আজো দুটো শালিক
হাঁটা হাঁটি করে গেলো সামনের রাস্তায়
রোজকার মতোন
তদের গায়ের রঙ এক ,
একই রকম রুক্ষকর্কশ ঠোঁট ,
দুটো ছড়ানো ডানা
তবু পায়ে পায়ে মিল ছিলো বেশ !
[ঘোর, অতীন্দ্রিয় সার্কাস]
অনেকটাই আত্মজাগর কবি বর্ষা জহীন আত্মবিবর হয়ে ছুটেছেন কবিতার সৌন্দর্য বিলাসে। সময় এবং প্রকৃতির নৈস্বর্গের সাথে করে নিয়েছেন বোঝাপড়া, আরো সহজ করে বললে, এক প্রকারের দ্বি-মুখী লিপ্সায় গড়েছেন আপন পৃথিবী। সে জন্যেই কবিতার পংক্তিমালায় নন্দনতাত্বিক দিকটি বিস্মৃত হয়নি একবারও। কবিতার রসায়নে গড়েছেন এক শৈল্পিক দুঃখবোধ, বিরহের প্রতিমা- যে প্রতিমা সকলের তরে উন্মুক্ত থাকে উপাসনালয়ে। তুমুল মনস্তাত্ত্বিক ক্ষুধায় প্রকৃতির প্রসাধন নিয়ে পাঠককে করেছেন আরো বিমোহিত। পাঠকের মনেও মেঘ জমে, কবিতায় শুরু হয় ধারাবর্ষণ। তখন নীড়-হারা পাখির একটা নিরাপদ আশ্রয় খোঁজার তিয়াসা ছাড়া আর কী-বা করার থাকে?
কোথাও নেই কেউ। এই না থাকা জেনেও বিচ্ছিন্নতার মোড়কে
নিজেকে জড়িয়ে আজ হেঁটেছি অনেকটা পথ, একটা একটা করে
সুতোর জট খুলে খুলে কোথায় যে পৌঁছে গেলাম এক নিমিষে।
অথচ, তুমি নেই। তুমি ছিলে না কোনদিনও। কোনখানে।
[না থাকার গল্প ]
বর্ষা জহীনের কবিতায় প্রেমের ঐশ্বর্য্য মূলত বেদনাকে দিয়েছে এক ট্যাজেডি যা সহজেই পাঠকের অন্তরে মর্মর জাগায়। বিনাস্পর্শেই যেনো সমুদ্রের গভীর ঢেউয়ের সাথে ভেসে আসে হৃদয়ঘনিষ্ঠ কল্লোল। শুধু তাই নয়, তার কবিতায় একাকীত্ব এবং নিঃসঙ্গতার মূর্তি এঁকেছেন সুনিপুন; যদিও আধুনিক বাংলা কবিতায় প্রেম, বিরহ-কাতরতা কিংবা অপার আনন্দের মৈথুন খুব সামান্যই একে অপরের প্রতিদ্বন্দী হয়ে পাশপাশি অবস্থান করেছে বরাবর। আদতে হৃদয়ের মৌলিক আকাঙ্খাতেই মানুষ বারবার ফিরে যায় ভালোবাসার কাছে আর ঠিক তখনই প্রকট আকার ধারণ করে বেদনা বোধ। বিষন্নতার সার্কাসে পাখাওয়ালা জাদুকরের মতো খেলায় মেতে ওঠেন কবি। তার পাখার বিলাপের আশ্চর্য মায়াজালে ধরা পড়ে যায় অজস্র হৃদয়ের ক্লেদাক্ত কুসুম।
ভালোবেসে প্রেমিকের ভ্রুণ ফেলে দিয়ে কাতর কিশোরী
খোঁজে জানালার ভ্রান্ত গরাদ ।
আকাশে তখনো জাল পাতা চলে অবিরাম উদ্যোগে
পাখিরা বিপন্নবোধে
শতশত কন্ঠ চিড়ে করে পাখার বিলাপ ।
[পাখার বিলাপ ]
ব্যক্তি সত্তা এবং কবি সত্তা যখন নির্ভেদ হয়ে যায় অনিশ্চিত জেনেও সে প্রেম দিকশুন্য হয় না। এখানে কবির কাছে এক দিকে নারী যেমন প্রেমের প্রতীক, ঠিক তেমনি প্রণয়ের আরতি নিয়ে নারীর ভঙ্গির সামনে তৃণগুল্মের মতই প্রেমিকের আনাগোনা। সময় এবং সমকালীন দ্বিধা-বিভক্তি প্রেমকে টুকরো টুকরো করতে চায়। হৃদয়ের সমস্ত ব্যর্থ বিলাপে কাতর প্রকৃতি ও গ্লানির বিভায় মোড়ানো বর্ষা জহীনের কবিতার পুরোটা শরীর। নদী, পাখি, ফুল, প্রকৃতি বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে তার কবিতায়। কখনো কবি নিজেই যেন তীব্র খরস্রোতা নদী হয়ে যায়; সে খুঁজে ফেরে জলধার, গভীর আবেগ আর বিস্তৃত রুদ্ধতায় গড়েন বেদনাবোধের মূর্তি সমেত।
পাপ ঢুকে যাক ভেতরে ভেতরে
বিকৃত হোক শরীরী কথন,
তবু চকচকে পদ্যের নোটে
বেচবো না মাথা, বেচবো না মন।
পদ্যের নোটে পদ্য সাজাও
কল্পদেবীকে নিয়ে যাও রোজ
বেশ্যা পাড়ায়,খানকাতলায়,
কিংবা তোমার নাকের ডগায়-
[পদ্য বনাম ]
বর্ষা জহীনের কবিতায় প্রণয়ের প্রদাহ তীব্র, প্রেম তাকে ভেঙে-চুড়ে চুরমার করেছে সর্বোপরি; সে প্রণয় স্বেদগন্ধী, রতিমত্ত এবং উদগ্রীব। কয়েক মিলেনিয়াম আঁধার পেরোলেও প্রেম তাকে নিয়ে গেছে পতনের দারপ্রান্তে, অথচ কবি মুছে ফেলতে চেয়েছেন হৃদয়ের সব গ্লানী। কবি শুন্যতায় ভোগেন, আত্মমগ্নতায় প্রেমিকের শরীরে বুনে যেতে চান নিদ্রাহীন মায়াজাল- ফুল তার কবিতায় ব্যক্তি- স্বরূপের অনুধাবন। একটা অদৃশ্য মোহ কেবল পাঠককে চাবুক খাওয়া ঘোরার মতো করেই দাবরিয়ে নিয়ে গেছে শুন্যতার বাগানে, পায়ের ঘোরায় চড়ে বারবার প্রত্যাবর্তনের সাধ জাগে তার- অথচ বাগানটি ছিলো মরা- নিঃষ্প্রাণ।
দুপায়ে যখন ঘোরা ছিলো
কেউ ডাকে নি-
ডাকলে যেতাম বাতাস কিংবা আলোর থেকেও অনেক দ্রুত
পৌঁছে যেতাম তোমার বাড়ির বাগানটাতে
মরা বাগান-
অজস্র ফুল শব্দ দিতাম !
[পায়ের ঘোড়া]
আধুনিক বাংলা কবিতায় যুগ যুগ ধরে রূপক অর্থের ব্যবহার ছিলো ; এছাড়া নব্বই দশকের কবিদের কবিতায় যেমন আবেদন ছিলো তেমনি শুণ্য দশকের কবিদের ভেতরেও এর সার্থক প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায় । বর্ষা জহীনের কবিতায় এই সকল রূপকের ব্যবহার নানান মাত্রা যোগ করেছে, কবিতা পড়তে গিয়ে পাঠকের কাছেও সৃষ্টি হয়েছে একেক রকমের ব্যাখা বিশ্লেষণ। যে বিশ্লেষণের আঙ্গিকে অনেক অসার বস্তুটিও পেয়েছে প্রাণের সঞ্চার। মূলত প্রেমের কবিতায় এভাবেই ছুঁড়তে হয় বুদ্ধির বর্শা। কবি জানেন জগতে আনন্দের চেয়ে যাতনাই বেশি, আর এই যাতনার কারণেই বর্ষা জহীনের কবিতা পেয়েছে বাড়তি অলঙ্ককার। কেননা বেদনাই হোল একমাত্র অনিঃশেষ প্রাণেশ্বর। বেদনার আগুন নেভাতেই কবি খুঁজেছেন দমকলের প্রশান্তি ...
আগুন জ্বলতেই থাকে, যেহেতু,
জ্বলাটাই তার কাজ,
যেমন পানির কাজ আগুন নেভানো ।
কিছু মানুষ থাকে পানির মতো
যেমন তুমি । আগুনের ফুলকিগুলো
ভালোই নেভাতে জানো ।
[ প্রিয় দমকল]
কবিতার রোমান্টিকতার চরম মূর্তি এঁকেছেন কবি বর্ষা জহীন। খুব সাবলীল কবিতা সত্তায় নির্মিত হয়েছে তার প্রতিটা কবিতার চিত্রকল্প। শুকনো নদীর মত তার আকাঙ্খা বাড়ে, চৈত্রের পুড়ে যাওয়া জমিনে অনুসন্ধানী চোখ খুঁজে ফেরে ঠান্ডা জলের মুখ। আগুন আর পানির মাঝামাঝি যে ফরমেটে নিয়ে গেছেন কবিতার পংক্তিমালাকে তা কবির শুধু না পাঠকের ইন্দ্রীয়ের আগুন নেভাতেও বেশ কার্যকরি দমকল এটি। তারপরও অবাক হতে হয় প্রতিদিন নিজের সাথেই বেড়ে ওঠা চল্লিশ দিনের ছায়াকে দেখে-
আমার সঙ্গে যে ছায়াটা থাকে
আনুমানিক এক চিল্লাকাল -
সেও আমার শরীরের সব তিল চেনে।
অথচ আমি- হঠাৎ কোনটা দেখে ফেলে
তাজ্জব বনে যাই- কই, চিনি নাতো!
[তিল]
নিজের মধ্যেই অন্য এক জীবনের চলাচল, যে জীবন জীবনের প্রতিচ্ছবি হয়ে থাকে সারাক্ষণ। অচেনা হলেও বিষ ফলার মতো ক্রমেই শরীরে আঘাত করে, প্রাণের সহজ লীলায় কখনো এমন চিহ্ন খুঁজে পেয়ে চমকে ওঠে কবি। অনন্ত অভিসারে এক আশ্চর্য পুলকিত হওয়ার আকাঙ্খা নিয়ে মুখে করে ধুতরা ফুল উড়ে যায় শেকল-পরা পায়রা এক- জাগতিক লেনাদেনা শেষে কী ছিলো তার মতো এখন অসহায় পাখিটির মনে-
বৃক্ষরা রাতভর নড়ে চড়ে আবারো ঝড়িয়ে দিলো পাতা
কাতর কান্না বেজে গেলো বাতাসে, ভোরেরও আগে,
কিছু সৌখিন সুবাতাস টিস্যু পেপারের গন্ধ নিলো ঠোঁটে,
ভয়ানক শক্ত হয়ে থাকা আঙুলের ফাঁকে- কতগুলো
পিঁপড়েড় সারিবদ্ধ দল, হেঁটে হেঁটে পায়ে
নেচে গেলো চিত্রাঙ্গদা নাচ।
[ অতীন্দ্রিয় সার্কাস ]
কারো উচ্চাভিলাসী বেলকোনিতে দীর্ঘকাল একটা খাঁচায় বন্দি পাখির মতই নিয়তিকে মেনে নিয়ে কবি বর্ষা জহীন তার ছড়িয়েছেন কেবল অনিশ্চিতে। নাগরিক পাঁচিলে বারবার আটকে গেছে তার ক্রন্দনধ্বনি, টবের জৈব সরে ফুটে ছিলো যে অনাদরে, বিমুগ্ধ বকুল ঘ্রাণ বিলানো শেষে ঝড়ে গেছে তা-ও। দূরের অতীন্দ্রীয় সার্কাস থেকে ভেসে আসছিলো যেন এক বিষন্নপাখির বিলাপ।
চোখ ক্রমশ সাদা হয়ে যাচ্ছে মানে-
ভালোবাসা তার হারাচ্ছে বৈভব!
[বিবর্ণতার রঙ ]
শিকারির কার্তুজ খাওয়া যে পাখি মুক্তির আকাঙ্খায় ডানা মেলে দেয়, আকাশে সে পাখি যোদ্ধা।
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম