সাহিত্যের বিচারে মূল্যায়নের স্বরূপ
সমালোচকেরা সাধারণত তিনভাবে সাহিত্যের বিচার বা মূল্যায়ন করে থাকেন। ব্যাখ্যান, বিচার ও উপভোগ করে কোনো রচনার মধ্যে প্রবেশ করে তার বহিরঙ্গ ও অন্তরঙ্গ বস্তুগত পরিচয় দেওয়া ব্যাখানমূলক সাহিত্য-বিচারের কাজ। একটি কবিতা বা নাটক বা উপন্যাসের মূল তাৎপর্য, তার রসবৈচিত্র্য, তার কলাকৌশল, স্রষ্টার মানসিকতা ও অভিপ্রায় – এইগুলিকে পাঠকের কাছে বুঝিয়ে দেওয়াই ব্যাখ্যামূলক সমালোচনার কাজ। যথাসম্ভব নিস্পৃহ থেকে সমালোচক বস্তুগত দৃষ্টিকোণ থেকে সাহিত্য বিচারে এমনভাবে প্রবৃত্ত হবেন যাতে পাঠকের সঙ্গে সাহিত্যের প্রাথমিক পরিচয় ঘটতে কোনো বাধা না হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে, বিচারমূলক সমালোচনায়, সমালোচক সাহিত্যকে আসামীর মতো কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে সাহিত্য থেকে কতটুকু সামাজিক কল্যাণ হলো, সাহিত্য কী পরিমাণে সংসারের উপকার করতে পারে, পাঠককে ক্ষণিক চমকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে, না মহৎ ধারণা-চিন্তার সঙ্গে পরিচয় ঘটানো হচ্ছে, এসব পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। একদিকে তিনি লেখকের ত্রুটি সম্পর্কে সজাগ থাকেন, অন্যদিকে পাঠকের রুচিকে যথাস্থানে রাখার বা উঁচুতে তুলবার জন্যেও তিনি সতর্ক থাকেন। একদা সমালোচকের স্থান শিল্পী বা স্রষ্টার ওপরে ছিল। তাঁরাই লেখককে নির্দেশ দিতেন, পাঠকের রুচিকে শাসনে রাখতেন। আই. এ. রিচার্ডস সমালোচককে এইজন্যেই ‘মূল্যবোধের বিচারক’ বলেছেন। এখনও সমালোচকের এই সামাজিক দায়িত্বকে সম্মান দেওয়া হয়। কিন্তু সমালোচকের এই স্পষ্ট সামাজিক দায়িত্ব ও নীতি-নির্দেশকের ভূমিকার প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। পেশাদার সমালোচকের অসহ্য দাপটে গ্যায়টে এবং ফ্ল্যবেরের প্রতিবাদ তো বিখ্যাত হয়ে আছে।* সাধারণ শিল্পীদের দিক থেকে এই প্রতিবাদ উঠলো। বলা হলো, শিল্পীরাই শিল্পের যোগ্য সমালোচক। তাঁরাও সমালোচকের দায়িত্ব ঠিক করে দিয়ে আনাতোল ফ্রাঁস - এর মতো বলেছেন, সমালোচকের সংবেদনশীল মন উৎকৃষ্ট শিল্পের উপভোগ-অভিজ্ঞতার রোমাঞ্চকে পুঙ্খনুপুঙ্খভাবে বর্ণনা দিয়ে যাবেন। তৃতীয় পর্যায়ে তাই সমালোচনার মূল লক্ষ হয়ে দাঁড়ালো, শিল্পের মধ্যে যে মণিমাণিক্য তিনি পেলেন তা-ই পাঠককে উপহার দেওয়া। এই পর্যায়ে সমালোচকের ব্যক্তিগত রুচির কথাও বড় হয়ে দাঁড়ায়। কোনো তত্ত্ব নয়, বিচারের রায় দেওয়া নয়, শুধু উপভোগের কথা বলে যাওয়া। বিচারশীল মনের ওপরে কর্তৃত্ব করে সমালোচকের সৃষ্টিশীল মন – এক সৃষ্টিকে নির্ভর করে নতুন করে নিজস্ব একটি উপভোগের জগৎ তৈরি করে এই মন পাঠককে আকর্ষণ করে। এই পদ্ধতিতে সাহিত্যের নিরপেক্ষ বিচার অবশ্য হয় না, তার বদলে তার উপভোগের কথা, সমালোচকের নবীন দৃষ্টিতে সৃষ্টির সমান্তরাল আরেক জগতের আস্বাদ পাওয়া যায়।
তাহলে আদর্শ সমালোচনা কী হবে? শুধু বহিরঙ্গ-অন্তরঙ্গের নিরপেক্ষ বিচার কিংবা, বিচারের মানদণ্ডে সামাজিক দায়িত্বের দিকে তাকিয়ে শাসন করা বা প্রশ্রয় দেওয়া? অথবা শিল্পীর সৃষ্টিকে শুধু উপভোগ ক'রে নিজস্ব কল্পনার জাল বিস্তার করা? মনে হয়, ভারসাম্য রেখে এই তিনের সামঞ্জস্য করা সমালোচকের প্রয়োজন। নিরপেক্ষ বিচার করতে হবে, প্রয়োজনমতো সামাজিক চেতনাকেও সজাগ রাখতে হবে, পাঠকের রুচির মান সম্পর্কেও সচেতন থাকতে হবে, আবার অতিরিক্ত কল্পনা ও ব্যক্তিগত রুচিকে প্রশ্রয় না দিয়ে স্রষ্টার সৃষ্টিকে সংযম ও সতর্কতার সঙ্গে উপভোগ ক'রে স্রষ্টার সহমর্মী হতে হবে। এবং পাঠককেও সেই সহমর্মিতার অংশ দিতে হবে। পাঠকের পক্ষেও সমপর্যায়ের শিক্ষা ও রুচি অবশ্যই প্রয়োজন। স্রষ্টা ও সমালোচকের সম্পর্ক ছোট-বড়র সম্পর্ক নয়, আদান-প্রদানের সম্পর্ক, সহযোগিতার সম্পর্ক।
* গ্যায়টে বলেছিলেন "Kill the dog, he is a reviewer’. ফ্ল্যবের বলেছিলেন, ‘What droll creatures these College Professors are wherever they talk about art’. সমালোচকরাও কম যেতেন না। হুইটম্যানের ‘গদ্য-কবিতা’ নামক উদ্ভট ব্যাপারে চমকে উঠে একজন মন্তব্য করেছিলেন: ‘[Whitman is] as unacquainted with art as a hog with mathematics’
-:-:-:-:-:-:-:-:-:-:-:-:-:-:-:-:-
সূত্রঃ সাহিত্য ও সমালোচনার রূপ-রীতি- উজ্জ্বলকুমার মজুমদার
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম