প্রাণীজগতে মানুষের একটি বিশিষ্টতা আছে। অন্য প্রাণীদের জীবন যেখানে জন্মদান এবং বেঁচেবর্তে থাকার মধ্যে সার্থকতা পায়, মানুষ সেখানে আরও কিছু সৃষ্টি করে, আরও কিছু অর্জন করে। যে বোধটি মানুষকে এই অনন্যতা অর্জনে তাড়না দেয়, তা তার সৌন্দর্যবোধ। মানুষ নিজের প্রাত্যাহিক কীর্তিসমূহকে তার নিজস্ব সৌন্দর্যচেতনার আলোয় রাঙিয়ে নেয়। আর সেজন্যই ব্যক্তিবিশেষের নান্দনিক উপলব্ধি ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। মানুষের এই উপলব্ধির বহিঃপ্রকাশ স্পষ্ট হয় তার আচরণ, কার্যকলাপ এবং সৃষ্টিশীলতায়। সৃষ্টিশীল কার্যক্রমের উপাদান হল সাহিত্য, চিত্রশিল্প, ভাস্কর্য, সঙ্গীত ইত্যাদি। আর এসবের অন্তর্গত সৌন্দর্যকে অনুধাবনের জন্য যে আলোচনা প্রয়োজন তার নাম নন্দনতত্ত্ব।
নন্দনতত্ত্ব নিয়ে বাংলাভাষায় একাধিক বই রয়েছে। আজ আমরা চিনবো সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম রচিত “নন্দনতত্ত্ব” বইটিকে। আমাদের আজকের আলোচ্য বইয়ের আকার ছোট, মাত্র ৬৪ পৃষ্ঠার। কিন্তু এতটুকু অবয়বের মধ্যে যে প্রসঙ্গগুলো আলোচনা করা হয়েছে, তা নন্দনতত্ত্বকে বুঝতে যথেষ্ট সহায়ক হবে। প্রথমেই সূচিপত্রটি একবার দেখে নেয়া যাক।
- নন্দনতত্ত্ব
- নন্দনতত্ত্ব ও দর্শন
- শিল্পে রূপ ও রস
- শিল্পের সুন্দর ও অসুন্দর
- শিল্পের প্রকাশ ও ভাষা
- শিল্পবিচার
- হৃদয়ের সঙ্গে যোগ
বইয়ের প্রথম ফ্লাপে নন্দনতত্ত্বকে সংক্ষেপে একটু বর্ণনা করা আছে।
নন্দনতত্ত্বের ইংরেজি প্রতিশব্দ Aesthetics। কিন্তু মূল শব্দটি গ্রীক ভাষা থেকে উদ্ভূত। Aesthesis শব্দের অর্থ One who perceives অর্থাৎ যিনি প্রত্যক্ষ করেন। কাজেই Aesthetics মানে প্রত্যক্ষণ শাস্ত্র। প্রাচীন সংস্কৃতে যাকে বলা হয় বীক্ষাশাস্ত্র। বীক্ষণ অর্থও বিশেষভাবে দেখা, অর্থাৎ গ্রীক প্রত্যক্ষণ আর সংস্কৃত বীক্ষণ একই কর্মকাণ্ডের পরিচায়ক। কিন্তু প্রশ্ন আসে, কি জন্য দেখা? এই প্রশ্নের সঙ্গে আরো যোগ করা যায় কিভাবে দেখা, কি জন্য দেখা? উত্তরে বলা যায়, তাদের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য ও সম্পর্কসমূহ তলিয়ে দেখা। কিন্তু প্রত্যক্ষ বস্তুজগতের বাইরেও যে সৌন্দর্যের অস্তিত্ব তাকেও দেখতে হবে; অবাঙ্মানসগোচর পৃথিবীর স্বরূপ সন্ধানও করতে হবে, অর্থাৎ দৃশ্যমান ও অদৃশ্য জগৎ, দেহ ও আত্মার লীলাক্ষেত্র উভয়কে প্রত্যক্ষণ করা।
বইয়ের শেষ প্রচ্ছদে নন্দনতত্ত্ব সম্পর্কে আরো কিছু অনুধাবনের সারাৎসার রয়েছে। মূল আলোচনায় যাবার আগে সেটুকুও আমরা পড়ে নিতে পারি।
জৈবিক প্রয়োজনে মানুষ যা সৃষ্টি করে, তার প্রাথমিক রূপটি খুব সরল। গৃহের প্রয়োজন হয় প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা থেকে নিজেকে আড়াল করার জন্য- এর মূল রূপ সর্বত্রই সরল। এই গৃহ যখন জৈবিক প্রয়োজন মিটিয়ে মানুষের সৌন্দর্যবোধ বা রুচিবোধকে পরিতৃপ্ত করতে যায়, এর রূপ হয় ভিন্ন। এই পরিশীলিত রূপসৃষ্টি শিল্পের কাজ- স্থাপত্যকলার এজন্যই উদ্ভব। একবার এই সৌন্দর্য বা রুচির প্রয়োজন মেটানোর প্রক্রিয়া শুরু হলে এর আর শেষ হয় না- কারণ মানুষের রুচি বা সৌন্দর্যবোধ কোনো নির্ধারিত বস্তু নয়। পৃথিবীতে যত মানুষ তত তার ভিন্ন প্রকাশ। শিল্পের এই বহুবিস্তৃত প্রেক্ষাপট থাকায় এর এক বিশালতা আছে, ব্যপ্তি-গভীরতা আছে। কোনো বিশেষ আলোচনায় শিল্পের স্বরূপ উদ্ঘাটন অসম্ভব ব্যাপার, কোনো দার্শনিক, শিল্পী, চিন্তাবিদ শিল্প সম্বন্ধে শেষ কথা কোনোদিনই বলতে পারবেন না। এজন্য নন্দনতত্ত্ব প্রাচীন শাস্ত্র হয়েও চিরকালই প্রাসঙ্গিক। মানুষের হৃদয়ের প্রকাশের সাথে এর যোগ, মানুষের সৃষ্টির সাথে এর সম্পর্ক, এবং মানুষের কর্মকাণ্ডেই এর বৈধতা, এসব মিলিয়েই নন্দনতত্ত্ব।
প্রথম অধ্যায়ে নন্দনতত্ত্ব কী, কাকে বলে, বিভিন্ন লেখক, দার্শনিক, নন্দনতাত্ত্বিক বিষয়টিকে কীভাবে বুঝেছেন ও ব্যাখ্যা করেছেন তা আলোচনা করা হয়েছে। লেখক প্রথমেই বলেন -
শিল্প মানবমনের আনন্দিত উপলব্ধির বহিঃপ্রকাশ এবং সেই শিল্পকে সৌন্দর্যের নানান দৃষ্টিকোণ থেকে পরীক্ষা বা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা হয় যে শাস্ত্রে, তার নাম নন্দনতত্ত্ব। আনন্দিত উপলব্ধি? বেদনা থেকে কি শিল্প জন্ম নেয় না? নেয়। কিন্তু সে বেদনার প্রকাশেও এক ধরনের আনন্দ থাকে, যন্ত্রণা থেকে এক ধরনের মুক্তি। পৃষ্ঠা- ৭
শিল্প কি এ প্রসঙ্গে আরও কয়েকজন মণীষীর বক্তব্য তুলে ধরেছেন -
সৌন্দর্য ও রমনীয়তর নিরিখে শিল্পের বিচার হলে তার ব্যাখ্যা জগন্নাথ পণ্ডিত যেমন "রসগঙ্গাধর" – এ কাব্যের স্বরূপ নির্ণয় প্রসঙ্গে বলেছেন, লোকোত্তরাহ্লাদজনকজ্ঞানগোচরতা। অর্থাৎ সজ্ঞান বিবেচনার বাইরে আনন্দ সৃষ্টির যে প্রক্রিয়া তাই সৌন্দর্য। বলা যায় তা-ই শিল্প। নন্দনত্ত্বের অন্যতম উপজীব্য এই লোকোত্তরাহ্লাদ। পৃষ্ঠা -৮
বিষয়টি নিয়ে বিদগ্ধ ব্যক্তিমাত্রই নিজস্ব অবস্থান থেকে নানারূপ পর্যালোচনা করেছেন। বোঝাতে চেয়েছেন সৌন্দর্য সম্পর্কে তিনি নিজে কি বোঝেন তার স্বরূপ। ফলে একজনের মতের সঙ্গে অন্যজনের মতপার্থক্য থেকেই গেছে। একথা স্বীকার করতে অবশ্য লেখক কার্পণ্য করেন নি।
নন্দনতত্ত্বের একটি সমস্যা হলো এই যে, এতে কোনো সুনির্দিষ্ট বিচার বিবেচনা চলে না বলে শিল্পের পরিচয় ব্যক্তিতে না ব্যক্তির পরিচয় শিল্পে, এ প্রশ্নের কোনো সদুত্তর মেলে না। আমরা দেখেছি টলস্টয়- এর দেয়া শিল্পের ব্যক্তিকেন্দ্রিক ব্যাখ্যা পরবর্তীদের দেয়া ব্যাখ্যা থেকে আলাদা। তাছাড়া শিল্পীর ব্যবহৃত উপায় উপকরণের ভিন্নতার জন্য শিল্পের প্রকাশ ভিন্ন হয়। এজন্য সংকেতধর্মী শিল্প, বর্ণনা বা প্রকাশধর্মী শিল্প, মূর্ত ও বিমূর্ত শিল্পের চরিত্র আলাদা তাছাড়া aesthetic emotion বা নন্দনতাত্ত্বিক অনুভূতির প্রসঙ্গটিও এখানে প্রণিধানযোগ্য। পৃষ্ঠা - ১০
এই আলোচনাটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে জনৈক নন্দনতত্ত্ব সমালোচকের একটি মন্তব্য এখানে সম্পূর্ণ তুলে দেয়া হয়েছে-
-নন্দনতাত্ত্বিক অনুভূতির স্বরূপ কি এই প্রশ্নের কোন সদুত্তর মেলে না; মেলাবার নয়। কেননা শৈল্পিক আনন্দ-বিষাদ নিয়ে শিল্পানন্দ আস্বাদনের কোন সার্থক মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা করা চলে না। করলে সে ব্যাখ্যা অপব্যাখ্যা হবে। এই ধরনের ব্যাখ্যা-প্রয়াসে এক ধরনের অনুপপত্তি ঘটবে। একে বলা হয়েছে naturalistic fallacy বা প্রাকৃত আভাস। পৃষ্ঠা - ১০
“নন্দনতত্ত্ব ও দর্শন” অংশে দর্শনের সাথে সৌন্দর্যের ঘনিষ্ঠতা কিরূপ বৈশিষ্ট্যের তা আলোচনা করা হয়েছে। দর্শন ও নন্দনতত্ত্বের পথ আলাদা। এই দুইটি ভিন্ন উপাদান ও ভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমাদের সামনে উপস্থিত হয়। এর মানে এই নয় যে তারা পরস্পর বিপরীতমুখী। বরং অনেকক্ষেত্রের নন্দনতত্ত্ব ও দর্শন পরস্পরের পরিপূরকও বটে। প্রচলিত শ্রেণিভেদ অনুযায়ী নন্দনতত্ত্ব দর্শনের মূল্যবিদ্যা (axiology) এর অন্তর্ভুক্ত। আবার মূল্যবিদ্যার ত্রয়ী প্রকাশ সত্য, শিব ও সুন্দরকে কেন্দ্র করে। তবে প্লেটো, মার্ক্সবাদ প্রভৃতি দর্শনের সাথে সাহিত্যের যে বিরোধ তাও নতুন নয়।
এই অধ্যায়ে লেখক বেশ কয়েকজন দার্শনিকের শিল্পবোধ ও মূল্যবিচার নীতি আলোচনা করেছেন। দেখিয়েছেন প্রত্যেকের বিশ্লেষণের প্রেক্ষিতে নন্দনতত্ত্বের বিশালতা।
“শিল্পে রূপ ও রস” অধ্যায়ে শিল্পের যে দুটো মূল ভিত্তি তার স্বরূপ সন্ধান করেছেন। তিনি স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছেন রূপ শুধুমাত্র বস্তু নির্ভর নয়, এর বস্তু বহির্গত একটি সত্ত্বা রয়েছে যা হয়তো সাধারণ মানুষের কাছে অধরা থেকে যায়। তিনি বলেন -
ধ্রুব রূপ বা শুদ্ধ রূপকে ভারতীয় দর্শনে অরূপ আখ্যা দেয়া হয়েছে; এবং শিল্পীর আজীবন সাধনা সেই অরূপের সন্ধান। কবির ভাষায়:
রূপ সাগরে ডুব দিয়েছি অরূপ রতন আশা করি।
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, সৌন্দর্য হচ্ছে রূপের ট্রুথ - রূপের সত্য। সুন্দরের সাধনা তাই অরূপের সাধনা, শুদ্ধ রূপের অন্তরালবর্তী সত্যের। কিন্তু নন্দনতত্ত্বে এই শুদ্ধ রূপের অন্বেষণ ইন্দ্রিয়জ অনুভূতির মধ্য দিয়ে, ইন্দ্রিয়কে অতিক্রম করে, তাকে পাশ কাটিয়ে নয়। পৃষ্ঠা- ৩৩
রস প্রসঙ্গে তিনি আচার্য ভরত মুণি প্রণীত আটটি রসের কথা বলেন। তিনি জানান স্থূল চিন্তার মানুষের রসবোধ ও রসসন্ধানী মানুষের রসবিচার ভিন্ন রকম।
“শিল্পে সুন্দর ও অসুন্দর” অধ্যায়ে তিনি বিষয় দুটির মর্মার্থ পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেছেন। সংস্কৃত শাস্ত্রের উপমা টেনে তিনি বলেন -
সুন্দরের লক্ষণসমূহ যথা -সামঞ্জস্য, সুমিতি, সৌষম্য, অখণ্ডতা তথা বস্তুর সামূহিক প্রকাশ যেখানে নেই, সেখানে সুন্দর নেই; এবং সৌন্দর্যের এই অভাববোধকে আমরা বলি অসুন্দর। পৃষ্ঠা -৩৯
সাধারণ মানুষ সৌন্দর্যকে আদর্শনির্ভর কোন কাঠামোয় বন্দী করতে চায়। কিন্তু শিল্পীসত্ত্বা সৌন্দর্যকে স্থান দেয় তার দিগন্তবিস্তারী মানসলোকে। কারণ -
সুন্দরের সাধনায় শিল্পীকে তিনটি স্তর পার হতে হয়। প্রথমত, সৌন্দর্যের আভাসটি উপলব্ধি করা, এর একটি অস্ফুট রূপ কল্পনা করা, অথবা এই রূপের ব্যঞ্জনা অনুভব করা। দ্বিতীয় পর্যায়ে অনুভূত ব্যঞ্জনটি নিরবচ্ছিন্নভাবে ধ্যানের বস্তুতে পরিণত করে তাকে অভিজ্ঞতার পর্যায়ে নিয়ে আসা; এবং সর্বশেষে তাকে রূপ বা form- এ বিন্যস্ত করা ও রসসিক্ত করা। পৃষ্ঠা -৪০
বস্তুতঃ ‘সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম’ তার “নন্দনতত্ত্ব” বইয়ের মাধ্যমে নন্দনতত্ত্বের ধারণাকে পাঠকের সামনে পরিষ্কার করতে চেয়েছেন। বিষয়টি এতটাই ব্যাপক যে স্বল্প পরিসরে এর আলোচনা অন্ধের হস্তী দর্শনের মত। শিল্পী, কবি, দার্শনিক এবং নন্দনতাত্ত্বিকগণ শিল্পের রহস্য নিরূপণে সহস্র সংজ্ঞা দিয়েছেন। এই সহস্র মতের লক্ষ্য কিন্তু একটা- তা হল উৎকর্ষ, অনুধাবন ও অভিজ্ঞতার নিরীখে একটি আনন্দানুভূতি অর্জন। আর তা সম্ভব নীতিগতভাবে কম ব্যক্তিসাক্ষিক উপলব্ধিতে।
শিল্পরুচি অন্বেষণে উৎসাহী পাঠকের এই বই পড়া উচিত। পৃষ্ঠা কম বলে হয়তো অল্প সময়ে বইটি পড়া সম্পন্ন হবে – এমনটি ভেবে নেয়া অনুচিত। বরং বিষয়ের গভীরতা ও ব্যপ্তি বিবেচনায় এই বই ধীরপাঠ প্রত্যাশা করে। বইটি পাঠের পূর্বে হৃদয়ে যথাযথ সংস্কৃতিবোধ থাকা প্রয়োজন, না হলে শিব দেখতে গিয়ে বাদর দেখার আশংকা থেকেই যাবে।
বইয়ের মধ্যে ছক এবং শেষে একটি গ্রন্থপঞ্জী রয়েছে। ফলে আগ্রহী পাঠকের রসাস্বাদন আকাঙ্ক্ষার তৃপ্তি হওয়া ততোটা কঠিন হবে না।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
নন্দনতত্ত্ব
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
প্রচ্ছদঃ ধ্রুব এষ
প্রকাশকাল-
প্রথম প্রকাশঃ ১৯৮৫
প্রথম সন্দেশ প্রকাশঃ ২০০৬
দ্বিতীয় সন্দেশ প্রকাশঃ ২০১১
প্রকাশনীঃ সন্দেশ, ঢাকা।
পৃষ্ঠাঃ ৬৪
মূল্যঃ ১০০ টাকা
ISBN: 984-70209-0038-0
1 মন্তব্যসমূহ
বাংলা বই আলোচনার বাংলা ওয়েবসাইট? খুব ভালো কাজ হচ্চে৷ চালিয়ে যান৷ আমার মনে হয় বাংলা বই নিয়ে আলোচনা করে এরকম আর কোন ওয়েবসাইট নেই৷ ঠিক তো?
উত্তরমুছুনমার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম