মানুষ ঠিক কতদিন আগে মূর্তি তৈরি করা শুরু করেছিল, তা নিশ্চিত হওয়া যায় নি। তবে একটা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে তার একটা কাল ধারণা করা যায়। মরক্কোর টানটন শহরের নিকটবর্তী 'দ্রা' নামের এক নদীর কূলে অবস্থিত এক প্রত্নস্থলে খননকার্য চলাকালে একটি পাথুরে নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়। মাটির স্তরটি ছিল প্রাগৈতিহাসেক যুগের। প্রাপ্ত নিদর্শনটি প্রায় ৬ সে. মি. লম্বা। এর অবয়ব অনেকটা মানুষের মত। শুধু মাথা, হাত ও পায়ের পাতা ছিল না। ধারণা করা হয় এটা কোন মূর্তি হতে পারে। পরীক্ষা করে জানা গেছে পাথরের মূর্তিটির বয়স প্রায় ৪ লক্ষ বৎসর। ১ লক্ষ বৎসর পূর্বে মানুষ আগুন আবিষ্কার করে। আর ৪ লক্ষ বৎসর পূর্বে মানুষ পুরোপুরি জান্তব জীবন যাপন করত। সম্ভবত এতদিন আগের মানুষের একটাই প্রতিনিধি আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে। তাদের নাম দেয়া হয়েছে অস্ট্রালোপিথেকাস। এই পাথরের মানবীয় অবয়বটি তাদের সমসাময়িক কারও কীর্তি বলে ধারণা করা হয়।
অস্ট্রালোপিথেকাস মানুষরা যুথবদ্ধ শিকারীজীবন যাপন করত। পরবর্তীতে মানুষ যখন কৃষিকাজ আবিষ্কার করল ( নব পাথরের যুগ, ১২০০০-৪০০০ খ্রি.পূ.) , তারপর থেকে সমাজে মূর্তির সংখ্যা বেড়ে গেল। পূর্বে মানুষ নিজ জীবনের নিরাপত্তা তথা ভীতি দূরীকরণ, শিকারে সফলতা, পশুর সহজলভ্যতা ইত্যাদি উদ্দেশ্যর বাস্তবায়ন আশা করত। পরে কৃষিজমির উর্বরতার পরিচয় তারা বুঝতে পারল। তারা আবিষ্কার করল যে উর্বরতা শক্তি ভূমির বিভিন্ন উপাদানে সুপ্ত অবস্থায় থাকে, তাকে বিভিন্ন ক্রিয়াকর্মে জাগিয়ে তুলতে হয়। এছাড়াও জীবন কি, কোত্থেকে আসে, মানুষ মারা যায় বা কেন ইত্যাদি বিবিধ ভাবনায় তাড়িত হয়ে মানুষের মনে অধ্যাত্ম চিন্তার উদ্ভব ঘটল। ৬০ হাজার বৎসর পূর্বের নিয়ান্ডারথাল মানুষের মনে আধ্যাত্মবাদী চিন্তার প্রথম উদ্ভব ঘটেছিল বলে ধারণা করা হয়। এরকম বিভিন্ন ভাবনাচিন্তাকে লালন ও পালনের জন্য প্রয়োজন কোন এক অবয়বের। সংক্ষেপে এভাবেই আবিষ্কার হল মূর্তির। মূর্তি তৈরির সময় মানুষের মনে অধ্যাত্ম চিন্তার প্রয়োজনীয়তাই প্রথমত উপস্থিত ছিল। নন্দনতাত্ত্বিক অনুভূতির প্রয়োজনীয়তা সময়ের বিবর্তনের সাথে সাথে যোগ হয়েছে। মূর্তি সাধারণত মানুষের দেহাবয়বে তৈরি হয়। মূর্তিগুলো সাধারণত দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু সে দাঁড়ানোর অবয়বে রয়েছে বিভিন্ন পার্থক্য। এগুলোর নাম- অতিভঙ্গ, ত্রিভঙ্গ, আভঙ্গ, দ্বীভঙ্গ। কোন কোন মূর্তিকে বসা অবস্থায় উপস্থাপন করা হয়েছে। ভঙ্গিভেদে বসার নাম ভিন্ন রকম। যেমন- উতকিতিকাসন, বীরাসন, পদ্মাসন প্রভৃতি। মূর্তির হাতের তথা বাহু, হাতের পাতা ও আঙুলের বিন্যাসে রয়েছে বিভিন্নরকম ভাবব্যঞ্জনা। এগুলোকে মুদ্রা বলে। ব্যঞ্জনাভেদে মুদ্রার প্রকৃতিও বিভিন্ন রকম। যথা- নমস্কার, অভয়, জ্ঞান, বিতর্ক, কন্টক, ধর্মচক্র, বরদ, ভূস্পর্শ, অঞ্জলি, অর্ধচন্দ্র, ক্ষেপণ, উত্তরবোধি, তর্পণ, বজ্রহুংকার, বিস্ময় প্রভৃতি। মূর্তির শরীরে শিল্পীর কল্পনাকে আশ্রয় করে ফুটে উঠে বিভিন্ন গহনা। কর্ণকুণ্ডল, অঙ্গুরীয়, কণ্ঠালঙ্কার, উদরবন্ধ, নূপুর, মল, অঙ্গদ, কঙ্কণ, যজ্ঞোপবীত, নিবিবন্ধ, মেখলা ইত্যাদি। মূর্তির পোশাক, বাহন ও হাতে ধরা বস্তু তথা আয়ুধ এর বিভিন্নতায় রয়েছে কল্পনার বৈচিত্র। মূর্তি সম্পর্কিত এইসব বিভিন্ন বিচিত্র তথ্যকে "হিন্দু জৈন বৌদ্ধ মূর্তিতাত্ত্বিক বিবরণ" নামাঙ্কিত গ্রন্থে সংকলিত করেছেন মো: মোশাররফ হোসেন।
Icongraphy শব্দটির বাংলা পরিভাষা নেই। প্রত্নতাত্ত্বিক মো: মোশাররফ হোসেন প্রস্তাব করেছেন একটি নতুন অভিধা -"মূর্তিতাত্ত্বিক বিবরণ"। মূর্তি বিষয়ে আমাদের দেশে প্রাজ্ঞ ব্যক্তির সংখ্যা নিতান্তই কম। এদের মধ্যে মো: মোশাররফ হোসেন নিজকর্ম ও পাণ্ডিত্যগুণে সকলের কাছে পরিচিত। তার "হিন্দু জৈন বৌদ্ধ মূর্তিতাত্ত্বিক বিবরণ" গ্রন্থটি উপর্যুক্ত বিষয়ে একটি আকরগ্রন্থ বলে বিবেচিত। গ্রন্থের প্রসঙ্গকথায় লেখক বলেছেন-
শিল্পের ভাস্কর্য শাখার কিছু-কিছু নিদর্শন বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে মূর্তি নামে পরিচিত। মূর্তির সাথে ভাস্কর্যের মূল পার্থক্য হল প্রথমটি মূলত ধর্মীয় উপাত্ত, আর দ্বিতীয়টি কেবলই নান্দনিকতা বোধ-তাড়িত শৈল্পিক অভিব্যক্তির প্রতিসরণ। তাই মূর্তি গড়ার ক্ষেত্রে শাস্ত্রীয় বাঁধন, আর ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে নান্দনিকতার সম্পর্ক জড়িত। কিন্তু উভয় নিদর্শন গড়তে শিল্পীর প্রয়োজন। সুতরাং যে-উদ্দেশ্যেই একটি মূর্তি গড়া হোক না কেন তাতে শৈল্পিক অভিব্যক্তির প্রকাশ ঘটবেই। তাই মূর্তি-আলোচনার জন্য প্রধানত দুটি দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে হবে। প্রথমত, শাস্ত্রীয় বিধান এবং দ্বিতীয়ত শৈল্পিক প্রলক্ষণ। এ ছাড়া মূর্তিগুলো ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব চর্চার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আবার কোনো কোনো মূর্তিতে কখনও-বা লিপি উৎকীর্ণ থাকে। সেক্ষেত্রে এমন নিদর্শন ইতিহাস-ঐতিহ্যের অজানা তথ্য সংগ্রহে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। আর এসব গুরুত্ব বিবেচনা করেই শিল্প-ঐতিহাসিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিকদের নিকট মূর্তিবিষয়ক আলোচনা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয়। এ-আলোচনাটিকেই ইংরেজিত 'আইকনগ্রাফি' বলা হয়। আলোচ্য পুস্তকে আইকনগ্রাফির পরিভাষা হিসেবে 'মূর্তিতাত্ত্বিক বিবরণ' অভিধা প্রস্তাব করা হল।
শিল্প-রসিক, ইতিহাস-ঐতিহ্যের গবেষক, জাদুঘরকর্মী, বিভিন্ন পেশাদার ও বিষয় সংশ্লিষ্ট ছাত্রছাত্রী এবং বিদগ্ধ পাঠক প্রমুখের কাছে বইটি বিশেষ আগ্রহের বলে বিবেচিত হবে। কারণ বিভিন্ন মূর্তির যথাযথ বিবরণ, আলোচনা, শৈল্পিক মান, প্রয়োজনীয় রেখাচিত্র সহ ব্যাখ্যা, টীকা-টিপ্পনি এবং উপযুক্ত তথ্য নিদের্শনার ফলে বইটি একাডেমিক মান বহন করে। এর কলেবর সীমিত। বৈশ্বিক বা সর্বভারতীয় নয়, শুধুমাত্র বাংলাদেশ অঞ্চলে প্রাপ্ত মূর্তিগুলোর প্রেক্ষাপট, উদ্ভব, বিকাশ ও নন্দনতাত্ত্বিক আলোচনা বইয়ের প্রসঙ্গ বলে বিবেচ্য হয়েছে। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক আলোচনার জন্য ইতিহাসের কিছু উপাদানও যোগ করা হয়েছে।
বইটির আকর্ষণীয় সূচিপত্র হল:
- প্রসঙ্গকথা
- অধ্যায় এক
- পরিস্ফুটন তালিকা
- অধ্যায় দুই
- মূর্তিতাত্ত্বিক পরিপ্রেক্ষিত
- অধ্যায় তিন
- শিল্পশৈলী বিবর্তনের ধারা
- অধ্যায় চার
- হিন্দু মূর্তিতত্ত্ব
- অধ্যায় পাঁচ
- জৈনমূর্তিতত্ত্ব
- অধ্যায় ছয়
- বৌদ্ধ মূর্তিতত্ত্ব
- অধ্যায় সাত
- বাংলাদেশের মূর্তিতত্ত্ব
বাজারে এখন এই বইটি পাওয়া যায় কি না তা জানা যায় নি। তবে পাওয়া গেলে ভাল। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বই বাংলা ভাষায় তেমন নেই বললেই চলে। প্রাচীন শিল্পীদের ভাবনার প্রতিচ্ছবি থেকে যায় তাদের তৈরি মূর্তি-প্রতিমাগুলোয়। হাজার বৎসরের পুরনো শিল্পীর সেই ভাবনাকে সমকালে এসে উন্মোচন করতে পারা একটি বুদ্ধিবৃত্তিক কীর্তি বটে।
হিন্দু জৈন বৌদ্ধ মূর্তিতাত্ত্বিক বিবরণ
মো: মোশাররফ হোসেন
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম