কিছু পদচিহ্ন হঠাৎ আলোর ঝলকানি দিয়ে কোথাও মিলিয়ে যায়। কিন্তু কিছু স্বর অশ্রুত হলেও জ্বালাময়। চোখে আগুন ধরায়। সর্বোপরি সময়কেও প্রতিনিধিত্ব করবার জন্য সে উঠে পড়ে লাগে। কবি ইয়ার ইগনিয়াস এর কবিতাও যেনো তেমন; প্রচলিত ধ্যান-জ্ঞান কে অনেকটা পাশ কাটিয়ে ওঠার আরেক পরাক্রম— নতুন কিছু বলতে চাইছে, নতুন উদ্বাহু কোন সুরের উন্মীলনে।
কবি ইয়ার ইগনিয়াস এর প্রথম কবিতাগ্রন্থ 'হারমিসের বাঁশি'। যেখানে তিনি নিজেই হতে চান বাংলার হারমিস। নতুন অপ্রতিরোধ্য কোন বাঁশির সুরে, বাংলা কবিতায় যেনো নব-পলির প্রতিশ্রুতময় প্রতিনিধিত্ব করতে চান। তার সুর ও স্বরেই আছে সেই সমূহ বচন। আলাদা একটা ভঙ্গি। যেখানে তিনি সহজাত নয়—বরঞ্চ বাংলা কবিতার কাঠামোগত অবস্থানের বাইরে গিয়ে একটা সক্রিয় কণ্ঠ নির্মাণের প্রচেষ্টায় রত।
দক্ষিণ চট্টগ্রামের নৈসর্গিক সৌন্দর্য তথা পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার। পাশে উখিয়া টেকনাফ এর মায়াময় সুন্দর গ্রাম। দুর্গম ডোরাকাটা পাহাড়; বিচিত্র জনপদ। তাদের কলহাস্য ধ্বনি; সাগরের জলজ সুন্দরের বিবিধ মৌন-সম্ভাবসনকে পরখ করে, সবকিছুর সাথে কবির তৈরি হয়েছে এক ধরনের সরাসরি আত্মযোগ। তিনি দেখেছেন এই জলজ ভূগোলের দেশে, কেমন করে মানুষ দাহ করে নিজের দু:খ, বেদনা, আবেগ ও শরীরের মানচিত্র।
সন্ধ্যা-চেরাগের সলতে, কিভাবে দেয়া হতো দাওয়ায়। কিংবা স্নানটি সেরে বধুয়ার ঘরে ফেরা। গ্রাম্য যুবক-চলনের মাটিভেদ্য নন্দন। এছাড়াও প্রকৃতির লতা-ঝাউসহ আরো কিছুর ভীন্নতাকে আকণ্ঠ পান করেই যেনো নিজের কবিতাদেবীর কাছে পরাতে চান ভীন-স্বরের পুষ্পমাল্য। যদিও এই পথ খুব একটা মসৃণ নয়। এর আগেওতো বাংলা সাহিত্যে হয়ে গেছে কতো বিপ্লব ও ব্যঞ্জনা। হয়েছে নানা কথা, ছন্দ-অলংকার-উপমা-উৎপ্রেক্ষার গতরে সাজানো কথার এলোকেশি প্রয়াস; এভাবে বিশ্ব সাহিত্যের নানা মিথ, কিংবদন্তি, পুরাণ-গাথাগুলো কবিতায় ব্যবহার করার সরাসরি প্রচেস্টা আমরা অনেকের মাঝেই দেখেছিলাম। কেউবা সৃজন তাড়নায় সহজাত উচ্ছ্বাসে নিজের গাঁয়ের অমৃতকে আকণ্ঠ পান করেছেন। কেউবা মনন তাড়নায় বিশ্ব-ভূগোল মাথায় নিয়ে স্বতন্ত্র প্রচেষ্টায় অনেকদূর হেঁটেছেন। এভাবে সৃজন ও মনন ঘরাণাসহ দুটি ঘরাণাকে সদা ব্যাপৃত হতে দেখি। কথা হচ্ছে এই করে নিজের দেশ-মাতৃকাসহ এর কতোটুকু দায় নিয়ে আমরা কাজ করেছি? সেটা অবশ্য ভাবার বিষয়। কবি ইয়ার ইগনিয়াস ঠিক সেই দায়কে মাথায় রেখেই যেনো নিজের শিল্পসত্তাকে নিজ-গন্ধের আকুলতায় সাজানোর প্রয়াস পেয়েছেন।
কবির কবিতা থেকে কিছু আলোচনা।
যেমন—
"দরিয়া পাড়ে গেলে ভুলে যাই দুনিয়ার তাবৎ দ্বিধা ও দ্বৈরথ/ভুলে যাই হৃৎ-ক্যাম্পিয়াসে ত্রাসকারী দু:খ-হাঙরের ট্রেসপাস"...
(দরিয়া পাড়ে গেলে)।
কোন অমোঘ সুখের অমীয় পান আমি চাইবনা তবুও তোমার রূপ-সুন্দরে আমি ডুব দেবো। কবি শুধু নিজের ভূগোলে নয়; এই ভূগোলের বাইরের রূপ-সুন্দরের ভেতরেও করেছে অবগাহন। নিজের প্রজ্ঞা আর উপমাগুলো এক ভীন-সুন্দর মহিমায় প্রোথিত করার চেষ্টায় যেনো তিনি সদা মগ্ন।
কবি ইয়ার ইগনিয়াস তার প্রথম কবিতাগ্রন্থ 'হারমিসের বাঁশি' তে তার কবিত্ব শক্তি আর সৃজন-মননের ঘনঘটায় একটা আলাদা প্রক্ষেপণের সুর-সঞ্জাত প্রয়াস যেনো নিয়ত দেখতে পাই। তার কিঞ্চিৎ যেমন—
"দোলায়োনা কাঞ্চনজংঘা পেণ্ডুলাম অবিকল/ কোরো না ইশারা আর যেতে অপ্রাকৃত সবুজে"....(হেগেলের সূর্য)
"যে ব্যথাটা আমাকে কেবল কুরে কুরে খায়/
কখনো আমি সেই ব্যথাকে চোখেতে ভেজাই"...(সিগনেচার)
অথবা ...
"দিনে সারস ও কচ্ছপের খামারে কাজ করি, রাতে পাহারা দিই মৃত্যুর দরোজা/। এন্ট্রিলিস্ট চেক করে জেনেছি এখানে হারমিস আসেন কদাচিৎ,/ আমি তার অপেক্ষায় থাকি....(হারমিসের বাঁশি)
'পূণর্জন্ম' কবিতায় বাবাকে নিয়ে আরেক প্রস্থ যেমন—
"বাবা মারা যাওয়ার পর প্রায় প্রতিদিনিই আমার সাথে কথা হতো- টিউউলিপ দলে শিশিরের মতো ঝরঝরে ভাষায়–স্বল্পদৈর্ঘ্যে স্বপ্নে-প্রতিমার ঔরসে যেদিন পুত্র পললের জন্ম হলো- ওইদিন থেকে আজতক না-স্বপ্নে না-কল্পে তিনি আর আসেন নি"
এছাড়াও উল্লেখিত কবিতাগ্রন্থের কিছু কবিতার ধ্রুপদি লাইন বাংলা কবিতার যেনো শক্তিশালী প্রতিনিধিত্ব করে—ফলে আমরাও হয়ে ওঠি সেই সৃজন, সুন্দর, মনন-ঘেঁষা কবিতার ভীন-রুচির পাঠক।
যেমন—...
[ ] "ঠোঁটস্য কারার কপাট ভাঙতে পারে না বোবা ভাষা/ আলজিব অন্ধকারে আটকে থাকে সমস্ত স্বর"...
(বোবা ভিখিরির গান)
[ ] "পরীপাখিরাও কোথাও খেলছে চড়ুই ভাতি পাললিক আকাশ?"
(চাঁদের ছায়া)
[ ] "ফ্যাকাশে আকাশে ঘনকৃষ্ণ শ্রাবণাভ"...
(মানুষ কতোটা সভ্য হলো)
[ ] "ওৎরে ওঠে নাভীর প্রগাঢ় পরিখা"...(পুলসিরাত)
[ ] " মৃণ্ময় চালাঘরগুলো পোড়ামাটি ও চুনমাটির দ্রবণে সুদৃশ্য ডোম"...
(এক ফোঁটা আক্ষেপ)
[ ] "সময়ের স্ব-মৈথুনে পোয়াতি হয় পৃথিবী মৌসুমী মৌতাতে..."
(ঋতুর ঋণে ঋদ্ধ বর্ণমালা)
ঠিক ভাটি-বাংলার জলজ কথা, মাটিগন্ধকে কোথাও কমতি না রেখে সময়ের সাহসনামায় কবি ছড়াতে চান এক নিজস্ব-ভবনের রাজকীয় তিলোত্তমা। যেখানে আছে ইশারা বা সরাসরি ইঙ্গিতে ইউরো কবিতা ও প্রাচ্য কবিতার মিথ-কিংবদন্তি-প্রকৃতি-নিসর্গ আর মানব সম্পকের্র নানাবিধ যৌথ রসায়ন। এখানে কবির সম্পূণ রসায়নটা নিজের মাটি থেকেও উৎসারিত সেটা বলতেই হয়। বর্তমান সময় যেটা নিজেই দাবী করে।
'হারমিসের বাঁশি' কবিতার নামখানা বাইরের প্রপঞ্চ থেকে হলেও তিনি চেষ্টা করেছেন সেটাকে কিভাবে অন্য-স্বরে ভাঙা যায়; অথবা নিজেদের সম্প্রসারিত কোন বিরল প্রতিভাকেও চ্যালেঞ্জ জানানো যায় কিনা; সময়ের উল্লাসে সরাসরি ডুবে না গিয়ে, সেটাকে অভিঘাত করে প্রতিটি কবিতার ভেতরে নতুন যে অভিনিবেশ, তা আসলেই প্রশংসার দাবিদার। তবুও কিছুটা শঙ্কা যেনো থেকেই যায়। আমরা যেনো নিজের মাটিজাত সাহসের ভেতর থেকেই আরেক নতুন কোন মোচড় দেখতে পাই। বলতে চাইছি মিথ, কিংবদন্তি বা প্রকৃতি-রহস্যের যে উপমা কবি কবিতায় দিয়েছেন, সেই উপমা বা কল্পনাশক্তি-বয়ানের সুসংহত রূপগুলো যেনো সরাসরি বা প্রচলিত না হয়ে অন্য কোন আদল বা ইঙ্গিতের প্রতিধ্বনি হয়ে আসে... যদিও বয়স ও সময় বিবেচনায় সে অফুরন্ত সময় এখনো আছে। এবং অনেক শক্তিসম্পন্ন কবিতা লেখার সাহস ও ক্ষমতা উভয় রয়েছে কবির। আশা করছি সামনের দিনগুলোতে কবিকে আরো পরিণত ঝঙ্কারে নতুন কোন মোচড়ে পাবো—বাংলা কবিতার বিশাল বাঁক ও প্রতি রেখার ঝলকে নতুন তরঙ্গে।
ইয়ার ইগনিয়াস এর হারমিসের বাঁশি বইয়ের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি জানতে পড়ুন:
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম