বিস্মৃতপ্রায় নারদ নদের বিস্তারিত পরিচয় রয়েছে ‘মাহবুব সিদ্দিকী’ রচিত “নারদ নদ” গ্রন্থে

বিস্মৃতপ্রায় নারদ নদের বিস্তারিত পরিচয় রয়েছে ‘মাহবুব সিদ্দিকী’ রচিত “নারদ নদ” গ্রন্থে

 

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। জালের মত বিছিয়ে থাকা অসংখ্য বৃহৎ ও ক্ষুদ্র শত শত নদ নদীবাহিত পলিমাটি দিয়ে গড়া এই বাংলার সবুজ শরীর। নদীবিধৌত এই জনপদের নদীগুলোর পরিচিতি সম্পর্কে বাংলা বইয়ের সংখ্যা বেশ কম। নদীগুলো আমাদের জীবনযাত্রায় নানাবিধ ভূমিকা রাখে। দেশের সার্বিক প্রাণপ্রবাহ প্রবহমান রয়েছে নদীর জলধারার গতিময়তার সাথে। কিন্তু জীবনদায়িনী এই নদীগুলো যেন আমাদের উপেক্ষার শিকার। নদীগুলো সম্পর্কে জানাশোনা এবং তাদের প্রতি আচরণে আমরা অনেকেই উদাসীন। আমাদের এই ক্ষুদ্রতা দূরীকরণে যে কয়েকজন মানুষ নিভৃতে কাজ করে চলেছেন তাদের মধ্যে মাহবুব সিদ্দিকী অন্যতম। তিনি ব্যক্তিগত আগ্রহ ও উদ্যোগে বাংলাদেশের নদীগুলো সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধিতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। এই লক্ষ্যে একের পর এক বই রচনা করে চলেছেন। আমরা তাঁর সবগুলো বইকে ‘গ্রন্থগত’ ওয়েবসাইটে উপস্থাপন করতে ইচ্ছুক। আজ হাতে নিয়েছি তাঁর “নারদ নদ” নামক বইটি। পদ্মানদীর একটি শাখা নদী হল ‘নারদ নদ’। রাজশাহী অঞ্চলের পুঠিয়া, নাটোর অংশে প্রবাহিত এই নদীটির অনেকাংশ আজ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বাকী অংশটুকু খাল, নালা, ছড়া ইত্যাদির রূপ ধারণ করে কোনমতে টিকে আছে। লেখকের শৈশবকালের অনেক সুখস্মৃতি নারদ নদের সাথে জড়িত। স্মৃতি রোমন্থনের সুখ কল্পনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে তিনি নারদ নদীর আদ্যোপান্ত চিনতে আগ্রহী হন। ‘প্রাককথন’ নামক ভূমিকাতে লেখেনঃ


বালক এবং কিশোর বয়সের সেই সুখ স্মৃতিগুলো রোমন্থন করতে করতে এক সময়ে প্রত্যয় জাগে নারদ নিয়ে লিখতে হবে।


ভূমিকাংশে তিনি নারদ নদীর পরিচয় দিতে গিয়ে প্রধান নদী পদ্মা সম্পর্কে ব্যাপক আলোচনা করেন। পদ্মা নদীর পশ্চিমাংশে ভারতে থাকা গঙ্গা নদীর উৎস ‘গোমুখ বিন্দু’ থেকে আলোচনা শুরু করেন। ধারাবাহিক বর্ণনার এক পর্যায়ে বিভিন্ন তথ্য দিয়ে প্রমাণ করেন গোয়ালন্দের সন্নিকটে ব্রহ্মপুত্রের সাথে মিলনস্থলের আগে থেকে রাজশাহী পর্যন্ত ধারাটির আসল নাম গঙ্গা। যদিও পদ্মা নামে এই অংশটির পরিচিতি, কিন্তু তা সঠিক নয়।

লেখক নারদ নদের পরিচিতি দিতে গিয়ে পরিপার্শ্বের ভৌগিলিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের প্রতিও আলোকপাত করেছেন। নারদ নদের অববাহিকায় বসবাসরত গ্রামের নানাবিধ বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন। প্রসঙ্গক্রমে এই অঞ্চলের প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের পরিচয় দিয়েছেন। আসলে লেকক ছয় বৎসরের অধিককাল ধরে নারদ অববাহিকায় পরিভ্রমণে প্রাপ্ত কোন তথ্যই বাদ দিতে চাননি। পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে প্রতিটি পর্যবেক্ষণের বিবরণ তার বইতে তুলে ধরেছেন।

সূচীপত্র পাঠে লেখকের আগ্রহের ধারা ও উপাদানসমূহ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাবে।


  • প্রথম অধ্যায়ঃ “নারদ” বাংলাদেশের প্রাচীনতম নদ
  • দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ ভৌগলিক বিবরণ: উৎস, শ্যামপুর, কাপাসিয়া, জামিরা, হলিদাগাছি, দীঘলকান্দি, তাতারপুর, রঘুরামপুর
  • তৃতীয় অধ্যায়ঃ নারদের শাখা সন্ধ্যা নদী, শিবপুর, ধনপতি সওদাগর, বিড়ালদহ, ভাড়োরা, কান্দ্রা, বালাদিয়ার
  • চতুর্থ অধ্যায়ঃ পুঠিয়ার জমিদার, মানসিংহ, মির্জা নাথান, মাসুম খান কাবুলী, ঈশা খান, মুসা খান, মুসা খান খাল
  • পঞ্চম অধ্যায়ঃ পাইকপাড়া নীলকুঠী, কাফুরিয়া, চাঁদপুর, প্রাণ কোম্পানি, নাটোর চিনি কল, শিল্প কারখানার তরল বর্জ্য
  • ষষ্ঠ অধ্যায়ঃ কানাইখালী, দত্তপাড়া, পানমোকাম, লালমণিপুর, ধরাইল, গুনাইখরা, শালিখা মণ্ডলপাড়া, মোহনা নন্দকুজা
  • সপ্তম অধ্যায়ঃ নারদের তৃতীয় ধারা, তৃতীয় চার্টার, নীলকুঠি, নীল বিদ্রোহ, পিটার গ্রান্ট, চন্দ্রখইর, শেখপাড়া, হয়বতপুর, অর্জুনপুর, হ্যালেঞ্চা, পানমোকাম
  • অষ্টম অধ্যায়ঃ উপসংহার

প্রথম অধ্যায়ে “নারদ” যে বাংলাদেশের একটি প্রাচীন নদ সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়েছে। ১৬৬০ সালে ওলন্দাজ গভর্ণর ফনডেন ব্রুকের মানচিত্রে নারদ নদের বর্ণনা পাওয়া যায়। এছাড়াও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বিভিন্ন কর্মকর্তা বাণিজ্য পথের বিবরণ দিতে গিয়ে নারদ নদের কথা বলেছেন। সে সময় নারদ নদ দিয়ে বাণিজ্য তরী, রাজা-মহারাজা, রাজ কর্মচারী, নওয়াবী ফৌজ সকলেই মুর্শিদাবাদ থেকে ভাগিরথী বেয়ে পদ্মা এবং নারদ হয়ে চলনবিলের মধ্য দিয়ে জাফরগঞ্জ এবং তারপর ঢাকায় যেতেন। বর্ণনাপ্রসঙ্গে লেখক পদ্মা নদীর বিভিন্ন শাখা নদীর কথা উল্লেখ করেন এভাবেঃ-

বরেন্দ্র অঞ্চলের প্রধান নদী হচ্ছে পৃথিবী খ্যাত পদ্মা। এর অন্য নাম হচ্ছে পদ্মাবতী, এর প্রাচীন নাম নলিনী। বাংলাদেশে এই নদী অববাহিকার আয়তন সবচেয়ে বেশি। এর উৎস থেকে সাগরমুখ পর্যন্ত যে আয়তন এর মতো বিশাল সমতল ব-দ্বীপ পৃথিবীর আর কোন নদীর নেই। পদ্মা নদীর শাখা নদীগুলো হলো ভৈরব, শিয়ালমারী, জলঙ্গী, মাথাভাঙ্গা, বড়াল, বারাহী, স্বরমঙ্গলা, নারদ, কমলা, গৌরী বা গড়াই, আড়িয়াল খাঁ, ইছামতি (পাবনা), হিসনা বা সাগরখালী, চন্দনা ইত্যাদি। পদ্মার প্রশাখা নদীগুলো হচ্ছে মুসা খান, নন্দকুজা, কুমার, কপোতাক্ষ, কালিগঙ্গা, সন্ধ্যা, বেগবতী, ডাকুয়া, বুড়িগড়াই, বুড়িশাল, আঠারোবাঁকী, চিত্রা, নবগঙ্গা, দয়া, মির্জা মাহমুদ ইত্যাদি। পদ্মার একমাত্র উপনদীর নাম মহানন্দা। মহানন্দার আরেকটি সুন্দর নাম হচ্ছে শ্রুতকীর্তি। (পৃষ্ঠা- ১৮)


দ্বিতীয় অধ্যায়ে নারদ নদের বর্তমান অবস্থার ভৌগলিক বিবরণ রয়েছে। রাজশাহী রেল স্টেশন থেকে ৮ কি. মি. পূর্বদিকে কাটাখালী দেওয়ান পাড়ার মোড়। সেখান থেকে ৩ কিলোমিটার দক্ষিণ পূর্বদিকে শাহপুর পশ্চিমপাড়া গ্রাম। নারদ নদীর উৎসমুখ এখানেই। নদীর অনেকাংশ এখন মাটিতে বুজে গেছে। বিভিন্ন জায়গায় মাটি ফেলে বাঁধ দিয়ে পুকুরের সৃষ্টি করা হয়েছে। গ্রামবাসী শুকিয়ে যাওয়া নদীর বুকে নানারকম সবজির চাষ করে। বিভিন্ন জায়গায় গড়ে উঠেছে আমবাগান। এসবে বিস্তারিত ও দীর্ঘ বর্ণনা রয়েছে এই অংশে।

প্রতিটি অধ্যায়েই নারদ নদের দু পার্শ্বের গ্রামগুলোর অবস্থা, ভৌগলিক বিবরণ, নদীখাতের বর্তমান অবস্থা ইত্যাদির বর্ণনা আছে। চাঁদপুর নামক গ্রামে কিশোয়ান এগ্রো লিমিটেড (বনফুল কোম্পানির শাখা) এর কারখানা রয়েছে। কারখানার বর্জ্য ফেলা হচ্ছে নারদ নদের উন্মুক্ত বুকে। একডালা নামক গ্রামের অংশে রয়েছে প্রাণ এগ্রো লিমিটেড এর প্রধান কারখানা। প্রাণ কোম্পানির এই কারখানা থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার লিটার দুষিত তরল বর্জ্য নারদ নদে ফেলা হচ্ছে। ফলে নদীর জলসহ পরিপার্শ্বের প্রকৃতি ভয়াবহভাবে দূষিত হয়ে গেছে। এই অভাবিত ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে পঞ্চম অধ্যায়ে।

লেখক প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা, জমিদারদেরকে নিয়ে প্রচলিত কাহিনী, ব্রিটিশ আমলে তৈরিকৃত ম্যাপ, ভ্রমণকারীদের বর্ণনা ইত্যাদি উল্লেখ করেছেন। স্থানভেদে নীলচাষের ফলে সৃষ্ট উত্তেজনা, ঘটনা প্রভৃতিরও বিবরণ লেখক বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন। নারদ নদের ইতিহাস ও নদীপথের বর্ণনায় লেখক কোথাও কোন কার্পণ্য করেন নি। যেখানে যতটুকু তথ্য উপাত্ত পেয়েছেন, তার সবটুকু বইতে তুলে দিয়েছেন।

বইয়ের প্রথম ফ্ল্যাপ থেকে কিছু বিবরণ উদ্ধৃত করি।


পদ্মার তীরবর্তী অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শাখা হচ্ছে নারদ। মানুষ প্রায় ভুলতেই বসেছিল যে, নারদের উৎপত্তি রাজশাহী শহরের নিকটবর্তী শাহপুর নামক গ্রাম সংলগ্ন পদ্মা থেকে। নারদের মোট তিনটি অংশ। প্রথমটি রাজশাহী অংশ। শাহপুর থেকে পীরগাছা/পাইকপাড়া। এই অংশটি ৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ। নারদের তৃতীয় অংশ আটঘড়িয়া (বড়াইগ্রাম খাল) থেকে পানমোকাম (নাটোর সদর থানা)। এই অংশের দৈর্ঘ্য ১৫ কিলোমিটার। নারদের তৃতীয় ধারা থেকে জন্ম নিয়েছে ছোট একটি নদী হ্যালেঞ্চা। নারদের মৃত প্রবাহ পথে হাজার হাজার একর খাস জমি সঠিক পর্যবেক্ষণের অভাবে বেদখল হয়ে যাচ্ছে। ...বিড়ালদহ নারদের মৃত খাত। নারদের একমাত্র শাখানদীর নাম সন্ধ্যা।

 

লেখকের ভাষাভঙ্গি বেশ সাদামাটা। সব বয়সের পাঠক লেখকের বর্ণনার সাথে একাত্ম হয়ে যাবেন। দীর্ঘ বর্ণনার ক্লান্তি পাঠককে আক্রান্ত করবে না। বইটির শেষাংশে একাধিক ম্যাপ রয়েছে। নারদ নদের বিভিন্ন অংশের ছবি রয়েছে বেশ কয়েকটি। প্রচ্ছদে নারদ নদের মানচিত্রের একাংশ ব্যবহার করা হয়েছে। বইয়ের বাঁধাই বেশ উন্নতমানের। মোটা সাদাকাগজে ছাপার মান ভাল। বহুব্যাবহারেও বইটি জীর্ণ হবে না। নদীমাতৃক দেশের মানুষের হৃদয়ে নদীর প্রতি ভালোবাসা জন্ম নিলে লেখকের পরিশ্রম সার্থক হবে।

====================
নারদ নদ
মাহবুব সিদ্দিকী
প্রচ্ছদঃ শিবু কুমার শীল
প্রকাশকঃ আগামী প্রকাশনী, ঢাকা।
প্রকাশকালঃ ২০১৩
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ৯৬
মূল্যঃ ১৮০ টাকা

মতামত:_

2 মন্তব্যসমূহ

  1. নারদ নদের উৎসমুখ আবার খনন করা হোক...

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. ধন্যবাদ। হ্যাঁ, নারদ নদের উৎসমুখ আবার খনন করা হোক...

      মুছুন

মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম