সাজ্জাদ সাঈফ
হাসান মসফিক এর লেখা 'আহত ফুলের চিকিৎসা' কাব্যটির পরিচয় আমরা এর আগে গ্রন্থগত ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছি। আজ পড়ুন সাজ্জাদ সাঈফ এর লেখা একটি সুখপাঠ্য আলোচনা।
বাংলা কবিতায় এখন একটা সুনিবিড় টার্ন ওভার চলছে, জীবনযাত্রা ও সামাজিক-ব্যক্তিক মূল্যবোধে কিছু পরিবর্তন আসতেছে, শহর-গ্রাম সবখানে, ডিভাইস নির্ভর দৈনন্দিন জীবনের দিকে পশ্চিমারা ঝুঁকে গেছে বেশ কিছুদিন হলো, বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়, এতে দেখা যাচ্ছে প্রয়োজনীয় অনেক কাজ ডিভাইসেই শেষ করা যাচ্ছে বিধায় আত্মবৃত্তের বাইরেও যেতে হচ্ছে না মানুষের, এতে করে নিঃসন্দেহে নিঃসঙ্গতা একটা সুযোগ পায় ব্যক্তির ভিতরে যাবার, আর সেই ব্যক্তিটি যদি একজন কবি হন তবে সেখানে শিল্পবৃত্ত তৈরি করে নিতেও বেগ পেতে হচ্ছে না কবিকে, যদিও মনোবিজ্ঞান একে ঝুঁকিপূর্ণ বলে থাকে, সেটাই সই, কবিই তো ঝুঁকি নেন, কবি পুরো সমাজকাঠামোর ভিতর থেকে বাইরে বেরিয়ে নিজের এক্সট্রিম রিয়েলিটিতে সহজেই প্রবেশ করতে পারেন এবং এই রিয়েলিটিতে সমগ্র অথবা সামান্য কিছু উপাদান তিনি সঙ্গে রাখেন। এরকম কবিতাবাস্তবতার মুখোমুখি দেখা গেলো হাসান মসফিককে।
'আহত ফুলের চিকিৎসা' কবির দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ, তিনি খুব আয়েশ করে শব্দের চাল দেন এবং দৃশ্যসতর্কতা এই কবির নিজস্ব কৌশল। তিনি চতুর্পার্শ্বে মনোযোগ দিয়ে ডুব দেন নিজস্ব বোধের ভিতর, আর একটা সহজাত বেদনাবোধকে তিনি সচেতনভাবে লালন পালন করেন কবিতায়। জীবন বিষয়ে তাঁর নিজস্ব ক্যালকুলেশনকে একটা বিষাদে অবতীর্ণ হতে দেখি আমরা-
ধোঁয়াশা, ম্রিয়মাণ নকল ফুলের অভিনয় দেখতে দেখতে চোখের ভেতর বড় হয়ে উঠছে জ্বরের তীব্রতা
চুম্বক দেখে এখনো লিখে নিতে হচ্ছে মার্বেলের জীবন
হাসান তাঁর অভ্যন্তরকে খুলে দেখান কবিতায়, তাঁর মধ্যে এক ধরণের আত্মজিজ্ঞাসা কাজ করে, পরিবেশকে নিজের বোধের অনুকূলে এনে বারবার নিজের মুখোমুখি হতে দেখি তাঁকে-
কাকে রেখেছো মনে? আর, কাকে গিয়েছে ভুলে! টলটলে, ঘনায়মান ওই কালোর দিকে চেয়ে থেকে আবারো আজ, একবার কাকেই বা স্মরণ করলে!
তাদের;
শুধু দৈর্ঘ্য আর প্রস্থৈ যারা মাপতে চেয়েছে মিনারের তরজমা
আত্মকেন্দ্রে কবিকে একটা অতৃপ্তি ধাওয়া করে বেড়ায়, এইটা শূন্যতাবোধ না হয়েও যেন বা শূন্যতাকে আবীর দিয়ে রাঙিয়ে তোলে তাঁর কবিতায়, তিঁনি লেখক হিসেবে অপটিমিস্টিক নন আবার প্যাসিমিস্টিক ধারার আশেপাশে অবধি ঘুরে ফিরে আসেন এক একটা অবলম্বনপঙ্ক্তির কাছে, এই বিষয়টিকে ফার্নান্দো পেসোয়ার জীবনবহির্ভূত জীবনের ধারণার কাছাকাছি-
জীবনকে অগ্রাহ্য করার সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য উপায় হলো সাহিত্য
- ফার্নান্দো পেসোয়া
মূলত জীবনের নামে প্রাতিষ্ঠানিক শেকলগুলির বিবিধ আঘাতকে অগ্রাহ্য করার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপায় হলো সাহিত্য, এর মূলে না গেলে এর অর্থ আপনার কাছে অধরা থাকবেই, হাসান গিয়েছেন, তাঁর বোধের আসাযাওয়া সীমা থেকে অসীমের দিকে তর্জনী তাক করে, তবে জীবনের সমগ্রকে তিনি সরাসরি অগ্রাহ্য করেন না, মাঝেমাঝে ভাষ্য রূপে জানান তিনি চাইছিলেন না এমন জীবন, আবার এই পেয়ে যাওয়া জীবনের নানান টুলস তার কাছে লেগেও যায বিধায় তিনি আশাবাদী হন, এক্ষেত্রে প্রায়ই ম্যাজিক রিয়ালিজমের আশেপাশে ঘুরঘুর করে তাঁর কথাগুলি-
না যাওয়া হোক- ওই বাসনার বাগানে কোনো কোনোদিন ঠিক নদীচাষ তো করা যাবে
...
জীবন আদতে এক রেলগাড়ি।
পড়ে থাকে কেবলি কামরাভর্তি যাতায়াত
খুচরো সব গল্প। এমনি পরিসর অথচ
সমস্ত বগির কথা কে-ই বা কুড়িয়ে
এক করবে!
...এর মাঝে কোথাও বেজে চলেছে-
হাহাকারের সুর, এ সুরের কোনো প্রেরক নেই
প্রাপক নেই যেন, আর
অদৃশ্য তানসেন, অদৃশ্য তানপুরা
এভাবে হাসান তৈরি করে নেন নিজের আঙ্গিক, এই আঙ্গিকের কোথাও পরিচিত কোথাও অভূতপূর্ব টিউনিং টের পাবেন পাঠক, তাছাড়া হাসান মাটিস্পর্শ থেকে দূরত্ব তৈরি করেন না কবিতায়, এতে তাঁর ভাষা শেকড় গেড়ে যায় পাঠকের অন্তঃস্থ মৃত্তিকায়-
দেরি করে ফোঁটা ফুলকে
কেউ
বকছে না
হাসান মসফিক এই সময়ের উজ্জ্বল স্বরের অবয়ব, তিনি ব্যক্তিক একাকীত্বের ঠোঁটে জল তুলে দিতে জানেন কবিতায়-
স্পর্শমাত্র ভেঙে ভেঙে পড়ছে
জলের
একাকীত্ব
হাসানের কবিতা বারবার পাঠের দাবি রাখে, তাঁর দেখার ভঙ্গির কোথাও ভনিতা নেই, আছে সরল উদযাপন, আছে নিজস্ব উৎকর্ষ। আত্মজৈবনিকতা হতে সমাজ-রাষ্ট্র ও জনমানস জায়গা করে নেয় কবিতায়, মিডিয়ার উত্তাল সাহিত্যনৈরাজ্যের সময়ে এভাবে একাকীত্বকে নান্দনিক উপস্থাপন করতে পারাটা ক্রেডিট-
দেওয়ালে ঝুলানো একটা পেইন্টিংও একা
খুব একা?
নদীর অগোচরে বাড়ছে কোন কোন ঋতু
'আহত ফুলের চিকিৎসা' একটা সাইকোলজিক্যাল ট্যুর, আর পাঠককে নিবিড় পাঠ অভিজ্ঞতায় নিবিষ্ট করতে হাসানের প্রচেষ্টাও যেন তাঁর সহজাত, শ্রম দিয়েছেন তবে জবরদস্তি করেননি, আসলে এতোটা লিরিক্যাল রিয়্যালিটির মধ্যে কবিকে দাঁড়াতে দেখা গেছে তাতে জবরদস্তির প্রশ্নই আসে না, হাসান মসফিককে ভাষার ঐশ্বর্যে স্বাগতম।
আহত ফুলের চিকিৎসা
হাসান মসফিক
অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৯
চন্দ্রবিন্দু প্রকাশন
প্রচ্ছদ- রাজীব দত্ত
মূল্য- ১৪০ টাকা
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম