গত কিছুদিন ধরেই শেরিফ আল সায়ারের গল্প টানা পড়ছি। পড়ার পর মনে যা এসেছে একটানে লিখে ফেলেছি। সময় থাকলে পড়ুনঃ
কে সেই গল্পকার-যে মানুষের কথা বলে! মানুষের জীবনের ভেতরে ঢুকে জীবন থেকে মণি-মুক্তোর মতন অমূল্য গল্পগুলো কুঁড়িয়ে নিয়ে আসে! হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগায়, ভালোবাসার এক জগত তৈরি করে সচেতনভাবে অথচ অত্যন্ত সূক্ষ্ম চালে। সেই কথা, সেই ব্যথা, সেই অনুভূতির ছায়াতল, জীবনের গভীর বোধ-কে তুলে নিয়ে এসে জীবনকে বেঁধে ফেলে এক মায়ার জগতে? তিনি গল্পকার যাকে আমরা প্রচলিত ভাষায় কথা সাহিত্যিক বলি। কথা সাহিত্যিক কী করেন? তিনি তো বিজ্ঞানীও না, না প্রযুক্তিবিদ, না চিকিৎসক কিংবা নন কোনো প্রকৌশলী! কিংবা তিনি সরাসরি উৎপাদনের সাথে যুক্ত শ্রমিক বা মাঠে লাঙ্গল চাষে রত কৃষকও নন, যিনি খাবার তুলে দিচ্ছেন মুখে কিংবা মৌলিক চাহিদার যোগান দিচ্ছেন আপনাকে! তাহলে গল্পকারের কাজ কী? গল্পকার আমার কাছে শব্দ শ্রমিক কিংবা শব্দের কৃষক, যিনি শব্দের লাঙ্গল হাতে নিয়ে চাষ করেন মানব জীবনের গভীর বোধ কিংবা তার সকল শ্রম দিয়ে উৎপাদন করেন অনুভূতির এক জগত। যে জগত একান্ত আমাদের আপনার। যে জগত মানুষের কথা বলে, মানুষের স্বপ্নের কথা বলে, তার মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ধারণ করে। গল্পকার কী শুধু মানুষের কথা বলেন, তিনি কী প্রকৃতির কথা বলেন না! যে মানুষ প্রকৃতির সন্তান-প্রকৃতির সাথে পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়ায় কেটে যায় যাদের জীবন। গল্পকার সেই প্রকৃতির ছবিও আঁকেন। প্রকৃতি মায়ের বুকে তার বাঁচবার যে আর্তচিৎকার তার কথা প্রতিটি মানুষ অবচেতনে ধারণ করেন। সেই গল্পই তুলে নিয়ে আসেন গল্পকার।

এখন আসা যাক মূল কথায়, যে জন্য এই লেখা লিখতে বসা। উপরে যে কথাগুলো বললাম, সেই কথাগুলো মাথায় আসলো সম্প্রতি শেরিফ আল সায়ারের গল্প পড়তে গিয়ে। শেরিফ আল সায়ার কেন গল্প লেখেন? এইটা গল্পকার হয়তো ভালো বলতে পারবেন; তবে একজন পাঠক হিসেবে আমার মনে হয়েছে, শেরিফ আল সায়ার গল্প লেখেন মূলত অন্তর্জ্বালা থেকে। অন্তর্জ্বালা তথা যাকে আমি দ্বন্দ্ব বলি কিংবা মানুষ যে সময়ে বা যে সমাজে বাস করে সেই সময়ের নানাবিধ অন্তর্জ্বালা বা দ্বন্দ্ব কিংবা সেই সময়ের বা সমাজের অভিঘাত থেকে কারও নিস্তার নাই। এই অভিঘাতের যে মর্মপীড়া সেই মর্মজ্বালা গল্পের প্রতিটি চরিত্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ফুটে উঠে শেরিফ আল সায়ারের প্রতিটি গল্পে। চারিদিকে এই যে ব্যস্ত সময়, যে সময়ে মানুষ ক্রমশ মানুষের কাছে অপরিচিত থেকে আরও অপরিচিত হচ্ছে, বস্তুত মানুষ নিজেই নিজের কাছে অপরিচিত, এই দৌড়ের সময় কেন কষ্ট করে গল্প পড়তে যাবে মানুষ! এই সময়ে গল্প বলা কিংবা লেখা এতো সহজ কাজ নয়। এই অস্থির সময়ে আমি শেরিফ আল সায়ারের তিনটি গল্পগ্রন্থ “কয়েকটি অপেক্ষার গল্প”, “এই ঘরে কোনো খুনি নেই” কিংবা এই বইমেলায় বের হওয়া “খাঁচাবন্দি মানুষেরা” আক্ষরিক অর্থে গোগ্রাসে গিলেছি। কেন গিলেছি?


তবে একটা আক্ষেপ নিয়ে এ লেখা শেষ করতে চাই, আর তা হলো, শেরিফ আল সায়ার তার গল্পে নিম্ন মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত কিংবা উচ্চবিত্তের জীবনের ভেতরে যতটা সাবলীলভাবে ঢুকতে পেরেছেন, নিম্নবিত্তের জীবনের গভীরে ঠিক ততটা সাবলিলভাবে ঢুকতে পারেন নি বলেই আমার কাছে মনে হয়েছে। তবে তিনি নিম্নবিত্তের জীবনের গভীরে ঢোকার চেষ্টা করেছেন আন্তরিকভাবেই। এই জায়গাটিতে লেখক হাত দেবেন হয়তো তার পরবর্তী গল্পগুলোতে, একজন সচেতন পাঠক হিসেবে এইটুকু আকাঙ্ক্ষা আমি করতেই পারি।
কতটুকু ধরতে পারলাম লেখককে বা তার গল্পকে সেটা তো বলতে পারবো না, তবে এই কথা আমি জোর দিয়েই বলতে পারি, শেরিফ আল সায়ার হারিয়ে যাবেন না, তিনি প্রচণ্ডভাবেই প্রভাব বিস্তার করবেন পাঠকের হৃদয়ে তার গল্প দিয়ে।
-০-
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম