‘শ্রীশচন্দ্র দাশ’ রচিত ‘সমালোচনা’ প্রবন্ধ

‘শ্রীশচন্দ্র দাশ’ রচিত ‘সমালোচনা’ প্রবন্ধ (আংশিক)

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সাহিত্যে যে মতবাদ ও মনোভঙ্গিগুলো সমালোচনার পদ্ধতি হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে সেগুলোর আলোচনা এই প্রবন্ধের প্রধান বিবেচ্য। নবীন সমালোচকের প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় ‘শ্রীশচন্দ্র দাশ’ রচিত ‘সাহিত্য-সন্দর্শন’ গ্রন্থের অন্তর্ভূক্ত ‘সমালোচনা’ প্রবন্ধটি আমরা আংশিক প্রকাশ করলাম। এই প্রবন্ধটিতে সমালোচনার বিভিন্ন রূপ সম্পর্কে শ্রীশচন্দ্র দাশ বিভিন্ন উদাহরণসহযোগে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। সাহিত্য সমালোচনা কী কেন কীভাবে করতে হয় প্রভৃতি প্রসঙ্গে প্রয়োজনীয় এই আলোচনাটি সাহিত্যিক ও সাহিত্য সমালোচক উভয়েরই পাঠ করা প্রয়োজন।

শ্রীশচন্দ্র দাশ সংশ্লিষ্ট আরও কয়েকটি লেখা গ্রন্থগত ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। সেগুলো হলঃ




সাহিত্যের উৎকর্ষ বা অপকর্ষ বিচারমূলক সম্যক আলোচনাকে সাধারণভাবে ‘সমালোচনা’ নামে অভিহিত করা হয়। সম্যক আলোচনা বলিতে সাহিত্যের ভাব, বস্তু, রীতি, অলঙ্কার ও স্রষ্টার বিশিষ্ট মানসদৃষ্টি প্রভৃতির সামগ্রিক আলোচনাকেই বুঝায়। সাহিত্য-সমালোচনা এত বিভিন্ন পদ্ধতিতে অনুসৃত হয় এবং একই সাহিত্য সম্বন্ধে অনেক সময় দুইজন মনীষীর এত মতানৈক্য দৃষ্ট হয় যে, উহার শিল্প-সৌন্দর্য সম্বন্ধে কোন মীমাংসায় উপনীত হওয়া অনেক সময় কঠিন হইয়া দাঁড়ায়। বীক্ষণাগারে (Labaratory) দুই বিভিন্ন মনোবৃত্তিসম্পন্ন দুইজন বিজ্ঞানী কোন বৈজ্ঞানিক সত্য বিশ্লেষণ করিয়া একই সত্যে উপনীত হইতে পারেন। কিন্তু সাহিত্য-সমালোচনার ক্ষেত্রে তেমনটি সম্ভব নয়। এইজন্যই বলা হয় -“No two people have ever read the same novel or the same play.” সমালোচনার ক্ষেত্রে এই মতবিরোধের কারণ বোধ হয় এই যে, দুইজন লোক শিক্ষা, দীক্ষা ও জ্ঞানগরিমায় তুল্য হইলেও তাঁহাদের রুচির পার্থক্য হওয়া অসম্ভব নহে। আর একটি কারণেও উক্ত মতদ্বৈধতা হওয়া অসম্ভব নয়। সমালোচকের সহৃদয়তা, কল্পনাশক্তি, অন্তর্দৃষ্টি ও উদারতা এই কয়েকটি গুণ থাকা বাঞ্ছনীয়। ইহাদের অভাবে অনেক পুঁথিগত সমালোচক সাহিত্যের মূল্য নিরূপণ করিতে গিয়া শুধু ব্যক্তিগত মতামতকে সমালোচনার নামে চালাইতে চাহেন। এই ধরনের সমালোচনার কোন মূল্য না থাকিলেও, মোটের উপর, সমালোচনার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করিবার কোন কারণ নাই। সত্যিকার সমালোচনা পথভ্রষ্ট সাহিত্যিককে নিয়ন্ত্রিত করিয়া তাঁহাকে দৃষ্টিদান করে এবং সাধারণ পাঠকের সৃষ্টি শাণিত ও অনুভূতি জাগ্রত করে। পূর্বেই বলিয়াছি যে, সহৃদয়তা, রসবোধ ও উদারতা সমালোচকের প্রধান গুণ। সহৃদয়তা ব্যতীত কোন কবি বা সাহিত্যিক জীবনের যেই রূপটি যেমন করিয়া লিখিয়াছেন, সেই রূপটি তেমন করিয়া দেখা সম্ভব হয় না; এবং উদারতা না থাকিলেও কোন সাহিত্যের মর্মমূলে দৃষ্টিনিক্ষেপ করা সহজসাধ্য হইতে পারে না। রসবোধ ব্যতীত সাহিত্যের সৌন্দর্য আস্বাদন সম্ভব নহে। এতদ্ব্যতীত, সমালোচককে শিক্ষিত, সংস্কৃতিমান ও সাহিত্যবোধসম্পন্ন হইতে হইবে। এই সাহিত্যবোধ বা রসবোধ সাধারণত শিক্ষার দ্বারা সঞ্চারিত হয় না, ইহা অনেকটা প্রাক্তন।

সাহিত্যে যেমন গ্রন্থকারের আত্মপ্রকাশ, সমালোচনায়ও তেমন সমালোচকের আত্মমুক্তি। সমালোচক আত্মমুক্তির মধ্য দিয়া পাঠককে ‘লেখকের মনের সহিত পরিচয়’ করাইয়া দেন। কিন্তু এই আত্মমুক্তি নিছক ব্যক্তিগত নয়; ব্যক্তিগত কাব্যানুভূতি যতক্ষণ পর্যন্ত সর্বমানবের প্রত্যয়-আলোকে বিভাসিত নবসৃষ্টিতে মূর্ত না হইল, ততক্ষণ পর্যন্ত উহা সত্যিকার সমালোচনার পর্যায়ে উন্নীত হয় না।

সমালোচনা সম্বন্ধে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সাহিত্যে আজ পর্যন্ত যে-সকল পদ্ধতি অনুসৃত হইয়াছে, তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নিম্নে আলোচনা করা হইল--

(১) অলঙ্কারিক পদ্ধতি (Analytical Method) – কাব্যবিচারে যাঁহারা কাব্যের শব্দ ও অর্থালঙ্কারের আস্বাদন করেন, তাঁহারা এই পদ্ধতি অনুসরণ করেন। ইঁহাদের মতে কাব্যের প্রয়োজনীয়তা শুধু অলঙ্কারের চারুতায়। ‘কাব্যং গ্রাহ্যমলয়ংকারাৎ’।

এইরূপ বিশ্লেষণাত্মক পদ্ধতি সম্বন্ধে আমাদের বক্তব্য এই যে, ইহা সাহিত্যকে সমগ্রতায় দেখে না; ইহা ভুলিয়া যায় যে, সাহিত্যের বিষয়বস্তু যে বিশিষ্ট সালঙ্কারমূর্তি পরিগ্রহ করে, উহার সর্বাঙ্গীণতা অবিভাজ্য।

(২) ঐতিহাসিক পদ্ধতি (Historical Method) – যে - সমালোচনা যুগচিত্ত, পারিপার্শ্বিক ও গ্রন্থকারের ব্যক্তিমানস কাব্যবিশেষে কতখানি মূর্ত হইয়াছে, ইহার বিচার করে, তাহা ঐতিহাসিক পদ্ধতির শ্রেণীভূক্ত। যুগচিত্ত ও পারিপার্শ্বিক গ্রন্থকারের ব্যক্তি-মানসকে প্রভাবিত করিতে পারে সন্দেহ নাই, কিন্তু শুধু এই বিচারেই সাহিত্যের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ হয় না। শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক যুগচিত্ত ও পারিপার্শ্বিককে নিজের মনের জারকরসে রসায়িত করিয়া যে যুগ ও কালাতিত সাহিত্যসৃষ্টি করিতে পারেন, এই পদ্ধতি তাহা উপলব্দি করে না। এতদ্ব্যতীত, এই পদ্ধতি অনেক সময় অতিরঞ্জনের দ্বারা কোন কোন কাব্যকে শ্রেষ্ঠ বলিয়া গ্রহণ করিতে পারে বলিয়া ইহা নিরাপদ নয়। ‘বঙ্কিম-মানস’ - এ শ্রী অরবিন্দ পোদ্দার, ‘নূতন সাহিত্য সমালোচনায়’ শ্রীবিনয় ঘোষ এই পদ্ধতি অনুসরণ করিয়াছেন।

(৩) সনাতন বিধিসম্মত পদ্ধতি (Classical Method) - সাহিত্যবিচারের উহার বহির্গত কতকগুলি সনাতন বা প্রাচীন নিয়মাবলীর সাহায্যে সমালোচনা এই পদ্ধতিমূলক। এই পদ্ধতি অতিশয় রক্ষণশীল মনোবৃত্তিসম্পন্ন এবং ইহা ভুলিয়া যায় যে, সাহিত্য শুধু গ্রন্থকারের ব্যক্তি-অনুভূতি ও সৃষ্টিকর্ম-নিয়মাধীন এবং উহার বহির্গত নিয়মে সাহিত্যসৃষ্টি সম্ভব নয়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ‘মেঘদূত’ সনাতন-বিধিসম্মত সমালোচনা।

(৪) মনস্তত্ত্বমূলক পদ্ধতি (Psycho-analytical Method) – যে সমালোচনা পদ্ধতি সাহিত্যবিচারে গ্রন্থকারের ব্যক্তিগত জীবন বা তাঁহার নির্জ্ঞান মনের ছাপ সাহিত্যে কতখানি মূর্ত হইয়াছে, ইহার বিচার করে, তাহা এই পদ্ধতির অন্তর্ভুক্ত। বলা বাহুল্য, এই সমালোচনা সাহিত্যের নয়, বরং সাহিত্যিকের ব্যক্তিগত জীবন বা চরিত্রের সমালোচনা মাত্র। ইংরেজি সাহিত্যে Herbert Read এই শ্রেণীর সমালোচক।

(৫) ব্যক্তিগত সমালোচনা (Personal Criticism) – যে সমালোচনায় গ্রন্থবিশেষ সমালোচকের নিকট কেমন লাগিয়াছে, এই কথাটাই বড় হইয়া উঠে, তাহাকে ব্যক্তিগত সমালোচনা কহে। সাহিত্যবিচারে সমালোচকের ব্যক্তিগত ভাল-লাগা না-লাগা কথাটি উপেক্ষণীয় নয় বটে, কিন্তু দেখিতে হইবে, সমালোচকের শিক্ষা, সংস্কৃতি, দৃষ্টি, উদারতা ও সাহিত্যবোধ উপযোগী কি না। যোগ্যতমের ব্যক্তিগত সমালোচনায় যেখানে ‘Personal impression’ সর্বজনীন রূপ লাভ করিয়াছে, তাহা মোটেই উপেক্ষণীয় নয়। অধিকারহীন সমালোচকের সাহিত্যবিচার অনেক সময়ই স্পর্ধিত আস্ফালনে পর্যবসিত হইতে পারে এবং ব্যক্তিগত সমালোচনা অধিকাংশ সময় অতিরঞ্জনের প্রশ্রয় দিয়ে থাকে। দীনেশ সেনের এবং রবীন্দ্রনাথের অধিকাংশ সমালোচনা এই শ্রেণীর। বাংলায় পূর্ণচন্দ্র বসুর ‘সাহিত্যে খুন’ প্রবন্ধটি ব্যক্তিগত সমালোচনা কতদূর পর্যন্ত অপাংক্তেয় হইতে পারে, তাহার নিদর্শন। সমালোচক সনাতনপন্থা অনুসরণে শেক্সপীয়রের মহত্ব বিচার করিতে বসিয়াছেন, কিন্তু তাঁহার অতিরিক্ত নীতিজ্ঞান ও অনুদারতা, মানব-চরিত্র ও নাট্যরস-জ্ঞানের অভাবে তাঁহার দৃষ্টিকে বিভ্রান্ত করিয়া তুলিয়াছে। তাঁহার সমালোচনার একটু নমুনা দিতেছি-

‘শেক্সপীয়রের প্রতিভার দোষ নহে, শেক্সপীয়রের রুচির দোষ- সে রুচি এরূপ হত্য ব্যাপারে আনন্দ পাইত, সে রুচি একজন কৃষ্ণকায় মুরকে ঐরূপ নির্দ্দয় পামর রূপে চিত্রিত করিতে বড় আমোদ লাভ করিত।’


(৬) তত্ত্বসন্ধানী পদ্ধতি (Philosophical Method) – আলোচ্য সাহিত্য বা কাব্য কতখানি সমাজকল্যাণ সংশোধিত করে বা উহার মধ্যে কোন সত্য নিহিত আছে, অথবা উহার সৌন্দর্য বা রসতত্ত্বের স্বরূপই বা কিরূপ, সাহিত্যবিচারে যাহারা ইহাদের আলোচনা করেন, তাঁহারা এই পদ্ধতি অনুসরণ করেন। ‘মৃচ্ছকটিক’ নাটক সমালোচনা ভূদেব মুখোপাধ্যায় এবং রবীন্দ্র-সমালোচনায় অজিত চক্রবর্ত্তী এই শ্রেণীভূক্ত। এই প্রসঙ্গে বলা যায় ‘সাহিত্য ও কাব্যের লক্ষ্য সমাজরহিত… এ মত সত্যিকারের কাব্য পরীক্ষার ফল নয়, তথ্য থেকে চোখ ফিরিয়ে একটা মনগড়া তত্ত্ব’ (অতুল চন্দ্র গুপ্তঃ কাব্য জিজ্ঞাসা)। এতদ্ব্যতীত, জীবন-স্পর্শ বর্জিত নিছক সৌন্দর্য বা রসতত্ত্বের আলোচনা নন্দনতত্ত্বের আলোচনার বিষয় হইলেও সাহিত্যে উহার প্রয়োগ আনুসঙ্গিক মাত্র। সাহিত্যে সত্যানুসন্ধানও যুক্তিযুক্ত নহে, কারণ ‘সত্য কাব্যের লক্ষ্য নহে, কাব্যের উপাদান’(অতুল চন্দ্র গুপ্তঃ কাব্য জিজ্ঞাসা) মাত্র।

(৭) তুলনামূলক সমালোচনা (Comparative Criticism) – ম্যাথু আর্নল্ড বলেন, সাহিত্যবিচারে দুইটি বিভিন্ন লেখকের শব্দ-সম্পদ বা পঙক্তির তুলনামূলক বিচারে উভয়ের কৃতিত্ব নির্ধারণ করা যাইতে পারে। তুলনীয় পঙক্তি-নির্বাচনে সমালোচকের রস-বিচক্ষণতাই তাঁহার একমাত্র সহায় – ঐ সকল পঙক্তি বা শব্দ-সম্পদের নিকষ- পাষাণেই কাব্যের শ্রেষ্ঠত্ব বিচার করা যায়। বলা বাহুল্য, আর্ণল্ড তুলনীয় পঙক্তি নির্বাচনের কোন পথনির্দেশ দেন নাই, দ্বিতীয়ত, কাব্যবিশেষের ইতস্তত বিক্ষিপ্ত, দুই একটি উৎকৃষ্ট পঙক্তি উহার সর্বাঙ্গীণ সৌন্দর্যের পরিমাপক হইতে পারে না। তৃতীয়ত, দুইটি বিভিন্ন কাব্য-প্রকৃতি এক ধর্ম, এক গোত্র, এক সুর, এক ভঙ্গি, একই দৃষ্টিসম্পন্ন না হইলে উহাদের তুলনায় কাব্যের উৎকর্ষ-বিচার লাঞ্ছনায় পর্যবসিত হইতে পারে। তবে, সাহিত্যের তুলনামূলক আলোচনায় পরস্পরের উৎকর্ষাপকর্ষ বিচার অনেকখানি সুষ্পষ্ট হইয়া উঠে।

(৮) পরিসংখ্যান পদ্ধতি (Statistical Method) – বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় শতকে যে নূতন ধরনের সমালোচনা কেহ কেহ প্রবর্তন করিতে চাহিয়াছিলেন, তাহার প্রণালী অভিনব বটে। লেখকের ব্যক্তিজীবন, পারিপার্শ্বিক, সমাজজীবন ও ব্যক্তিপ্রতিভার যে প্রকাশে সাহিত্য সৃষ্ট হয়, তাঁহারা উহার আলোচনা না করিয়া রেখাচিত্র (Graph) এবং পরিসংখ্যা (Statistics)- এর সাহায্যে সমালোচনা করিতেন। এইজন্য তাঁহারা কোন লেখকের বিচিত্র শব্দ-সম্পদ ও ভাবকল্পের (Image) বিক্ষিপ্ত ব্যবহারের সংখ্যা নির্ধারণ করিয়া উহার সাহায্যে কবি-মানসের উপর আলোকপাত করিতে চাহিতেন। এই জাতীয় সমালোচনায় Vernon Lee ও Caroline Spurgeon প্রসিদ্ধ। বাংলায় এখনও এই জাতীয় সমালোচনার আবির্ভাব হয় নাই।

(৯) বস্তুনিষ্ঠ পদ্ধতি (Objective Method) – যে পদ্ধতি সাহিত্যকে সাহিত্য হিসেবে, বিশিষ্ট এবং একক সৃষ্টিকর্ম হিসাবে বিচার করে, তাহাকে বস্তুনিষ্ঠ পদ্ধতি বলা যাইতে পারে। এই বিচারে বিশেষ কোন যুগ-চেতনা সাহিত্যে মূর্ত হইয়াছে কি না, ইহা মোটেই মুখ্য নহে; প্রাচীন বিধিসম্মত বিচারেও ইহা সাহিত্যের মূল্য নির্ধারণ করে না; ইহাতে গ্রন্থকারের ব্যক্তিজীবন কতখানি সাহিত্যে প্রতিফলিত, এই কথাও মুখ্য নহে, অথবা সমালোচকের আত্মম্ভরী মূল্য-নির্দেশেরও এইখানে সুযোগ নাই। ইহার একমাত্র উদ্দেশ্য, কোন ব্যক্তিবিশেষ জাতীয় জীবনের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক রূপে জগৎ ও জীবনকে যে-রূপে দেখিয়াছেন, তাহা তাঁহার দৃষ্টিতে কতখানি স্বাভাবিক ও সত্য হইয়া উঠিয়াছে, তাহারই বিচার। এই সত্যদৃষ্টি সাহিত্যকে স্রষ্টার শিল্পমানস, বিষয়, ভাব ও বাণীভঙ্গির একটি পূর্ণমণ্ডল স্বয়ম্বর রূপসৃষ্টি হিসাবে দেখিতে চেষ্টা করে। এইভাবে দেখিলে সাহিত্যের যে বিচার হয়, উহা মূলত সাহিত্যের ব্যাখ্যা (Interpretative Criticism)। রবীন্দ্রনাথও বলেন-

সাহিত্যের বিচার হচ্ছে সাহিত্যের ব্যাখ্যা, সাহিত্যের বিশ্লেষণ নয়। এই ব্যাখ্যা মুখ্যত সাহিত্যবিষয়ের ব্যক্তিকে নিয়ে, তার জাতিকুল নিয়ে নয়। অবশ্য সাহিত্যের ঐতিহাসিক বিচার কিংবা তাত্ত্বিক বিচার হতে পারে। সে রকম বিচারে শাস্ত্রীয় প্রয়োজন থাকতে পারে, কিন্তু তার সাহিত্যিক প্রয়োজন নেই।

অন্যত্র রবীন্দ্রনাথ এই ব্যাখ্যার স্বরূপ সম্বন্ধে বলেন-

পূজার আবেগমিশ্রিত ব্যাখ্যাই আমার মতে প্রকৃত সমালোচনা- এই উপায়েই এক হৃদয়ের ভক্তি আর এক হৃদয়ে সঞ্চারিত হয়। - যথার্থ সমালোচনা পূজা-সমালোচক পূজারি পুরোহিত, তিনি নিজের অথবা সর্বসাধারণের ভক্তিবিগলিত বিস্ময়কে ব্যক্ত করেন মাত্র।

বলা বাহুল্য, ‘যথার্থ সমালোচনা’ পূজা নহে, পূজাতে শ্রদ্ধা থাকিতে পারে, অন্ধ বিশ্বাসও থাকিতে পারে, কিন্তু পূজায় বিচারবোধ থাকে না। যে সমালোচক ‘পূজার আবেগমিশ্রিত ব্যাখ্যাকেই’ সমালোচনা মনে করেন, তাঁহার কাছে সমালোচনা স্তুতি মাত্র- দোষগুণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা দ্বারা সাহিত্যের সর্বাঙ্গীণ মূল্য পরিমাপ করা তাঁহার পক্ষে সম্ভব নহে- তাঁহার সমালোচনা ‘ব্যক্তিগত সমালোচনা’রই নামান্তর। এইখানে আরও মনে রাখিত হইবে, ‘পূজা’ যেমন সমালোচনা নহে, ‘ঘৃণা’ও তেমন সমালোচনা নহে। ইংরেজি সাহিত্যে Jeffery-র উক্তি ‘This will never do’ - সমালোচনা নহে, উদ্ধত দম্ভোক্তি মাত্র।


বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনায় সমালোচকের যে ব্যক্তি-মানস-দৃষ্টি সাহিত্যে ও কাব্যে কবি-মানসের ‘কায়া-কান্তি’ প্রত্যক্ষ করে, উহাতে ব্যক্তিনিষ্ঠতার স্পর্শ থাকা মোটেই অস্বাভাবিক নহে। কারণ, ব্যক্তিহৃদয় ব্যতীত বস্তুসৌন্দর্যের কোন ‘আলোচনা’ই সম্ভব নহে। বস্তুজগৎ যেমন কবি বা সাহিত্যিকের মনের পরশে রঙিন হইয়া উঠে, সাহিত্যিকের রচনাও (যাহা সমালোচকের বস্তুজগৎ) তেমন সমালোচকের মনের পরশে ‘আরেকটু রঙিন’ হইয়া উঠে। বঙ্কিমচন্দ্র গোবিন্দলাল, ভ্রমর, কুন্দ প্রভৃতি চরিত্র সৃষ্টি করিয়াছেন; শরৎচন্দ্র দেবদাস, মহিম, সুরেশ, রমা, অচলা, কিরণময়ী, কমল প্রভৃতি চরিত্র সৃষ্টি করিয়াছেন। কিন্তু ইহাদের সমালোচক আবার গ্রন্থকারের সৃষ্টির সাহায্যে স্বকীয় কবি-মানসের অভিনব রূপসৃষ্টি করেন। বস্তুত, শ্রেষ্ঠ সমালোচক সর্বমানবের প্রতিনিধিরূপে সাহিত্যিকের রূপসৃষ্টি ও সৌন্দর্য-কল্পনাকে পাঠকের সম্মুখে প্রতিভাত করেন এবং সাহিত্যের এই পরিচয়-প্রদান নবসৃষ্টির মতই হইয়া উঠে। সমালোচক একান্তভাবে ব্যক্তিনিষ্ঠ হইয়াও বহুর প্রতিনিধিত্ব করেন এবং সাহিত্যিক যেমন সাহিত্যের মধ্য দিয়া আত্মমুক্তির সন্ধান করেন, সমালোচকও তেমনই অপরের সৃষ্ট সাহিত্যের মধ্য দিয়া তাঁহার ধ্যানধারণাকে স্পষ্ট করিয়া তোলেন। কাব্যপাঠে পাঠক যে আনন্দ পাইয়াছে, সমালোচনা যদি সে আনন্দ দিতে পারে, তবেই উহা সার্থক সমালোচনা। এই প্রসঙ্গে Middleton Mury-র মত প্রণিধানযোগ্য-

‘If it (criticism) gives this delight, criticism is creative, for it enables the reader to discover beauties and significances which he had not seen, or to see those whice he had himself inglimpsed in a new and revealing light.’

 (আংশিক)

আরও পড়ুন -

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ