ভারতবর্ষের ইতিহাসে তিন মহান ব্যক্তিত্ব হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহাত্মা গান্ধি ও জওহরলাল নেহেরু। তাঁদের অসাধারণ মণীষা ভারতকে বিশ্বের সামনে এক অসীম উচ্চাসনে স্থাপন করেছে। তাঁদের বৌদ্ধিক পদক্ষেপগুলো কমবেশী আমরা সবাই জানি। সমাজ সংস্কৃতির নেতৃত্বের আসনে থাকায় তাঁদের সম্পর্কে মানুষের জানার আগ্রহ অপরিসীম। ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞানের এই তিন দিকপালকে ভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপন করা হয়েছে 'পৃথ্বীরাজ সেন' লিখিত "তিন নায়কের কলঙ্ক" বইতে। জনসমাজের মণিকোঠায় রাজার আসনে বসে থাকা এই তিন নায়কের একান্ত ব্যক্তিগত জীবনকে তিনি অন্বেষণ করেছেন। মানবীয় জীবনের অনিবার্য দুর্বলতা তাঁদেরও ছিল। জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে তাঁরাও বিভিন্ন অস্বাভাবিক মানসিকতা দ্বারা পরিচালিত হয়েছেন। লেখক পৃথ্বীরাজ সেন ঐসব প্রসঙ্গ নিজে তদন্ত করে উদঘাটন করেন নি। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও বইতে পাওয়া তথ্য সংগ্রহ করে তা নিজের কল্পনার তুলি দিয়ে রাঙিয়ে দিয়েছেন।
লেখক অবতরণিকায় অকপটে স্বীকার করেন:-
এই বইয়ের পাতায় পাতায় যে তিন বিখ্যাত মানুষ সম্পর্কে আলোচনা করা হল, তাঁদের সকলকেই আমি ব্যক্তিগতভাবে শ্রদ্ধা করি। আমি মনে করি, ভারতের জাতীয়তাবাদের উন্মেষ অথবা সংস্কৃতির ক্রমবিকাশে তাঁদের অবদানের কথা কেউ কখনো ভুলতে পারবেন না। তবুও তাঁরা জীবনে চলার পথে এমন কিছু অপকীর্তি করে গেছেন, যাদের বিচার বিশ্লেষণ হওয়া দরকার।
সুদীর্ঘ সাহিত্যজীবনে আমি এর আগে আরও অনেক বিতর্কিত ও দুঃসাহসী অভিযানে মগ্ন ছিলাম। পাঠক-পাঠিকার স্নেহ প্রশংসা ও অভিনন্দন আমাকে আরও দুঃসাহসী করে তুলেছে। এই বইটির মধ্যে দিয়ে আমি সেই তিন মহানায়কের চরিত্রের অন্ধকার দিকগুলিকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। বিভিন্ন পন্ডিতবর্গের লেখা বই এবং পত্র-পত্রিকায় প্রতিবেদনের সাহায্যে এই নিবন্ধ তিনটি রচিত হয়েছে। আমি আবার বলছি, এঁদের চরিত্রে কোনরকম কালিমালেপন করা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি চাইছি, ইতিহাসের আলোকে যেন তাঁদের দ্বৈত সত্তা ঠিকমতো উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।
কোনরকম সূচিপত্রের বালাই না রেখে সরাসরি শুরু করেছেন 'রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর'কে দিয়ে। দীর্ঘ আটষট্টি পৃষ্ঠা ব্যয় করে শুরু করেছেন 'মহাত্মা গান্ধী'র কাহিনী। ১৮২ পৃষ্ঠা পর্যন্ত বর্ণনা শেষে শুরু করেছেন 'জওহরলাল নেহেরু'র প্রসঙ্গ। এটা স্বীকার্য যে, ২০৮ পৃষ্ঠার বইটি রচনা করতে গিয়ে লেখককে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। গ্রন্থপঞ্জীতে প্রায় চল্লিশটি বইয়ের নাম উল্লেখ করেছেন। পৃথ্বীরাজ সেন এই বইগুলোতে প্রাপ্ত তথ্যকে সংক্ষিপ্ত করে সহজভাষায় উপস্থাপন করেছেন।
বইয়ের প্রধান বিষয় পুরুষ ব্যক্তিত্বদের জীবনে একাধিক নারীর আগমন। প্রসঙ্গটি তরলপ্রবণ পুরুষ পাঠকের জন্য বেশ উপাদেয়। তবে লেখকের শালীন রুচিবোধ এই জাতীয় পাঠককে হতাশ করবে। বইয়ের ভাষা বেশ মার্জিত, পরিশীলিত। ফলে একজন রুচিশীল পাঠক শেষ পাতা পর্যন্ত অনায়াসে পড়তে পারবেন, কোনরকম ক্লেশ পেতে হবে না।
লেখকের উপস্থাপনা বৈশিষ্ট্য নিয়ে দু'চারকথা না বললেই নয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনের ভিন্ন দিকগুলোকে তুলে ধরতে গিয়ে লেখক যতটা আবেগপ্রবণ, মহাত্মা গান্ধি ও জওহরলাল নেহেরুর জীবনকাহিনী বর্ণনায় লেখক ততোটাই সংযত। একেবারে বিপরীত। রবীন্দ্রনাথের জীবনের বিভিন্ন ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে কোথাও কোথাও কল্পনার রাশ ছেড়ে দিয়েছেন বলে মনে হয়। কাব্যিক মনোভঙ্গি, অতিকল্পনা মাখানো বিশ্লেষণ, অযাচিত শব্দবাহুল্য কখনো কখনো বিরক্তি উৎপাদন করে। রবীন্দ্রজীবনের এই সব ঘটনা নিয়ে তিনিও যেন গল্প-কবিতা জাতীয় ফিকসন সাহিত্য রচনা করতে বসেছেন- এরকম মনে হয়। প্রকারান্তরে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের ক্ষেত্রে তিনি অনেকটাই সংযত। যথাযথ শব্দের পরিমিত আকারের বাক্য রচনা করতে গিয়ে কোন আবেগবাহুল্যকে প্রশ্রয় দেন নি। নিয়ন্ত্রিত কল্পনাকে মার্জিত শব্দ ও বাক্যে প্রকাশ করেছেন। কোনরকম আবেগপ্রবণ পক্ষপাতিত্ব এর পিছনে রয়েছে কীনা সে সন্দেহ অবশ্য করা যেতেই পারে।
আলোচনার একপর্যায়ে এই প্রশ্নটি স্বাভাবিক যে -বইটি কি পাঠযোগ্য? অন্ততঃ ভদ্র-শালীন পাঠকের হাতে কি এই বই তুলে দেয়া যাবে? তাছাড়াও এরকম প্রশ্ন করা যায় যে- এই জাতীয় বই পাঠের প্রয়োজন আছে কি? আমি মনে করি - হ্যাঁ আছে। মানবীয় জীবনের পশ্চাৎ দিকটিও আলোচনা করা যেতে পারে। এটাতো ঠিক যে একজন মানুষের জীবনযাপনের সর্বদিকে সর্বতোভাবে অমলধবল হওয়া খুব কঠিন। বেশিরভাগ মানুষ নিজেদের অবচেতন মনের অন্তর্গত প্রবণতাগুলোকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করতে পারে না। তাই নিয়ন্ত্রণ করার বদলে নিয়ন্ত্রিত হওয়াকেই স্বাভাবিক বলে মনে করে। মানবীয় জীবনের এইসব দুর্বল মুহুর্তের চিত্রগুলি দেখতে পাওয়ার সাহস থাকা উচিত। এছাড়াও অনেকে আছে জীবনের জৈবিক দিকটিকে আরাধ্য মনে করে। এরকম যাদের চিন্তাভর্তি যৌনতা তারা এই বইটি পড়তে আগ্রহ বোধ করবে। পুলকে পুলকে শিহরিত হয়ে ওঠার প্রত্যাশায় একের পর এক পাতা উল্টে যাবে।
বইয়ের শেষে দেয়া গ্রন্থপঞ্জী'র চল্লিশটি (প্রায়) বই সবার পক্ষে সংগ্রহ বা পাঠ করা সম্ভব না। অথচ এতগুলো বইয়ের নির্যাস ‘তিন নায়কের কলঙ্ক’ বইতে পাওয়া সম্ভব। এপ্রসঙ্গে লেখকের বাণিজ্যবুদ্ধির প্রশংসা করা যেতেই পারে। ১০০০টিরও বেশি বইয়ের লেখক পৃথ্বীরাজ সেনের মার্জিত ও সুসংস্কৃত ভাষারীতির কারণে 'তিন নায়কের কলঙ্ক' বইটি সকলের পাঠযোগ্য। যারা উন্নাসিক তাদের কথা আলাদা। কিন্তু যারা কৌতুহলী তাদের অন্তত জানার জন্য হলেও বইটি পাঠ করা যেতে পারে।
------------------------
তিন নায়কের কলঙ্ক
পৃথ্বীরাজ সেন
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ: পার্থপ্রতিম বিশ্বাস
প্রকাশক: প্রিয়া বুক হাউজ, কলকাতা
প্রথম প্রকাশ: মহালয়া ১৪১৮ বঙ্গাব্দ
পঞ্চম সংস্করণ: বইমেলা ২০১৫
পৃষ্ঠা: ২০৮
মূল্য: ২০০.০০
ISBN: 978-93-81827-12-3
2 মন্তব্যসমূহ
কই এই বইটাকে তো আমার অশ্লীল মনে হয় নি। তিনি জাস্ট ঘটনার বর্ণনা করেছেন। কোথাও তো শ্লীলতা অতিক্রম করেন নি।
উত্তরমুছুনমন্তব্য করার জন্য ধন্যবাদ। আলোচনার কোথাও কিন্তু বইটিকে অশ্লীল বলা হয় নি।
মুছুনমার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম