সত্য রঞ্জন দাস
প্রাচীন সভ্যতা ও তদানিন্তন সংস্কৃতি, আচার আচরণ, যুদ্ধরীতি, ঐতিহাসিক ঘটনা বা তৎকালীন রহস্য সম্বন্ধীয় বই আমার অত্যন্ত পছন্দের। এই ধরনের বই পড়লে সেই সময়ের মানুষের জীবনযাপন, মনন, ধর্মচেতনা, বিজ্ঞানচিন্তা সম্বন্ধে বহু তথ্য পাওয়া যায়। একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় প্রাচীনকালে যত সভ্যতা উন্নতির শীর্ষে উঠেছিল তাদের মধ্যে মিশরীয় সভ্যতার প্রতি বর্তমান যুগের মানুষের আকর্ষণ সর্বাধিক। পিরামিড, মমি, ফারাও, হায়ারোগ্লিফিক্স লিপি, স্ফিংক্স আজও মানুষের মনে এক দুর্নিবার আকর্ষণ সৃষ্টি করে। এই কারনেই ইংরেজি ভাষাতে প্রাচীন মিশর নিয়ে এখনও চলচ্চিত্র তৈরি হয় ও সেগুলি জনপ্রিয়তা লাভ করে। সাম্প্রতিক উদাহরণ মমি সিরিজ।
ইংরেজি ভাষাতে প্রাচীন সভ্যতা সংক্রান্ত অনেক আকরগ্রন্থ থাকলেও বাংলা ভাষায় এই বিষয়ক সঠিক তথ্যবহুল বইয়ের অভাব আমার নজরে এসেছে। বাংলাতে অনেক বই লেখার প্রচেষ্টা হয়েছে বিভিন্ন ইংরেজি বই ও ইন্টারনেট থেকে তথ্য সংগ্রহ করে, কিন্তু আমি এমন কোন বাংলা বই পড়ার সুযোগ পাইনি যেটাতে প্রকৃত অর্থে নির্দিষ্ট প্রাচীন সভ্যতা সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য কালপঞ্জী অনুসরন করে পাঠকের সামনে তুলে ধরা হয়েছে। এই সংক্রান্ত আলোচনার সময় ইতিহাসের অধ্যাপক বন্ধুবর শ্রী রঞ্জিত দেব এই বইটির কথা আমাকে জানান ও নিজের সংগ্রহের এই বইটি আমাকে পড়তে দেন।
বইটি ছয়টি অধ্যায়ে বিভক্ত।
- ১) প্রাচীন মিশরের রূপকথা - ১৪৯ পাতার এই অংশে তৎকালীন মিশরীয় মানুষের ঈশ্বরচিন্তা ও দেবদেবীর বর্ননা করা হয়েছে। মিশরীয় দেবদেবীর শারিরীক গঠনে জন্তুজানোয়ারের প্রভাব, বিভিন্ন ফারাওদের সাথে দেবদেবীর সম্পর্ক নিয়ে বিস্তারিত তথ্য দেওয়া আছে।
- ২) নীলনদের তীরে মানবসভ্যতা - ৩৯ পাতার এই অংশে নীলনদকে কেন্দ্র করে কিভাবে আপার ইজিপ্ট আর লোয়ার ইজিপ্ট গড়ে উঠেছিল তার বর্ননা দেওয়া হয়েছে।
- ৩) পিরামিডের দেশ মিশর - ৯৯ পাতার এই অংশে মিশরীয় সভ্যতায় পিরামিড ও মমির গুরুত্ব সম্বন্ধে বলা হয়েছে। পিরামিড কিভাবে নির্মিত হত বা মমি কিভাবে তৈরি হত সেই বিষয়ে তথ্য দেওয়া হয়েছে।
- ৪) টুটানখামনঃ একটি রত্নোজ্জ্বল সমাধি - ১৩৬ পাতার এই সুবৃহৎ অংশে মিশরের সম্ভবত সর্বাধিক আলোচিত ফারাও তুতেনখামেনের জীবন, শাসনকাল, মৃত্যু, অভিশাপ, সমাধি সম্পর্কিত বিষদ তথ্য দেওয়া আছে।
- ৫) প্রাচীন মিশরীয় ভাষা ও সাহিত্য - ১১ পাতার এই অংশে প্রাচীন মিশরীয় ভাষার বিবর্তন ও হায়ারোগ্লিফিক্স লিপি নিয়ে বলা হয়েছে।
- ৬) প্রাচীন মিশরের পাশাপাশি অন্যান্য মানবগোষ্ঠী- ৪৫ পাতার এই অংশে লেখক মিশরের সমকালীন সভ্যতার পাশাপাশি পৃথিবীর কিছু বিখ্যাত প্রাচীন সভ্যতা সম্বন্ধে একটি রূপরেখা তৈরি করার চেষ্টা করেছেন।
বইটি একটি নিখাদ নন ফিকশন বই। প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা ও তদানিন্তন জনজীবন সম্পর্কে প্রচুর তথ্য দেওয়া আছে। প্রায় সমস্ত তথ্যই বিভিন্ন ইংরেজি বই আর ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত, যা নন ফিকশন বইয়ের অবশ্যম্ভাবী ধর্ম। পাশাপাশি প্রাপ্ত তথ্যগুলিকে লেখক চমৎকারভাবে সময়কাল হিসাবে বইতে সাজিয়েছেন। বইটি পড়লে প্রাচীন মিশর সম্বন্ধে পাঠকের মনে একটি সুস্পষ্ট ধারনা তৈরি হবে। কিন্তু লেখকের লেখনী যথেষ্ট শক্তিশালী নয়, লেখাতে গতির বড়ই অভাব। শুধুমাত্র এই কারনেই এই বইটি প্রচুর তথ্যবহুল হওয়া সত্বেও আমার কাছে আকর্ষণীয় হতে ব্যর্থ । বইটির লেখা অনেকটা স্নাতকোত্তর পর্যায়ের ইতিহাস বইয়ের মতন, যেখানে তথ্যের ভারে বইটি ভারাক্রান্ত। আমার ব্যক্তিগত অভিমত এই বইটি যদি এমন কোন গবেষক লিখতেন যার ভাষা গতিময় তাহলে বইটি অত্যন্ত সুখপাঠ্য হত। এসকল দুর্বলতা থাকা সত্বেও যদি কোন পাঠক প্রাচীন মিশর সম্বন্ধে সঠিক তথ্যবহুল কোন বাংলা বই পড়তে চান তাকে এই বইটি পড়তেই হবে।
বইটি পড়লে প্রাচীন মিশর সম্বন্ধে পাঠকের মনে একটি সুস্পষ্ট ধারনা তৈরি হবে।
-:-:-:-:-:-:-:-:-:-:-:-:-:-:-:-:-
প্রাচীন মিশর - রূপকথা ও রূপান্তর
শ্রী তুষার ঘোষ
প্রচ্ছদঃ শাশ্বত
প্রকাশকঃ পান্ডুলিপি, কলকাতা।
প্রথম প্রকাশঃ বইমেলা, ২০১৩
মূল্যঃ ২৫০ টাকা (বইমেলা, ২০১৮ সংস্করণ)
পাতার সংখ্যাঃ ৫১৪
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম