো—“পৃথিবী সুন্দর”।
এ শব্দটি কানে এলে প্রতিবারই-আমরা মুগ্ধ পাঠকেরা তখনই বুঝি কবিতার পৃথিবীতে কেউ এক নেমে আসছেন; আর তাঁর সরল শব্দের সবল নির্মাণ আমাদের বলে দেয়, তিনি তথাকথিত স্রোতে ভেসে যাওয়া অন্য দশ জনের চেয়ে আলাদা। তাঁর কবিতায় ভাবের সঙ্গে ভাষার একটা গভীর সম্পর্ক আছে; মনের ভাবটাকে যদি সঠিক ভাষায় প্রকাশ করা না যায়, তাহলে অনেক সময়ই ঘটনা আর চরিত্রের নানা সমাবেশকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা চলে না। কবি হাসান হামিদের সফলতা এখানেই। তিনি তাঁর মনের ভাবকে অত্যন্ত নান্দনিকতার সাথে নিজস্ব কাব্যভাষায় সঠিকভাবে প্রকাশ করে পাঠকের কাছে নিজেকে উপস্থাপন করতে পেরেছেন। কবি হাসান হামিদের বই অচিরেই বৃহত্তর পাঠকের কাছে মলাটবদ্ধ হয়ে আসবে এবং দেশের কাব্যজগতে হাসান হামিদ নিজের স্থান করে নেবেন বলেই আমার বিশ্বাস। আমি তাঁর প্রকাশিতব্য বইয়ের আগাম সাফল্য কামনা করি।
আন্দিজ পর্বত থেকে কেঁদে নামে আরও একটি নদী,
মাঝরাতে ঘুম ভাঙার মতো, স্বপ্ন-বাটি উল্টে পড়ার মতো,
মর্মর তুলে ঘেমে আমি নেয়ে যাই; এ শব্দ শুনলে
নিমেষে সুখী হই; স্বস্তির জায়নামাজে জীবন নামাই।
====================
হাসান হামিদের পাণ্ডুলিপি
‘জলছাপ অন্তরজলে’
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম