মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন যে সময়ে জন্মগ্রহণ করেন (১৮৮০ শতকের দিকে), সে সময়ে অশিক্ষা, কুশিক্ষা, ধর্মীয় কুসংস্কার এবং নানারকম সামাজিক অবরোধ প্রথা বেশ ভালো করেই জেঁকে বসেছিল বঙ্গীয় সমাজে। তাই একটি পশ্চাতপদ সময়ে জন্মগ্রহণ করা বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের জন্য নারীদের জন্য স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরী করার পথটি ছিল না অত সহজ। তাঁর জীবনাবলী এবং সাহিত্যকর্মের দিকে আলোকপাত করলে তিনি আমাদের সামনে অনেক রূপেই উপস্থিত হন। এটি আমাদের জন্য বেশ সৌভাগ্যের ও বিষয় বলতে হবে। কারণ নারী হয়ে নারীদের কথাগুলো সাহস করে, দৃঢ়তার সাথে বলবে, সেই সময় ও সমাজকে বিবেচনা আনলে অবশ্যই কঠিন ছিল। তাঁর আবির্ভাবের সময়টি যদি আমরা বিবেচনায় নিই, দেখব, কঠিন সময় ও সমাজ বাস্তবতার সাথে লড়াই করে, তিনি আমাদের মাঝে বহুমাত্রিক কর্মে ও নৈপূণ্যে চিরস্মরণীয় হয়ে মুক্তির পথ দেখিয়েছেন। একাধারে তিনি ছিলেন সমাজ সংস্কারক, নারী জাগরণের অগ্রদূত এবং নারী সমাজ ও পারিপার্শিকতাকে জাগানোর জন্য তুলে নিয়েছিলেন ক্ষুরধার লেখনী।
আবহমান কাল থেকে বাঙ্গালী নারী-পুরুষের ঘরে-বাহিরে যে অবস্থান দৃশ্যমান, তাঁর সাথে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের চিন্তা ও সংগ্রাম কোনটাই সাংর্ঘষিক ছিল না; বরং তা ছিল পরিপূরক। তবে নারী পুরুষের পারিবারিক ভূমিকা পালন বা সামাজিক অবস্থানগত পার্থক্য নিয়ে তিনি ভেবেছেন এবং ভূমিকার জায়গাটা যথাযথ হচ্ছে কিনা সে সর্ম্পকে প্রশ্ন তুলেছেন। সমাজ ও পরিবারের চিরকালীন প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থান এবং তার ফাঁকফোঁকরকে আমাদেরকে দেখিয়ে দিয়েছেন নিখুঁত করে। প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর বাইরে না গিয়ে তাঁর চিন্তাধারা ও লেখনীগত সংগ্রাম সেসময়ের সমাজসহ বর্তমান সমাজেও যে কারনে ভাবনার বিষয়। নারী তার ভূমিকা পালন করতে গিয়ে নিগৃহীত হচ্ছে কিনা? হলে কেনইবা হচ্ছে? সে কি সক্ষম হতে পারছে নিজেকে পরিপূর্ণ বিকশিত করতে? মনুষ্যরূপে পরিবার ও সমাজের কাছে কতটুকু আদরনীয়? এ রকম কিছু প্রশ্ন বেগম রোকেয়ার মনে জেগেছিল। বস্তুত তাঁর মনে যে প্রশ্নগুলো জেগেছিল তা অস্বাভাবিক নয়, কারন তাঁর সময়ে মেয়েদের পড়ালেখা ও বাহিরের জগত ছিল নিষিদ্ধ। তিনি নিজে একটি সম্ভ্রান্ত বংশে জন্মগ্রহণ করার কারনে এবং তাঁর শিক্ষিত ভাই ও বোনের সহায়তায় উর্দুসহ অন্যান্য ভাষাজ্ঞান ও পড়ালেখা শিখতে পেরেছিলেন। এর থেকেই আমরা বুঝতে পারি বাকিদের অবস্থা ছিল কেমন দুর্দশাগ্রস্ত। বাস্তবের কাছে গিয়ে দেখেছেন, গৃহজীবন ও পারিবারিক জীবনে নারীর কোনঠাসা অবস্থান, নারীদের লাঞ্ছনা, মর্যাদাহীনতা। গৃহের যাবতীয় কাজ করতে গিয়ে নারীরা কিরূপে গৃহ ও গৃহস্বামীর দাসী হয়ে জীবন কাটাতে বাধ্য হয়েছে । আত্মসম্মানবোধের অভাবহেতু ও মর্যাদার প্রশ্নে তারা নিজেদের কখনও চিনিতে পারে নাই। এখানেই ছিল বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের আত্মপ্রত্যয়ী ও সংগ্রামী অবস্থান।
যে গৃহকার্য নির্ধারিত সেটাও পরিপূর্ণভাবে সমাজে স্বীকৃতি লাভ করেনি; যদিও তা অতি গুরুত্বপূর্ন কাজ। কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক বাস্তবতায় এর কোন আর্থিক মূল্য বা স্বীকৃতি নেই। বরং অপরের উপর নির্ভর করে যেহেতু জীবনধারণ করতে হয় বিধায় অপরের ক্রীড়ানক হয়ে পড়া তার জন্য বাস্তবতা হয়ে দাড়ায়। শারীরিক দূবর্লতা হেতু তার কাজকে সমাজ ও পরিবার সীমিত আকারে দেখা শুরু করে। গৃহ, সেবিকারূপে অপরের সেবা করা, বাচ্চা ধারন, সন্তান প্রতিপালন, ইত্যাদি ভিন্ন জগত নারীর জন্য নিষিদ্ধ রুপে ছিল।পুরুষের জন্য যে কর্মজগত সেখানে কি নারীরা ভূমিকা রাখে না বা রাখতে পারে না? চিরন্তন ভূমিকার পাশাপাশি অন্যমহিমায় প্রতিষ্টিত হওয়া আদৌ কি কোন প্রয়োজন বা গুরুত্ব নেই? এবং অবশ্যই লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে নারী তার ভূমিকায় কতটুকু সন্তুষ্ট? তাঁর অতৃপ্তি এবং উত্তরণের জায়গাটি কোথায়? নিজস্ব উপলব্ধিতে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন সুশিক্ষা ও নিজেদের আত্মমর্যাদার অভাব হেতু নারী কি রুপে সমাজ ও পরিবারের দাস হয়ে উঠে। সুশিক্ষার অভাব ও পরাধীনতার কারনে তার অস্তিত্ব কিভাবে সংকটের সম্মুখীন। বস্তুত বেগম রোকেয়া নারীর এ হেন অবস্থার জন্য দাসত্ব নামক এক বিশেষ রোগকে চিহ্নিত করেছিলেন। তাঁর জীবদ্দশায় ছোট গল্প ভ্রাতা ও ভগ্নী, তিন কুঁড়ে, পরী-ঢিবি সহ রসরচনা পঁয়ত্রিশ মণ খানা, বিয়ে-পাগলা বুড়ো রচনা করেছেন যেমন, তেমনি আমাদের উপহার দিয়েছেন মতিচূরের মত মহামূল্যবান প্রবন্ধগ্রন্থ। এছাড়া সুলতানার স্বপ্ন, পদ্মরাগের মত উপন্যাস, অগ্রন্থিত প্রবন্ধ ও কবিতা রচনা করে ও বাঙ্গালী সাহিত্যভান্ডারকে করেছেন সমৃদ্ধ।
“স্ত্রী জাতির অবনতি” শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি নারীদের মধ্যে ”দাসত্ব” নামক রোগকেই অধ:পতনের মূল রুপে চিহ্নিত করেন। এজন্য আমাদের সামনে বেশকিছু সুচিন্তিত মতামত ও প্রশ্ন তুলে ধরেন। যেখানে পুরষ জাতি ক্রমান্বয়ে উন্নতি করেছে, সেখানে নারী জাতির দুর্দশা ও লাঞ্ছনার কারন কি? নারীরা অবদমিত ও অত্যাচারিত হবে এই কি সমাজের মনোবাসনা? নারী সুগৃহিনী, সুমাতা ও সুরন্ধন শিল্পী হতে চাইলে ও তো নারীর সুশিক্ষিত হওয়া একান্ত জরুরী। তাঁর ভাষায়, ঐরুপ আমাদের আত্মাদর লোপ পাওয়ায় আমরাও অনুগ্রহ গ্রহণে আর সঙ্কোচ বোধ করি না। সুতরাং আমরা আলস্যের, - প্রকারান্তরে পুরুষের- দাসী হইয়াছি। ক্রমশ: আমাদের মন পর্যন্ত দাস হইয়া গিয়াছে এবং এবং আমরা বহুকাল হইতে দাসীপনা করিতে করিতে দাসত্বে অভ্যস্ত হইয়া পড়িয়াছি। এইরুপে আমাদের স্বাবলম্বন, সাহস প্রভৃতি মানসিক উচ্চবৃত্তিগুলি অনুশীলন অভাবে বারবার অঙ্কুুরে বিনাশ হওয়ায় এখন আর বোধহয় অঙ্কুুরিত ও হয় না।
আবার অন্যত্র “অর্দ্ধাঙ্গী” শীর্ষক প্রবন্ধে “দাসত্ব” নামক রোগটির বিস্তারের ফলাফলস্বরূপ নারীদের সামাজিক অবস্থান বা সমাজ মূর্তিটার বিকৃত রূপটাই লেখিকা উদাহরণের মাধ্যমে চমৎকারভাবে আমাদের সামনে উপস্থাপন করেন।
লেখিকা বলেন, শুক্লকেশ বুদ্ধিমানগণ এর মতে, আমাদেও সাংসারিক জীবনটা দ্বিচক্র শকটের ন্যায়-ঐ শকটের এক চক্র পতি, অপরটি পত্নী। তাই ইংরাজী ভাষায় কথায় কথায় স্ত্রীকে অংশিণী, উত্তমার্দ্ধ ইত্যাদি বলে। অতীতে বোধহয় গার্হস্থ্য ব্যাপারটাকে (রাজ্যশাসনের সূক্ষ্ম রীতি নীতি বৈশিষ্ট্যমন্ডিত) মস্তকস্বরুপ কল্পনা করিয়া শাস্ত্রকারগণ পতি ও পত্নীকে তাহার অঙ্গস্বরূপ বলিয়াছেন এবং বর্ত্তমান যুগে সমাজের মূর্তিটা কিরুপ তাহা বুঝানোর জন্য তিনি একটি বৃহত দর্পণের সাথে তুলনা করিয়াছেন যার দক্ষিণাঙ্গভাগ পুরুষ এবং বামাঙ্গভাগ স্ত্রী গন্য করিলে তাঁহার নিরীক্ষণে যে মূর্ত্তিটা ফুটে উঠে তার রুপ বিশাল বিকট। এ মূর্ত্তিটাকে একটি দ্বিচক্র শকটের সাথে ও তিনি তুলনা করেছেন। যে শকটের একচক্র বড় (পতি) এবং একচক্র ছোট (পত্মী) হয়, সে শকট অধিক দূরে অগ্রসর হইতে পারে না; সে কেবল একই স্থানে (গৃহকোণেই) ঘুরিতে থাকিবে। তাই ভারতবাসী উন্নতির পথে অগ্রসর হইতে পারিতেছেন না। সমাজের বিধি ব্যবস্থা আমাগিদকে তাহাদের (পুরুষ) অবস্থা হইতে সম্পূর্ণ পৃথক রাখিয়াছে; তাঁহাদের সুখ দু:খ একপ্রকার, আমাদের সুখ দু:খ অন্যপ্রকার।
১৯৩১ সালে প্রকাশিত হওয়া নারীদের দুর্দশার চিত্রসম্বলিত একটি গ্রন্থ হলো তাঁর “অবরোধ-বাসিনী”; যেখানে আমরা দেখি অবরোধ প্রথায় নারীরা সেসময় কি কঠিনরুপেই না আবদ্ধ ছিল। অবরোধ প্রথা ও পর্দা দুইটি ভিন্ন বিষয়। পর্দার ব্যাপকতা ও এটি যখন নারীর জীবন ও অস্তিত্বকে বাধাগ্রস্থ করে তখন সেটাকে তিনি পর্দা না বলে অবরোধ বলেছেন। অবরোধের কঠোরতায় সেইসময় নারীদের পরপুরুষ তো দূরের কথা, বাহিরের নারীদের সামনে ও পর্দা করতে হয়েছে। গৃহে যখন ডাকাত পড়ত তখন নিজেদের পর্দা হানি হবে ভেবে ভীত হয়ে ডাকাতদের হাতে সম্পদ বা স্বর্নালংকার সমর্পণ করেছে নারীরা। নারীদেরকে দূরের আত্মীয় স্বজনের কাছে পাঠানোর সময় পালকীতে পর্দার উপর পর্দার পরত তৈরী করা হতো। এতে বোঝা যায় নারীটির দম বন্ধ হয়ে মরার উপক্রম হলে ও সম্মানের ভয়ে চুপচাপ সহ্য করেছে এবং ঐ সময়ে কত মেয়েদের জীবনহানি ঘটেছে।
তাঁর সময়ের সমাজকে জাগ্রত করার জন্য তিনি যে শুধু লেখনী তুলে নিয়েছিলেন তাই নয়, তাঁর সংগ্রামের জায়গাটি ছিল বহুমাত্রিক। তিনি চেয়েছেন নারীরা শিক্ষিত হোক। শিক্ষাই পারে তাদের পরিপূর্ণ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে। শিক্ষা সর্ম্পকে তাঁর মতামত ছিল অনেক গুরুত্বপূর্ণ। নারীদের শিক্ষিত করে তোলার জন্য ছাত্রী সংগ্রহ ও একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্টা জন্য মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। অর্থসংগ্রহের জন্য কম চেষ্টা করেননি। এরজন্য তাঁকে অনেক কাঠগড় পোড়াতে হয়েছে। নারীর কর্মে, মননে দাসত্বের নিদর্শন থেকে মুক্তি পেতে চাইলে স্ত্রী শিক্ষাজরুরী। কোনরকম গৃহকর্ম সমাধা ও বাচ্চা প্রতিপালন করতে পারলেই তাকে স্ত্রী শিক্ষা বলে না। এরূপ হলে সে জাতি ও বেশীদূর এগোতে পারে না। স্ত্রী শিক্ষা বললেই অনেকেই নাক উঁচুতে উঠাতে পারেন। কিন্তু স্ত্রী শিক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন বেগম রোকেয়ার মত কেউ বুঝতে পারেননি। তাঁর মতে শিক্ষার অর্থ কোন সম্প্রদায় বা জাতিবিশেষের অন্ধ অনুকরণ নহে। ঈশ্বর যে স্বাভাবিক জ্ঞান বা ক্ষমতা দিয়াছেন, সেই ক্ষমতাকে অনুশীলন দ্বারা বৃদ্ধি করাই শিক্ষা। যেখানে পুরুষেরা শিক্ষার বলে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ,ব্যবসায়ী, পেশাজীবী মানুষ হতে পারে সেখানে নারীদের হতে সমস্যা কোথায়? নারী কি দাসত্ব থেকে মুক্তি চায় না? এর জন্য প্রয়োজন তার অর্থনৈতিক স্বাবলম্বীতা অর্জন। লেডী কেরানী হতে লেডী ম্যাজিষ্ট্রেট, লেডী ব্যারিষ্টার সকল কিছুই নারী হতে পারে। নিজেদের হাত পা মগজ বুদ্ধিকে শানিত করতে পরিশ্রম করলেই তা বই দাসত্ব নামক রোগ থেকে নারীর মুক্তি মিলবে। অত্যাচার ও এ পথে বিলোপ হবে। নারী যেহেতু সমাজের অর্দ্ধাঙ্গ অতএব তাকে বাদ দিয়ে সমাজের সম্পূর্ন উন্নতি ঘটতে পারে না। শারীরিক দূর্বলতাহেতু ও সংসার ধর্মপালনে তার যে অবমূল্যায়ন তা থেকে মুক্তি পেয়ে নিজেকে মানুষরুপে নিজের অবস্থান নির্ণয় করতে শিখুক। নারীর যথাযথ ভূমিকাতে থেকে ও তাদেরকে কি করে সুশিক্ষিত করে তোলা যায় তা ছিল বেগম রোকেয়ার আগ্রহের বিষয়। ১৯০৯ সালে সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের স্বামী পরলোক গমন ঘটলে তাকে ভাগলপুরে সমাহিত করা হয়। স্বামী ও দুসন্তানের অকাল মৃত্যুর শোক আজীবন বইয়ে ও তাঁর স্বপ্নের বাস্তবায়ন থেকে পিছুপা হননি। মাত্র পাঁচজন ছাত্রী নিয়ে নিজের ঐকান্তিক চেষ্টায় ভাগলপুরে তদানীন্তন ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট সৈয়দ শাহ আব্দুল মালিকের সরকারী বাসভবন গোলকুঠিতে ১লা অক্টোবর সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। বিদ্যালয় প্রতিষ্টা করে নারীদের সুশিক্ষিত করে গড়ে তোলাই হয়ে উঠে তাঁর ব্রত ।
লেডী কেরানী হতে লেডী ম্যাজিষ্ট্রেট, লেডী ব্যারিষ্টার সকল কিছুই নারী হতে পারে।
লেখিকার আরেকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো "সুলতানার স্বপ্ন’। মূলত কল্পবৈজ্ঞানিক মনোমুগ্ধকর উপন্যাস যেটি ১৯০৫ খ্রীস্টাব্দে ’ইন্ডিয়ান লেডিস ম্যাগাজিন’’- এ প্রকাশিত হয়েছিল। নারী যে অন্তপুরবাসিনী এতে কি তার মনন ও সামাজিক বিকাশের পথটি রুদ্ধ হয়ে পড়ে না? তাঁর মুক্ত হওয়ার হওয়ার দিকটি কল্পনা ও স্বপ্নের বেশে ”সুলতানার স্বপ্নে” বিবৃত হয়েছে। এই উপন্যাস পড়েই আমরা বুঝতে পারি নারীদের পৃথিবী পুরুষদের পৃথিবী থেকে আলাদা কিছু নয়। তাদের ও পুষ্পশোভিতউদ্যান, তারকারাশি,জোৎস্নার রূপ, জলের কলকল ধ্বনির মত বাহিরের পৃথিবীর সমস্ত রূপ সৌন্দর্যের ঘ্রাণ নেওয়ার ও ছোঁয়ার অধিকার রয়েছে। তাতে অধ:পতনের ও কিছু নেই।
“সাধনা” পত্রিকার অগ্রহায়ণ ১৩২৮ সংখ্যায়- শিখা গোষ্ঠীর আবুল হোসেন সুলতানার স্বপ্ন এর আলোচনায় বলেন -
পুরুষ না হইলে আমাদের নারী একেবারে অকর্মণ্য ও অসহায়, মূর্খ ও অজ্ঞ বলিয়া সে পুরুষের উপর তাহার জীবনের মাত্র অস্তিত্বটুকুর জন্য নির্ভরশীল, একথা কেবল পুরুষের দ্বারাই নিখিল বিশ্বে ঘোষিত হইয়াছে, এবং সেই ঘোষণা দ্বারা নারী ও তাহার শক্তি আছে একথা বিশ্বাসই করিতে পারে না। পক্ষান্তরে নারী যে ক্ষমতাসম্পন্ন সে যে পুরুষের মতো, এমনকি তদপেক্ষা অধিকতর প্রতিভাবতী হইতে পারে- তাঁহার শক্তিকে জাগ্রত করিলে যে প্রকৃতিকে নিজের আয়ত্তাধীন করিয়া পুরুষের বিন্দুমাত্র সাহায্য ব্যতিরেকে সে দুনিয়ার বুকে নির্মল সৌন্দর্য, সম্পদ ও কল্যাণের বিরাট ক্ষেত্র সৃষ্টি করিতে পারে, তাহা ঐ লেডী ল্যান্ড এর নারীদের ক্ষমতার দৃষ্টান্ত দ্বারা মিসেস আর. এস. হোসেন অতি অসহায়া বঙ্গীয়া নারী-হৃদয়ে আত্মবিশ্বাস ও আত্মশক্তির বীজ বপন করিবার উদ্দেশ্যে বোধ করি এই সুলতানার স্বপ্ন রচনা করিয়াছিলেন।
তাঁর রচিত অসাধারণ আরেকটি অনুবাদ গল্প হলো ’’ডেলেশিয়া হত্যা’’। মূল রচনাটি হলো উপন্যাস। ডেলেশিয়া হত্যার সাথে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন আমাদের সমাজে সমাজে ঘটে যাওয়া অসংখ্য ডেলিশিয়াকে আমাদের সামনে হাজির করেছেন, যারা প্রতিনিয়ত হত্যার স্বীকার হচ্ছে। এজন্য তিনি লেখিকা ডেলেশিয়ার (মূল উপন্যাসের নায়িকা) ন্যায় আমাদের সামনে হাজির করেন মজলুমার ন্যায় সাধারণ এক নারীকে। ইংল্যান্ডের ডেলিশিয়া আর বাংলাদেশের মজলুমা। দুই ভিন্ন রাষ্ট্র, সমাজ আর পরিবারের বাসিন্দা হলে ও ইংল্যান্ডের নারী সমাজের সহিত ভারতের ললনা সমাজের নির্যাতিত হওয়ার ধরনে রয়েছে চমতকার সাদৃশ্য, মৌলিক কিছু ভিন্নতা ছাড়া। যেখানে ডেলিশিয়া নিজস্ব শিক্ষা ও ব্যক্তিত্বের গুণে ইংল্যান্ডের ধনী স্বাধীন একজন নারী, সেখানে মজলুমা অতি সাধারণ দরিদ্র ও নিরক্ষর একজন নারী। কিন্তু দুজন দুই জগতের বাসিন্দা হলে ও তাদের জীবনের পার্থক্যগুলো কি রূপ? ইংরাজ রমণীর জীবন কি বঙ্গদেশের নারীদের জীবনের থেকে খুব বেশী উঁচুতে? আমাদের ও কি তাদের জীবন কামনা করা উচিত? আপাতদৃষ্টিতে তা মনে হলে ও কার্যত দৃশ্যমান হয় অন্তসারশূন্য এক চিত্র, যেখানে ডেলেশিয়ারা আর মজলুমরা গুমরে গুমরে কাঁদে। মজলুমারা যেখানে তাঁর অন্নবস্ত্রের জন্য পরের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে, অযোচিত অনেক অন্যায় সহ্য করে দারিদ্র আর শিক্ষার অভাবে, সেখানে ডেলেশিয়ার ন্যায় হতভাগী নারীদের ও পরের মুখাপেক্ষী হয়ে না থাকতে হলে ও স্বামীর বিশ্বাসঘাতকতার জন্য মূল্য দিতে হয়। একজন লেখিকা হওয়া সত্ত্বে ও তিনি সে সমাজে আদরনীয় হননি। পাননি কোন মূল্য। বরং অপরের মুখ ও নিজ স্বামীর মুখে শুনেছেন নিজের অপবাদ। এমনকি তাঁর লেখক সত্ত্বা নিয়ে ও সন্দেহগ্রস্থ সমাজ। নারী হবে নম্র,শান্ত, তার কেন এত উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও খ্যাতির আশা থাকবে? পুস্তক রচনা কেবল পুরুষের কার্য্য। রমনীগণ কেবল নানাপ্রকার বেশভূষায় সজ্জিতা হইয়া বিলাসপঙ্কে নিমজ্জিতা থাকিবে! আর যদি একান্ত প্রয়োজন হয় তবে যে নারীর বয়স নাই, রুপ নাই- যে অতি বিশ্রী কদাকার কুৎসিতা, সেই লেখনী ধারণ করুক! তাঁর যখন বিবাহ হয় তখন রমণীদের উপহাস - ডেলেশিয়া রমনী হয়ে কেন অলঙকার পরিধান করেনি? এই তো গেলো সেই দেশের রমনীদের মানসিক মনোভাব। বাংলাদেশের রমনীদেরও তদ্রুপ অবস্থা। সোনাদানা এবং কার কতটুকু অবস্থাপন্নসম্পন্ন ঘরে বিবাহ হলো তা দিয়ে নারীর মর্যাদা নির্ণিত হয়। সেকারনে নিগৃহীত হলে স্বামীগৃহে এদেশের মজলুমারা যেখানে কোন কিছু বলতে না পারার অভাবে, মুখ বুজে অত্যাচার সহ্য করে, বাধ্য হয়ে অত্যাচারী স্বামীর পদতলে জীবন কাটায়, নিজেকে দাসী মনে করে সেবক হয়ে আজীবন কাটিয়ে দেয়, ঠিক তদ্রুপ ডেলিশিয়াদের ওরকম না হলে ও কতিপয় ভিন্ন কারণে প্রাণ দিতে হয়। তাইতো লেখিকার মুখে উচ্চারিত হয় “পুরুষ” অপেক্ষা কুকুর শ্রেষ্ঠ প্রাণী”।
বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের রচনাবলী এবং তাঁর জীবনের গতিপ্রবাহই যদি আমরা দেখি, তবে আমরা দেখব, একক কোন কিছুতেই তিনি নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। তাঁর সাহিত্যকর্ম এবং জীবনের কাছে নত না হওয়ার মানসিকতাই তাঁকে লক্ষ্যের দিকে পৌঁছাতে সাহায্য করেছে। তাই বলে এটি তাঁর কোন সহজযাত্রা নয় তা আমি পূর্বেই বলেছি। সে সময়কার সাহিত্য মহল ও সমাজের আক্রমণের শিকার হয়েছেন, প্রংশসিত হওয়ার পাশাপাশি হয়েছেন সমালোচিত। তিনি যখন নারী শিক্ষা, নারী অধিকার ও পুরুষ শাসিত সমাজে নারীর করনীয় কি অগ্রপথিক হিসেবে দেখিয়েছেন; তখন অনেকেই তাকে আক্রমণ করেছেন। তিনি লেখনী এবং সংগ্রামের মাধ্যমে উত্তর দিয়েছেন।
তারঁ রচিত মতিচুর প্রথম খন্ডের দীর্ঘ সমালোচনা করেছিলেন দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার (কোহিনূর পত্রিকার তিনটি সংখ্যায়), যেটির সমালোচনায় তিনি বলেন, বাঙ্গালা ভাষা এখন আর নিতান্ত দীনা নহে। বাঙ্গালা সাহিত্যে এখন জাতীয়তার লক্ষণ দেখা দিয়েছে। কোন জাতীয় সাহিত্যের উন্নতি -পক্ষে কবিতা এবং উপন্যাসের বাহুল্য অনাবশ্যক না হইলে ও গুরু সন্দর্ভাদি দ্বারাই সাহিত্যে দৃঢ়তা, গুরুত্ব এবং শক্তি সঞ্চারিত হয়। গুরু সন্দর্ভ সাহিত্য-শক্তির পরিচয় দেয় এবং তাহাকে উদ্বোধিত করে; সুতরাং গভীর গবেষণা,ভাব এবং চিন্তাপ্রসূত নানা বিষয়ক সর্ন্দভ যত প্রচারিত হয়, ততই মঙ্গল। “মতিচূরকে” তিনি এইরূপ একখানি সন্দর্ভ গ্রন্থ উল্লেখ করে বলেন, সর্ন্দভ-গ্রন্থ, সন্দর্ভ -বিষয় এবং সন্দর্ভ -রচয়িত্রী প্রভৃতি বিবিধ হিসাবে ‘মতিচূরে’র মূল্য এ সময়ে বড় বেশী।
সে সময়কার সাহিত্য মহল ও সমাজের আক্রমণের শিকার হয়েছেন, প্রংশসিত হওয়ার পাশাপাশি হয়েছেন সমালোচিত।
আবার অন্যস্থলে তিনি বেগম রোকেয়ার দিকে ইঙ্গিত করে বলেন,- ‘আমি (বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন) ভগিনীদের কল্যাণ কামনা করি; তাহাদের ধর্মবন্ধন বা সমাজ বন্ধন ছিন্ন করিয়া তাঁহাদিগকে একটা উন্মুক্ত প্রান্তরে বাহির করিতে চাহি না।..আপন আপন সম্প্রদায়ের পার্থক্য রক্ষা করিয়া ও মনটাকে স্বাধীনতা দেওয়া যায়।.. মহারাণী ভিক্টোরিয়া যেমন সুদূর ইংলন্ডে থাকিয়া ভারত সাম্রাজ্য শাসন করিতেছেন, সেইরুপ অন্ত:পুরে থাকিয়া ললনাকুল ও ইচ্ছা করিলে অনেক মহতকার্য্য করিতে পারেন। ‘দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার বলেন, এত বেশ কথা। সমাজবন্ধন ঠিক রাখিয়া স্ত্রী জাতির পক্ষে যেরুপ উন্নতি উপযুক্ত, তাহাতে তাঁহাদের ন্যায্য দাবি আছে। সে অধিকার হইতে বঞ্চিত করিয়া থাকিলে সেরুপ সমাজের সংস্কার অবশ্যই করণীয়; কিন্তু গ্রন্থের সকল স্থলে ত ঠিক এরুপ ভাব বুঝা যায় না। ‘পুরুষের স্বামীত্ব স্বীকার না করিলেই ত সমকক্ষতা হয়,’ কন্যাগুলিকে সুশিক্ষিতা করিয়া কার্য্যক্ষেত্রে ছাড়িয়া দাও, - নিজের অন্ন বস্ত্র উপার্জ্জন করুক,’- এরুপ কথায় কি সমাজবন্ধন অবিচ্ছিন্ন রাখিবার ভাব বুঝায়? যাহা বুঝায়, তাহাতে এই বুঝি যে, গ্রন্থকর্ত্রীর মূলমন্ত্র স্ত্রী- স্বাধীনতা। দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার, নারীর শারীরিক দূর্বলতাকে পুরুষের সমান শক্তিসম্পন্না না হওয়ার মূল কারন হিসেবে দেখেছেন। তা শুধূমাত্র সমাজবিধি বলের অভাবে স্ত্রীজাতি হীন হয় তা নয়, প্রকৃতির উপর নির্ভর করে যে সকল জীবন সেখানে ও স্ত্রী পুরুষ-তুলনায় দুর্বলা। আবার যেহেতু স্ত্রী ও পুরুষে শারীরিক শক্তি-বিষয়ে বিষমতা রয়েছে, অতএব উভয়ের কর্ম ও শিক্ষা ঠিক সমান হতে পারে না।
অন্যদিকে বেগম রোকেয়ার জীবন ও সাহিত্যকর্মকে নিয়ে কবি ও গবেষক আব্দুল কাদিরের নিরীক্ষা বাংলাসাহিত্যে ভিন্নমাত্রা সংযোজন এনে দেয়। তাঁর নিরীক্ষার সারমর্মটুকু হলো এই যে-
বেগম রোকেয়া যে সময়ে জন্মগ্রহন করেছেন তখনকার চারপাশেরসমাজ- অবরোধবন্দিনী নিগৃহীতা নারী-সমাজেরঅজ্ঞানতা ও নির্জীবতার বেদনা তাঁকে অস্থির করে তুলেছিল। উনি যখন প্রশ্ন তুলেন,’আমাদের এ বিশ্বব্যাপী দাসত্বের কারণ কেহ বলিতে পারেন কি?- তার অন্তরালে যে দাহ লুকায়িত এর তীব্রতাই বেগম রোকেয়ার সমস্ত রচনায় সঞ্চারিত হয়েছে। বেগম রোকেয়া বলেন- ‘স্বীকার করি যে, শারীরিক দুর্বলতাবশত: নারীজাতি অপর জাতির সাহায্য নির্ভর করে; তাই বলিয়া পুরুষ প্রভু হইতে পারে না’। কুসুমের সৌকুমার্য হরিণের কটাক্ষ নিদ্রার মোহ ইত্যাদি তেত্রিশটি উপাদান ললনা নির্মিত হইয়াছে’ এই কথা তিনি ও জানিতেন- কিন্তু নারীর সেই আত্মিক প্রকৃতির বিশ্লেষণের চাইতে সামাজিক জীবনের ক্রমভঙ্গতার দিকেই তাঁর ছিল অধিক দৃষ্টিপাত। ‘বাস্তবিক অলংকার দাসত্বের নির্দশন বই আর কিছু নয়;-নারীর এই আত্মার দাসত্ম স্কলনের জন্য তিনি প্রস্তাব করিয়াছিলেন: ’অলংকারের টাকা দ্বারা জেনানা-স্কুলের আয়োজন করা হউক।, স্ত্রীশিক্ষার ব্যবস্থা যথাযোগ্যরুপে হইলেই নারীর উন্নতি অনিবার্য হইবে; তার কুসংস্কারপ্রিয়, রক্ষণশীল অথচ ফ্যাশনবিলাসী, আবেগপ্রধান প্রকৃতি প্রকৃতিস্থতা লাভ করিবে; এই দুর্নাম ঘুচিয়া যাইবে; এই সহজ অথচ সুদৃঢ় বিশ্বাস তাঁর ছিল।” আমরা পুরুষের ন্যায় সুশিক্ষা ও অনুশীলনের সম্যক সুবিধা না পাওয়ায় পশ্চাতে পড়িয়া আছি।’
‘মতিচূর’ ১ম খন্ডে ’বোরকা’প্রবন্ধে তিনি বলিয়াছেন:..বোরকা জিনিষটা মোটের উপর মন্দ নহে। উন্নতির জন্য অবশ্য উচ্চশিক্ষা চাই।..পর্দা কিন্তু শিক্ষার পথে কাঁটা হইয়া দাঁড়ায় না। আমাদের শিক্ষয়ত্রীয় অভাব।
বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে নারী লেখক বিরল, সেদিক দিয়া ’অবরোধ-বাসিনী’ উল্লেখনীয় কিছু নিশ্চয়ই। তিনি পর্দা চাহিয়াছেন, কিন্তু তার বাড়াবাড়ি পছন্দ করেন নাই; বলিয়াছেন: ঐ সকল কৃত্রিম পর্দা কম করিতে হইবে।’ তাঁর মধ্যে বিদ্রোহের উদ্দামতার চাইতে এই যে সংযম ও মমত্ববোধের প্রাচুর্য, তার মূলে রহিয়াছে তাঁর নারী প্রকৃতি। অবশ্য পর্দা বলিতে যে তিনি নারীর সবল ব্যক্তিত্বই বুঝিতেন তার ইংগিত নিমোক্ত ছত্রটিতে আছে: ’বর্তমান যুগে ইউরোপীয় ভগ্নিগণ সভ্যতার চরম সীমায় উঠিয়াছেন,তাঁহাদের পর্দা নাই কে বলে?”
আবার অন্যত্র নবনূরের বার্ষিকী সংখ্যায় “গ্রন্থ সমালোচনা’ লেখেন আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ ও সম্পাদক সৈয়দ এমদাদ আলী। ১৩১২ ভাদ্রে ’গ্রন্থ- সমালোচনা’ বিভাগে ’মতিচূর’ প্রসঙ্গে বলা হয়:
মতিচূরের প্রবন্ধগুলি যখন প্রথমে ’নবনূরে’ প্রকাশিত হয়, তখন তাহা পাঠে আমাদের সহিষ্ণুতার বাঁধ টুটিয়া গিয়াছিল। এই উত্তেজনার ভাব কথঞ্চিৎ প্রশমিত হইলে পর গ্রন্থখানি পুনরায় পাঠ করি এবং সেই সময় মতিচূর সম্বন্ধে হৃদয়ে একটু অনুকূল ধারণা জন্মে।...লেখিকার সকল কথা না হইলে ও অনেক কথাই নিরেট সত্য এবং মতিচূর প্রকৃত মতিচূরই বটে। উপযুক্ত পাকে ফেলিয়াই লেখিকা এই মতিচূর প্রস্তত করিয়াছেন। এই গ্রন্থের ভাষা সরল ও প্রাঞ্জল এবং রচনাভঙ্গি অতি মনোরম। কোন পুরুষ লেখকের পক্ষে ও এইরুপ ভাষার গ্রন্থ রচনা করা শ্লাঘার বিষয়। লেখিকা তাঁহার বক্তব্য ভাল করিয়াই বলিতে পারিয়াছেন। তাঁহার পূর্বে কোন মুসলমান লেখক ও এতগুলি সামাজিক বিষয়ের আলোচনা করেন নাই। তাঁহার সকল মতের সহিত আমাদেও ঐক্য না থাকিলে ও আমরা কর্ত্তব্যানুরোধে এইরুপ আলোচনার জন্য তাঁহার প্রশংসা না করিয়া থাকিতে পারিতেছি না।
সমাজ-সংস্কার করা এক কথা, আর সমাজকে বেদম চাবুক মারা আর এক কথা। চাবুকের চোটে সমাজ-দেহে ক্ষত হইতে পারে, কিন্ত তদ্বারা সমাজের কোন ক্ষতি বা অভাব পূরণ হয় না। মতিচূর-রচয়িত্রী কেবল ক্রমাগত সমাজকে চাবকাইতেছেন, ইহাতে যে কোন সুফল ফলিবে- আমরা এমত আশা করিতে পারি না। তিনি যদি সংযতভাবে বিদ্বেষহীন ভাষায় নারীজাতির দু:খের কাহিনী বিবৃত করিতে পারেন তাহা হইলে সমাজে রক্ষণশীলতার বন্ধন আপনা আপনি শিথিল হইয়া আসিবে নতুবা যদৃচ্ছা চাবকাইয়া তিনি কিছুই করিতে পারিবেন না ইহা নি:সংশয়ে ও নিরুদ্বেগে বলা যায়। মতিচূরের পিপাসা ও গৃহ এই দুটি নিবন্ধই সর্বাপেক্ষা ভাল লাগিয়াছে অর্থ এই যে আমরা ইহা পড়িয়া হৃদয়ে কিছু সত্য, কিছু ধ্রুব বিষয়ের ধারণা করিতে পারিয়াছি। ‘গৃহে’ যে সামাজিক চিত্র অংকিত হইয়াছে তাহাতে মিথ্যার বার্ণিশ বিন্দু পরিমাণও নাই। ‘সুগৃহিনী ’সম্বন্ধে তারা বলেন, আমরা সুগৃহিনী চাই সত্য, কিন্ত আমরা এমন গৃহিনী চাইনা যাঁহারা কেবল সারাদিন ... নিয়া ব্যস্ত থাকিবেন। তাহা হইলে আমাদের ন্যায় মধ্যবিত্তের অবস্থার লোকদিগকে উপবাস করিয়াই থাকিতে হইবে।
এই গ্রন্থের ভাষা সরল ও প্রাঞ্জল এবং রচনাভঙ্গি অতি মনোরম। কোন পুরুষ লেখকের পক্ষে ও এইরুপ ভাষার গ্রন্থ রচনা করা শ্লাঘার বিষয়।
বলাই যায় রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের লেখনীতে তাঁর সময়, সমাজ, নারীর চিরায়ত বেদনা ও যাতনা যেভাবে প্রস্ফুটিত হয়েছে তা অনন্য। তবে এজন্য তাঁকে কম কাঠগড় পোড়াতে হয়নি। সমালোচনা, অসংখ্য বাধা বিপত্তিকে মাথায় নিয়ে তিনি লিখে গিয়েছেন। স্বয়ং নারীদের আঘাতে হয়েছেন জর্জরিত। যেমন ১৩১২ জ্যৈষ্ঠের ‘নবনূরে’ বেগম রোকেয়া লেখেন ‘ভ্রাতা-ভগ্নী’ শীর্ষক কথোপকথন। তার একস্থানে বলা হয়েছে: ‘কৃত্রিম অন্ত:পুর- বন্ধন মোচন হইলে সমাজে অবাধে স্ত্রীশিক্ষা প্রচলিত হইতে পারে। তখন এ শিক্ষার গতিরোধ করা অসম্ভব হইবে।’ এই বাদানুবাদ- প্রসংঙ্গে ১৩১২ ভাদ্রের ‘কোহিনূরে’ বিবি ফাতেমা মন্তব্য করেন: ‘গত আশ্বিন-কার্তিকের ’নবনূরে মি: আল-মুসাভী ও ইউসফজী সাহেবের লিখিত প্রবন্ধদ্বয়ের প্রতিবাদ করাই যে ভগিনী হোসেনের মুখ্য উদ্দেশ্য, তাহা ‘ভ্রাতা-ভগ্নী’ প্রবন্ধটি পাঠ করিলেই সহজে অনুমিত হয়। এখন জিজ্ঞাসাকরি, উহা দ্বারা আমাদের লাভ ইহবে কি?... ভগিনী হোসেনকে আমরা আমাদের সমাজের মুখপাত্র বলিয়া জানি। এরুপ অবস্থায় তাঁহার নিকট এ-প্রকার বাহুল্য কথা শুনিতে কখনই আমরা আশাকরি না।’
আমরা যদি বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের সমগ্র জীবনী পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে বিশ্লেষণ করি তবে দেখব, এ মহীয়সী ও জনকল্যাণ দরদী নারীর সমগ্র জীবনটাই ব্যয়িত হয়েছে নারীদের শিক্ষা, মানুষ রূপে তাদের নিজের অবস্থান তৈরী এবং জনহিতকর কাজে। সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল প্রতিষ্টার পাশাপাশি একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্টার স্বপ্নও যিনি দেখেছেন। সমাজের অসংঙ্গতি সমূহ, পর্দাপ্রথা, শিশুপালন, সুগৃহিনী হতে হলে করণীয়, গৃহে নারীর ভূমিকাসহ নানা মতামত ও মূল্যবান ভাষণ দেওয়ার পাশাপাশি কালকে অতিক্রম করেও যিনি সাহিত্য সাধনায় নিজেকে অনন্য স্থানে নিয়ে গিয়েছেন। এত পরিচয়ের পাশাপাশি প্রকাশিত বেশ কিছু পত্রাবলীতে ব্যক্তি রোকেয়াকে আমরা অন্যভাবে অনুভব করি তাঁর বোধ, ত্যাগ, তিতিক্ষা ও আশা- নিরাশার দোলাচলে। সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল, ৮৬- এ, লোয়ার সার্কুলার রোড ৫ই জানুয়ারি, ১৯২৬ এবং ৮৬-এ, লোয়ার সার্কুলার রোড, কলকাতা, ২৪-৩-৩০ কাছেরর মানুষ মরিয়ম রশীদকে লেখা তেমনই কিছু পত্রে আমরা লেখিকার মনোইচ্ছা, মনোসৌন্দর্য আমরা হৃদয়ের অন্ত:স্থল থেকে অনুভব করি।
খোদা তোমাদের মঙগল করুন। আলীগড়ে মাত্র তিনদিন ছিলাম। শহর দর্শনের সৌভাগ্য ঘটে নাই। তিনদিনই সভাসমিতি লইয়া দৌড়াদৌড়ি করিতে হইয়াছে।সেখানে কত মুসলমান গ্রাজুয়েট ও আন্ডার গ্রাজুয়েট মহিলা উপস্থিত ছিলেন। তাহাদের সম্মুখে কি আমি মুখ খুলিতে পারি? আমি শিক্ষিত মহিলাবৃন্দকে দেখিয়া পুণ্য অর্জন করিয়াছি। আমার চক্ষু কর্ণ ধন্য হইয়াছে। মুঐনুন নিসওয়াঁ (অর্থাত নারীকূলের সাহায্য) নামে সমিতি গঠনের জন্য জনৈক (সম্ভবত: অতি দরিদ্র) মহিলা হাতের আংটি খুলিয়া চাঁদার জন্য দিলেন। আলীগড়ের মেয়ে কলেজ শীঘ্রই দশ লক্ষ টাকা চাঁদা তুলিয়া নারী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করিবে। আর আমাদের বাংলাদেশ- আহারে! সে কথা না বলাই ভাল। আমি যদি কিছু টাকা পাইতাম (ধর, মাত্র দুই লক্ষ) তবে কিছু করিয়া দেখাইতে পারিতাম। কিন্তু খোদা আমাকে টাকা দেন নাই।
বলি, আমার বাংলাদেশ। যদি কিছু না-ই করিস, তবে দড়ি ও কলসীর সাহায্যে তোর অস্তিত্ব লোপ করিতে পারিস তো! সেজন্য ও আর বেশী ভাবনা নাই-ম্যালেরিয়া ও কালাজর সে ভার লইয়াছে। আহা, বুকটা ফাটিয়া যাইতে চায়।
স্নেহাস্পদা মরিয়ম,
তুমি অমন আদর করে আমাকে যেতে বলেছ। তোমার প্রত্যেকটি কথা স্নেহ মমতায় ভরা ছিল। আত্মীয়স্বজনের মমতা কি মধুর জিনিষ তা আমার মত আত্মীয়হারা না হওয়া পর্যন্ত কেউ বুঝতে পারে না। শুনেছি, লোকে বেহেশতে গিয়ে ও নাকি আত্মীয় স্বজনের বিরহে ব্যাকুল হবে।
কিন্ত বোন গ্রীষ্মাবকাশে আমার তো কোথাও যাবার যো নেই। এই যে স্কুল সংক্রান্ত রাশীকৃত ... এগুলো করবে কে? সুতরাং বেহেশতের নিমন্ত্রণ পেলে ও তো স্কুল ছেড়ে যেতে পারব না।
তোমার স্নেহের আপা, রোকেয়া
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম