বাংলাদেশের জনবসতির ইতিহাস বেশ পুরনো। কিন্তু কত পুরনো? আমাদের প্রাচীন পূর্বপুরুষ সম্পর্কে বিদেশী আগ্রাসনকারীদের মনোভঙ্গি প্রায় একই। গত হাজার বৎসরে এদেশে আগত বিদেশীরা কেউ বাঙালি জনগোষ্ঠীকে সম্মান করে নি। বিভিন্ন অজুহাতে বাংলাদেশ অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষকে অপমান করার সুযোগ খুঁজেছে। সমকালের ইতিহাস বিস্মৃত আমরা বিদেশী অপপ্রচারকেই মান্য ভেবেছি। কিন্তু স্রোতের বিপরীতে চলা গবেষকগণ বাঙালির প্রাচীন কীর্তির মহিমা উদ্ভাবন ও প্রকাশ করে বিদেশীদের অপপ্রচারের যথোপযুক্ত উত্তর দিয়েছেন। এমনই একজন সংস্কৃতিপ্রেমী ইতিহাস সচেতন মানুষ সুফি মোস্তাফিজুর রহমান।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক তিনি। আত্মপরিচয় অন্বেষণের আকাঙ্ক্ষা তাঁকে সবসময় আলোড়িত করে। প্রবীণ পূর্বপুরুষের বুদ্ধিবৃত্তিক কীর্তি অন্বেষণে চষে বেড়ান সারা দেশ। তাঁর হাতে উন্মোচিত হয়েছে আমাদের প্রাচীন ইতিহাসের নানাবিধ গৌরবগাঁথা। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে অবহেলিত অনাবিষ্কৃত পুরনো স্থাপনাগুলোর বৈচিত্র্যময় পরিচিতি উদ্ভাবনে সুফি মোস্তাফিজুর রহমান একের পর এক ক্লান্তিহীন কার্যক্রম বজায় রেখেছেন। তাঁর মাধ্যমে বিশ্ববাসী জানতে পারে বাঙালি ২৫০০ বৎসর আগেও সভ্যজীবন যাপন করত। তৈরি করেছিল এক সমৃদ্ধ জনপদ, শিল্পনগরী। বাঙালির পূর্বপুরুষের তৈরিকৃত সামগ্রী সমুদ্রগামী জাহাজে করে রপ্তানী হত পশ্চিম এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপে। তিনি মাটির নীচে ঘুমিয়ে থাকা উয়ারী বটেশ্বর শিল্পনগরীর প্রাণ জাগিয়ে তোলেন। বিশ্ববাসী পরিচিতি হয় এ সৃষ্টিশীল পরিশ্রমী বাঙালি জাতির সাথে।
বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্যের এরকম কয়েকটি নিদর্শন একত্রিত করে তৈরি হয়েছে “বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক উত্তরাধিকার” বইটি। লেখক সুফি মোস্তাফিজুর রহমান ভূমিকায় বলেন -
প্রত্নতাত্ত্বিক উত্তরাধিকারে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে আমাদের এই বাংলাদেশে মানববসতি গড়ে উঠেছে। এরপর ধারাবাহিকভাবে সংস্কৃতি-সভ্যতা বিকশিত হয়েছে দেশের আনাচে-কানাচে কখনো অনুকূল কখনো বা প্রতিকূল পরিবেশে। অপ্রতুল গবেষণা, প্রকাশনা ও ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থার কারণে এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত গৌরবময় প্রত্নতাত্ত্বিক উত্তরাধিকারগুলো আমরা খুব একটা জানি না।
মানুষকে জানানোর উদ্দেশ্যেই “বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক উত্তরাধিকার” বইয়ের অবতারণা। বড় বড় গবেষক বা শিক্ষক নয়, পর্যটক ও শিক্ষার্থীদের কথা মাথায় রেখে এই বই প্রস্তুত করা হয়েছে। ‘সাংস্কৃতিক পর্যটন শিল্পের বিকাশে স্থানীয় অধিবাসীদের যুক্ত ও সচেতনতা বৃদ্ধির কৌশল নির্ধারণ কর্মসূচি’ শিরোনামে বাংলাদেশ পর্যটন মন্ত্রণালয়ের একটি কর্মসূচি বাস্তবায়ন কাজে মহাস্থানগড় (পুণ্ড্রনগর), পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার (সোমপুর মহাবিহার), কান্তজি মন্দির ও সাতগম্বুজ মসজিদ নিয়ে লেখক চারটি বুকলেট রচনা করেন। পরবর্তীতে উয়ারী-বটেশ্বর, বিক্রমপুর ও ময়নামতি-লালমাই-সমতট -কে যোগ করে বর্তমান বইটি প্রস্তুত করা হয়।
সূচীপত্রের উপর চোখ বুলালে বইতে উপস্থাপিত প্রসঙ্গগুলো স্পষ্ট হবে।
- উয়ারী বটেশ্বর
- বাংলাদেশের প্রাচীনতম নগর
- মহাস্থানগড় (পুণ্ড্রনগর)
- প্রজার কল্যাণে চুনাপাথরে খোদিত রাজাদেশ
- লালমাই-ময়নামতি-সমতট
- আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় শহর
- বিক্রমপুর
- অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান
- বিশ্ব ঐতিহ্য পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার (সোমপুর মহাবিহার)
- ‘জগতাং নেত্রৈকবিশ্রাম-ভূ’ জগতের নয়নের একমাত্র দর্শনীয় বস্তু
- বিশ্ব ঐতিহ্য ঐতিহাসিক মসজিদের শহর বাগেরহাট
- খান জাহানের ষাট গম্বুজ মসজিদ
- কান্তজি মন্দির
- পোড়ামাটির বিস্ময়
৯৬ পৃষ্ঠার বইয়ের প্রতিটি পাতায় রঙিন ছবি রয়েছে। অনেকগুলো দুষ্প্রাপ্য ও চমকপ্রদ আলোকচিত্র ব্যবহার করা হয়েছে; অধ্যায় সংশ্লিষ্ট রঙিন ছবিগুলো কখনও কখনও একাধিক পৃষ্ঠায় ছাপানো হয়েছে। প্রত্নস্থান খনন কাজ শুরু করার পূর্বের ও খনন চলাকালীন চিত্র, অর্ধসমাপ্ত খনন নিদর্শন, প্রাপ্ত প্রত্নবস্তু, প্রাচীন মানুষের ব্যবহার্য নানা সাংসারিক দ্রব্য ও যুদ্ধাস্ত্র, তাম্রশাসন, ব্রোঞ্জ ও পাথরের বিভিন্ন মূর্তি ইত্যাদির রঙিন স্পষ্ট ছবি ব্যবহারে বইটি সন্ধিৎসু পাঠকের কাছে আকর্ষণীয় ও উপভোগ্য হয়েছে। বড় বড় ছবির ব্যবহার, পাতায় পাতায় নান্দনিক অলংকার, তথ্যসমৃদ্ধ আলোচনা ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যের কারণে বলা যায় এটা মূলত উৎসাহী পর্যটকের জন্য হ্যান্ডবুকের কাজ করবে।
প্রত্নস্থানের ইতিহাস, খননকার্যের বিবরণ, সহায়তাকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির উল্লেখ, উৎখননে প্রাপ্ত দ্রব্যের বর্ণনা এবং একাধিক চিত্রের ব্যবহার সাধারণ পাঠকের কাছে বইয়ের প্রামাণ্যতা বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। স্থাপত্য কাঠামোর বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ, গঠনশৈলির বৈচিত্র্য ইত্যাদির উপস্থাপন পাঠককে আলোচ্য অধ্যায় সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞানটুকু দেবে।
সুফি মোস্তাফিজুর রহমান শুধুমাত্র শিক্ষক নন, আত্মপরিচয়ের ঐতিহ্য সন্ধানে তিনি প্রবলভাবে আগ্রহী ও পরিশ্রমী। তিনি মাঠ পর্যায়ের প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষকের সংকীর্ণ পরিচিতি ছাপিয়ে উঠেছেন। দেশের ঐতিহ্য-স্বার্থ রক্ষা ও পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর মননে ঐতিহ্য সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে নিরন্তর সক্রিয় থাকেন।
এই বইয়ের আকার বেশ বড়; দৈর্ঘ্যে সাড়ে নয় ইঞ্চি ও প্রস্থে সাড়ে আট ইঞ্চি আকারের। আর্ট পেপারে ছাপানো বইটির ওজনও কম নয়। বড় ম্যাগাজিনের আকার, আবার মোটা কাগজ ও মোটা মলাট সবমিলে পৌনে এক ইঞ্চি মোটা ওজনে ভারী বইটি সহজে ব্যবহার করা কষ্টকর। শুয়ে শুয়ে পড়া তো বেশ কঠিন হবে। এই বই আসলে টেবিলে রেখে পড়ার উপযোগী।
স্বল্পকথায় বাংলাদেশের প্রধান প্রধান প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোর পরিচয় এই বই থেকে পাওয়া যাবে। ছবিগুলো দেখে স্বল্পসময়ে বাংলাদেশের প্রাচীন সভ্যতার অনেক উপাদানকে চেনা যাবে। জাতির প্রাচীন পরিচয় পেতে আগ্রহী দেশী বিদেশী পর্যটক ও উৎসাহী পাঠককে এই বই অল্পায়াসে তৃপ্ত করবে। বইটির দাম ৮০০ টাকা হওয়ায় অনেক পাঠক হয়তো কিনতে আগ্রহী হবেন না। কিন্তু এই বইয়ের ব্যাপক প্রচার প্রয়োজন। সে লক্ষ্যে দেশের প্রতিটি সরকারি বেসরকারি সাধারণ লাইব্রেরি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিজস্ব লাইব্রেরিগুলোতে এই বই থাকা উচিত। সাধারণ পাঠক যেন সহজে এই বইয়ের সাথে পরিচিত হতে পারে তার জন্য ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।
বাংলাদেশে মানুষ বাস করা শুরু করে প্রাগৈতিহাসিক কালেই। পলিমাটি নির্ভর দেশ হওয়ায় পাথরের অভাব সময়সময়ই ছিল। এই অঞ্চলের প্রাচীন মানুষ ফসিল উড (শক্ত পাথরে পরিণত হওয়া গাছের ফসিল) দিয়ে শিকারের অস্ত্র তৈরি করেছিল। সভ্যতা বিকাশের প্রায় সব ধাপে, সব যুগে বাংলাদেশ ভূমিতে মানব বসতি ছিল। এই সমৃদ্ধ ঐশ্বর্যময় সাংস্কৃতিক সৌন্দর্য সম্পর্কে আমরা জানি কম। বিদেশী পর্যটকেরাও তথ্যের খোঁজ করেন। সকলের জ্ঞানতৃষ্ণা এই বইয়ের সংক্ষিপ্ত ও যথাযথ বর্ণনা ও আকর্ষণীয় আলোকচিত্রগুলো পূরণ করবে; সচেতন দেশপ্রেমী পাঠক বাংলাদেশের সমৃদ্ধ প্রত্নতাত্ত্বিক উত্তরাধিকারের গৌরব অনুভব করবে।
-:-:-:-:-:-:-:-:-:-:-:-:-:-:-:-:-:-:-:-:-:-:-:-:-:-
বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক উত্তরাধিকার
সুফি মোস্তাফিজুর রহমান
প্রচ্ছদ ও গ্রন্থ নকশাঃ তারিক সুজাত
প্রকাশকঃ জার্নিম্যান বুকস, ঢাকা
প্রকাশকালঃ ২০১৭
পৃষ্ঠাসংখ্যাঃ ৯৬
মূল্যঃ ৮০০.০০ টাকা
ISBN:
978-984-91132-3-2
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম