ড. রেজা খান ১৯৭৪ সালে সালিম আলীর অধীনে প্রথম বিদেশী ছাত্র হিসেবে পাখি বিষয়ে পিএইচডি গবেষণা করেন। তিন বৎসরের অধিককাল সময় ধরে গবেষণা কার্য চালানোর বিভিন্ন প্রয়োজনে পেয়েছেন সালিম আলীর একান্ত সান্নিধ্য। ড. রেজা খান ছিলেন তন্নিষ্ঠ শিক্ষার্থী। অধিত ও অর্জিত জ্ঞান পুনঃবিশ্লেষণে তার নিষ্ঠা ছিল অপরিসীম। তাই সালিম আলীর স্নেহ পেয়েছেন অবলীলায়। কার্যোপলক্ষে যখনই দুজন একত্রিত হয়েছেন, সালিম আলী নির্দ্বিধায় মনের দ্বার উন্মোচন করেছেন লেখকের সামনে। নিজের শৈশব কৈশোর তারুণ্যের বিভিন্ন ঘটনা বিস্তৃতভাবে বর্ণনা করেছেন। জানিয়েছেন প্রকৃতির প্রতি তাঁর অপার বিস্ময় ও আগ্রহের কথা। ড. রেজা খান নিজেও সালিম আলীর সঙ্গে প্রকৃতির সান্নিধ্যে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন। পাখি দেখার পাশাপাশি প্রকৃতির পরিবর্তন ও তার কার্যকারণ তাঁদের দৃষ্টি এড়ায়নি। আর এর সবকিছু অর্থাৎ সালিম আলীর নৈকট্যে ঘটিত বিভিন্ন ঘটনা ‘রেজা খান’ রচিত “পাখিবিশারদ সালিম আলী” বইয়ের প্রধান উপজীব্য। শিরোনামের কারণে বইটিকে জীবনীগ্রন্থের তালিকাভুক্ত করতে হবে। কিন্তু ভ্রমণকাহিনীর অনেক উপাদান এই বইয়ের পাতার পর পাতায় রয়েছে।
মূল বইয়ে প্রবেশের পূর্বে সূচীপত্র দেখে নেয়াটা আবশ্যক।
- লেখকের কথা
- প্রথম অধ্যায়
- প্রথম দেখা
- দ্বিতীয় অধ্যায়
- সালিম আলির সূচনালগ্ন
- তাঁর পারিবারিক পরিচয়
- বার্মায় বুনো জীবনযাপন
- তাঁর প্রকৃতিপ্রেম
- তৃতীয় অধ্যায়
- আমিই তাঁর প্রথম বিদেশি ছাত্র
- বাবুই পাখির গবেষণায় বৈপ্লবিক তথ্য সংগ্রহ
- চাকরিজীবন
- ভারতের প্রথম পাখির গাইড বই
- দুজনের যুগান্তকারী প্রথম হ্যান্ডবুক
- লোক ওয়ান থো- এক ধনকুবের প্রকৃতিপ্রেমী
- চতুর্থ অধ্যায়
- সালিম আলির উদ্ভাবন
- তাঁর জীবনে এ. কে.
- বনে-বাদাড়ে সালিম আলি
- তাঁর তত্ত্বাবধানে আমার পাখি-দর্শন
- কোটাগিরি সফর
- চিতল ওয়াক
- তাঁর ছাত্র ও কুনুরের পাখিপ্রেমীরা
- আমার কুনুরের বাসস্থান ও সুগাথন
- কালো-কমলা চটকের নতুন পরিচয়
- নীলাগিরি, না ব্রিটিশের ‘লিটল ইংল্যান্ড’
- তাঁকে নিয়ে কেরালায়
- পঞ্চম অধ্যায়
- সালিম আলির দুঃখ
- তাঁর বাংলাদেশ সফর
- আমার চোখে সালিম আলী
- পরিশিষ্ট
- সালিম আলির জীবনের কিছু বিশেষ দিনক্ষণ
- ড. সালিম আলির অধীনে যাঁরা ডক্টরেট করেছেন তাঁদের বর্তমান অবস্থান
- গ্রন্থপঞ্জি
দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন অংশে বিশেষতঃ ড. রেজা খানের গবেষণা এলাকার প্রকৃতি ও প্রাণীজগত এত বিস্তারিতভাবে বিবৃত হয়েছে যে এই বই পাঠে ভ্রমণকাহিনী পাঠের তৃপ্তি পাওয়া যায়। পাখি দেখতে যাওয়ার পথে দুইধারের দৃশ্যমান গাছপালার বিবরণ, চোখে পড়া পাখিদের বৈশিষ্ট্য ও আচরণের বর্ণনা, রাস্তার পাশের ছোট দোকান সব কিছুই লেখকের রচনাশৈলীর গুণে কল্পনাজগতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
ড. রেজা খান কালো ও কমলা চটক পাখি নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। তামিলনাড়ু রাজ্যের নীলগিরি জেলার ‘সিমস পার্কে’ এই পাখিদের আনাগোনা বেশি। লেখকের গবেষণাস্থল ছিল এখানেই। লেখক গবেষণাকার্যে সংশ্লিষ্ট থাকলেও সাহিত্যিকের সহৃদয়তা দিয়ে স্থানটির ভৌগলিক বৈচিত্র্য, অবারিত প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য, স্থানীয় মানুষদের বন্ধুবৎসল আতিথেয়তা সবকিছুর খুঁটিনাটি বর্ণনা দিয়েছেন। ছোটখাট বিষয়ের বিবরণ কোথাও কোথাও এত বিস্তারিত ভাবে দিয়েছেন যে অসহিষ্ণু পাঠক ক্লান্তিবোধ করতে পারেন। তবে পাখি ও প্রকৃতিপ্রেমী পাঠক হলে এক অপার্থিব বিস্ময়ে এক পাতা থেকে আরেক পাতায় সন্তরণ করতে থাকবে।
আমার কাছে মনে হয়েছে বইটি ঠিক সরাসরি ড. সালিম আলীর জীবনী নয়। আলাদাভাবে সালিম আলীর পারিবারিক জীবনবৃত্তান্তের উল্লেখ অবশ্য রয়েছে, তাছাড়াও রয়েছে তাঁর জীবনের পাখি সংশ্লিষ্ট নানা ঘটনা। তবে মূলত ড. রেজা খান যে সময়কালে বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটিতে সালিম আলীর অধীনে কালো ও কমলা চটক পাখি নিয়ে পিএইচডি গবেষণা করছিলেন, সেই সময়ের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা বইটির মূল উপাদান। একথা অবশ্য “লেখকের কথা” অংশে স্বীকৃত হয়েছে। লেখক জানানঃ
মূলত ড. সালিম আলীর সঙ্গে ওঠাবসার ফলে অর্জিত অভিজ্ঞতা, তাঁর কাছ থেকে শোনা তাঁরই গল্প ও জীবনকাহিনি, তাঁর বিষয়ে প্রকাশিত তথ্যাবলির ওপর ভিত্তি করে এই বই রচনা করেছি। সেইসঙ্গে তাঁর কাছ থেকে জ্ঞানের ছিটেফোঁটা যে পরশ পেয়েছি, যার যৎকিঞ্চিত দেশে ব্যবহার করেছি, যোগ করে সেসবও। ফলে আমার কিছু কথাও প্রসঙ্গক্রমে এ বইতে যুক্ত হয়েছে।
বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব ড. সালিম আলীর জীবনের বিভিন্ন দিক এই বইয়ের মাধ্যমে বাঙালি পাঠক জানতে পারবে। তিনি ব্যক্তিগতভাবে খুব নরম মনের মানুষ ছিলেন। পরিপাটি, গোছানো হয়ে থাকতে ভালবাসতেন। সময়জ্ঞান ছিল টনটনে। ছিলেন স্বল্পাহারী। কোনরকম বিলাসিতা পছন্দ করতেন না। ছোট কামরার এক কক্ষে থাকতেন। বিয়ে করেছিলেন, কিন্তু কোন সন্তান ছিল না। গণিত ভাল পারতেন না, কিন্তু ইংরেজিতে ছিলেন খুব দক্ষ। দারুণভাবে নিয়মানুবর্তিতা মেনে চলতেন।
ভারত উপমহাদেশে পাখির প্রতি সকৌতুহল অনুধ্যানের জন্য যে মানুষটি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন, তিনি সালিম আলী। নয় বৎসর বয়সে এয়ারগান দিয়ে চড়ুই পাখি মারা তাঁর কাছে খেলার মত আনন্দদায়ক ছিল। একদিন এক নিহত পাখিকে অন্যরকম দেখতে মনে হওয়ায় তার পরিচয় জানতে চাইলেন। মৃত পাখিটিকে নিয়ে উপস্থিত হন বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটিতে। কৌতুহলের ফলে এখানে এসে তিনি বিভিন্ন প্রজাতির পাখির স্টাফ করা নমুনা দেখতে পান। সেই সাথে সংরক্ষিত আরও বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর নমুনা তার মনে কৌতুহলের প্রস্রবণ সৃষ্টি করে। ছোট্ট বালক সালিম আলী সমিতিতে এসে যে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন, তা তাঁকে করে তোলে উপমহাদেশের আধুনিক পক্ষীবিদ্যার মূর্তপ্রতীক ও এনে দেয় ভারতীয় আধুনিক পাখিশাস্ত্রের প্রবর্তকের সম্মান।
ভিন্ন রকম দেখতে চড়ুই পাখির পরিচয় জানতে চাওয়ার ঘটনাটি তাঁর বুকে বপন করে দেয় পাখিদের প্রতি অপার ভালবাসা। সারাজীবন ধরে এই ভালবাসা ভারতবর্ষের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে দিয়ে গেছে। যার সর্বোচ্চ স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন ভারতের ‘পদ্মভূষণ’ ও ‘পদ্মবিভূষণ’ সম্মাননা।
সালিম আলীর পূর্বে সারা পৃথিবীতে পাখি বিষয়ক অধ্যয়ন ছিল মূলত চামড়া ছাড়িয়ে স্টাফ করে রাখা ও তার বৈজ্ঞানিক নাম, শরীরের মাপ, পালকের রঙ ইত্যাদি লিখে রাখা। সালিম আলীই প্রথম এর সাথে পাখি যে পরিবেশে থাকে তার পরিচয়, পাখির আচরণ, খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদিকে অধ্যয়নের বিষয় হিসেবে গ্রহণ করেন। বিশ্বের পাখি বিষয়ক গবেষকদের সামনে গবেষণার নতুন জানালা খুলে দেন।
তাঁর ‘বুক অব ইন্ডিয়ান বার্ডস’ বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৪১ সালে। এই বইটি ভারতীয় পাখিদের সম্পর্কে রঙিন ছবিযুক্ত প্রথম ফিল্ড গাইড। মাঠে গিয়ে পাখি দেখার জন্য গাইড বইয়ের যে প্রয়োজন সে ধারণা ড. সালিম আলীর উদ্ভাবিত। নিজে বই লিখে তিনি নিজের ধারণাটিকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। মাঠে গিয়ে তিনি পাখিদের যেমন দেখেছেন – গতানুগতিক বর্ণনা ও মাপজোকের বাইরে পাখিদের পরিবেশ, স্বভাব, অভ্যাস, আচরণ ও জীবন ধারণের ওপর প্রচুর তথ্য এই বইতে পরিবেশন করেন।
বাবুই পাখি প্রজনন ঋতুতে কীভাবে বাসা বানায় সে বিষয়ে প্রথম পর্যবেক্ষণের কৃতিত্ব সালিম আলীর। তিনি দীর্ঘদিন ধরে উচু মাচার উপর বসে তালগাছে বাবুই পাখিদের ধানের পাতা দিয়ে বাসা বোনা পর্যবেক্ষণ করেছেন। এ বিষয়ে বিস্তারিত অভিজ্ঞতা প্রথম লাভের কৃতিত্ব তাঁর। এরকম অনেক আকর্ষণীয় তথ্য ড. রেজা খানের বইতে রয়েছে। তাঁর চোখ দিয়ে সালিম আলীকে হয়তো সম্পূর্ণ দেখা যাবে না। কিন্তু যতটুকু জানা যায়, তাও কম নয়। ড. রেজা খান ছিলেন নিষ্ঠাবান গবেষক এবং বিনয়ী শিক্ষার্থী, ফলে পরিপার্শ্বের পাশাপাশি সালিম আলীর জীবনের অনেক ঘটনা তুলে এনেছেন ভালবাসা, শ্রদ্ধা ও নিষ্ঠা মিশিয়ে। যতটুকু জানা যায় তাতেই ড. সালিম আলীর প্রকৃতিপ্রেম, মননশীলতা, উদার মানবতা এবং মহত্বপূর্ণ বিরাট হৃদয়ের পরিচয় আমাদের নিকট উন্মোচিত হয়। আত্মম্ভরি আমরা তাঁর স্নেহপ্রবণ প্রশ্রয়ের পরিচয় পেয়ে বিনম্র হই। জ্ঞানচর্চায় আমাদের সীমাহীন দরিদ্রতা নিয়ে লজ্জিত হই।
প্রসঙ্গক্রমে লেখক ড. রেজা খান অভিজ্ঞতা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের অনিয়ম ও শিক্ষকদের নির্লজ্জ অহংকার নিয়ে কিছু কথা বলেছেন। বাহুল্য বিবেচিত হলেও ঘটনাগুলো আমাদের সামনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মননশীলতার অভাবের মূল কারণগুলোকে স্পষ্ট করে তোলে। আমরা বুঝতে পারি আমাদের জাতিগত বুদ্ধিবৃত্তিক অন্তঃসারশূন্যতার আসল সূত্র কোথায় নিহিত।
পাখিপ্রেমী প্রত্যেকের সংগ্রহে এই বই থাকা উচিত। ড. রেজা খানের ভাষাভঙ্গী আকর্ষণীয়। সহজ সরল শব্দ ও বাক্যে তিনি মনের ভাব প্রকাশ করতে পারেন। তাঁর রচনা সব বয়সী পাঠকের উপযোগী। বইয়ের পৃষ্ঠা সাদা, ছাপার মান ও বাঁধাই উন্নত। শক্ত মলাট ব্যবহার করায় বইয়ের স্থায়ীত্ব দীর্ঘ হবে। প্রচ্ছদ ও ভেতরের পাতায় পাতায় নান্দনিক অলংকরণ করেছেন মাসুক হেলাল। তাঁর রুচিবোধের প্রশংসা করি। বাংলাদেশের প্রতিটি পাঠাগারে এই বই রাখা প্রয়োজন। নতুন প্রজন্ম তাদের পরিপার্শ্বের পাখিগুলোকে চিনতে শিখুক, সালিম আলির জীবনাদর্শে উজ্জীবিত হয়ে পাখি ও প্রকৃতির প্রতি অবারিত ভালবাসা অর্জন করুক এই প্রত্যাশা করি।
পাখি বিষয়ে পাঠকের উৎসাহকে প্রশ্রয় ও তৃপ্ত করতে সালিম আলী ( Salim Ali) লিখিত 'বুক অব ইন্ডিয়ান বার্ডস' (Book of Indian Birds) বইয়ের archive.org ওয়েবসাইটে থাকা একটি ডাউনলোডযোগ্য পিডিএফ ফাইল যুক্ত করা হল। বইটি কোনরকম কপিরাইট আইনের আওতায় থাকলে আমাদের জানান। আমরা যথাশীঘ্র প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
============
পাখিবিশারদ সালিম আলী
রেজা খান
প্রচ্ছদ ও অলংকরণঃ মাসুক হেলাল
প্রকাশকঃ প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা।
প্রকাশকালঃ ২০১৮
পৃষ্ঠাসংখ্যাঃ ১৬০
মূল্যঃ ৩২০ টাকা
ISBN: 978 984 93189 6 5
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম