বাংলা ভাষায় ছোটদের জন্য বাংলা সাহিত্যের জীবনী লিখেছিলেন দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর "সরল বাঙ্গালা সাহিত্য" গ্রন্থে। সেই ১৯২২ সালের পর আবার ছোটদের উদ্দেশ্য করে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস লিখেছেন বিখ্যাত ভাষাবিজ্ঞানী, সাহিত্যিক ও বাংলার শিক্ষক ড. হুমায়ুন আজাদ। সে বইয়ের নাম "লাল নীল দীপাবলি বা বাংলা সাহিত্যের জীবনী"। প্রথম প্রকাশ হয়েছিল ১৯৭৬ সালে। ২০১৭ সালে এর পঞ্চম পেপারব্যাক মুদ্রণ হয়েছে। খটমটে ও জটিল ভাষাবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ হুমায়ুন আজাদকে মানুষ চেনে তাঁর মুক্তচিন্তাসম্ভূত বুদ্ধিবৃত্তিক বক্তব্যসমূহের কারণে। ফলে তাঁর সাহিত্যিক পরিচয় অনেকটাই আড়ালে রয়ে গেছে। কঠোর যুক্তিপ্রবণতা এবং জটিল ভাষাতত্ত্বের বাইরে তিনি শিশুকিশোরদের জন্য যে বইগুলো রচনা করেছেন সেগুলো সত্যিই ঐশ্বর্যময়, সৌন্দর্যময়, আনন্দময়। প্রসঙ্গ চয়ন, ভাষা ব্যবহার এবং উপমা অলংকার তৈরিতে তিনি যে রচনাশৈলী প্রদর্শন করেছেন তা সত্যিই অভাবিত, বিস্ময়কর। তিনি কবিতাও লিখতেন, তাই কবিসুলভ উপমা ব্যবহারের স্বতস্ফুর্ততা তাঁর গদ্যেও লক্ষ্যনীয়।
হুমায়ুন আজাদের এই বই বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস প্রসঙ্গে। নিজের বই সম্পর্কে বলতে গিয়ে 'লাল নীল দীপাবলি' অধ্যায়ের শেষে বলেন -
লাল নীল দীপাবলি বাঙলা সাহিত্যের প্রধান সংবাদগুলো শোনাবে। সব সংবাদ শুনবে বড়ো হ'লে। তখন তোমাদের হাতে আসবে চর্যাপদ, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, বা বৈষ্ণব পদাবলি। হাতে পাবে বাঙলা সাহিত্যের ঐতিহাসিকদের লেখা বড়ো বড়ো বইগুলো। রবীন্দ্রনাথ তখন তোমার হাতে হাতে ফিরবে; তোমার জন্য কবিতা গল্প নাটক নিয়ে টেবিলে এসে হাজির হবেন কবি মধুসূদন দত্ত, ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ঔপন্যাসিক শরৎ-বিভূতি-মানিক-তারাশঙ্কর, কবি জীবনানন্দ-সুধীন্দ্রনাথ-বুদ্ধদেব, এবং আরো অনেকে। এবং আসবেন একালের লেখকেরা। তোমার চতুর্দিকে প্রদীপ, মাঝখানে তুমি ব'সে আছো। রাজা। পৃষ্ঠা- ৮
স্বপ্নের মতো এরকম কাঙ্ক্ষিত দৃশ্যকল্প বয়স নির্বিশেষে সকলেরই ভাল লাগবে। হুমায়ুন আজাদের রচনাশৈলীর স্বাতন্ত্র্য এখানেই।
সূচিপত্র দেখলে বইয়ের পরিধি সম্পর্কে ধারণা আরও বিস্তৃত হবে।
সূচিপত্র
- লাল নীল দীপাবলি
- বাঙালি বাঙলা বাঙলাদেশ
- বাঙলা সাহিত্যের তিন যুগ
- প্রথম প্রদীপ: চর্যাপদ
- অন্ধকারে দেড় শো বছর
- প্রদীপ জ্বললো আবার: মঙ্গলকাব্য
- চণ্ডীমঙ্গলের সোনালি গল্প
- মনসামঙ্গলের নীল দুঃখ
- কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী
- রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র
- উজ্জ্বলতম আলোঃ বৈষ্ণব পদাবলি
- বিদ্যাপতি
- চণ্ডীদাস
- চৈতন্য ও বৈষ্ণবজীবনী
- দেবতার মতো দুজন এবং কয়েকজন অনুবাদক
- ভিন্ন প্রদীপ: মুসলমান কবিরা
- আলাওল
- লোকসাহিত্যঃ বুকের বাঁশরি
- দ্বিতীয় অন্ধকার
- অভিনব আলোর ঝলক
- গদ্যঃ নতুন সম্রাট
- গদ্যের জনক ও প্রধান পুরুষেরা
- কবিতাঃ অন্তর হতে আহরি বচন
- উপন্যাসঃ মানুষের মহাকাব্য
- নাটকঃ জীবনের দ্বন্দ্ব
- রবীন্দ্রনাথঃ প্রতিদিনের সূর্য
- বিশশতকের আলোঃ আধুনিকতা
মাত্র সাতাশটি অধ্যায়ে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস জানিয়ে দেয়া সহজ কাজ নয়। হুমায়ুন আজাদ সেই কঠিন কাজটিই করেছেন। শিশু কিশোর তথা অল্প বয়সী অথবা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে আগ্রহী নতুন পাঠক প্রত্যেকে এই বই থেকে উপকৃত হবে।
শুরু করেছেন বাংলা ভাষার প্রাচীনতম বই "চর্যাপদ" থেকে। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে আমাদের জন্য সাহিত্যমালা হাতে নিয়ে থাকা প্রত্যেককে স্মরণ করেন তিনি। বাঙালী জনগোষ্ঠীর পরিচিতি যারা তৈরি করে দিয়েছেন, তাদের আমরা অবোধ জনগণ ভুলে যেতে পারি, কিন্তু হুমায়ুন আজাদ ভোলেন নি। স্বল্পকথায় সকলকে যথাযোগ্য সম্মান দিয়েছেন। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে নমুনা কবিতার উল্লেখ করেছেন। সচেতন শব্দ ব্যবহারে হুমায়ুন আজাদ সিদ্ধহস্ত। ফলে অল্পবয়সীদের জন্য রচিত বইয়ে তিনি অন্য বইগুলোর মতো সাবলীল, গতিশীল, প্রফুল্ল এবং উৎসাহী। অর্থাৎ তাঁর লেখা মনোহারী, সুখপাঠ্য। বারবার পড়তে ইচ্ছে করে। শুধু সাহিত্যগত নয়, তথ্যগত দিক থেকেও একথা সত্য।
ছোটদের জন্য লেখা বই। তবুও প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় নৃতত্ত্বের আলোচনা করেছেন 'বাঙালি বাঙলা বাঙলাদেশ' নামক অধ্যায়ে। আমাদের মুখাবয়ব, রং, উচ্চতা, চোখের-চুলের রঙ ইত্যাদির ভিত্তিতে আমাদের সঠিক পরিচয় কী এবং তার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ অঞ্চলের মানুষের পরিচয় বিভ্রাটের আসল কারণ – এরকম বিবিধ রাজনৈতিক প্রসঙ্গ তিনি এই অংশে বিশ্লেষণ করেছেন।
“পূর্বলেখ" শীর্ষক মুখবন্ধে তিনি এই বই লেখার প্রেক্ষাপট খোলাসা করেন। তিনি জানান-
যে-রকম বোধ আমাকে কবিতা লিখতে উৎসাহ দেয়, সে-রকম বোধে অনুপ্রাণিত হয়েই, দু-দশক আগে, লিখেছিলাম লাল নীল দীপাবলি। একটি দীর্ঘ কবিতার মতোই কয়েক দিনের মধ্যে লাল নীল দীপাবলি রচিত হয়ে উঠেছিলো। আজ আর আমার পক্ষে এ-বই লেখা সম্ভব নয়। এ-বইয়ের পাঠক হিসেবে আমার কল্পনায় ছিলো স্বপ্নকাতর সে-কিশোরকিশোরীরা তরুণতরুণীরা, যারা আছে কোমল কৈশোরের শেষ রেখায়, বা যারা কৈশোর পেরিয়ে ঢুকেছে এক বিস্ময়কর আলোতে, যাদের সৌরলোক ভ'রে গেছে সাহিত্যের স্বর্ণশস্যে। একদা আমি সবুজ বাল্যকাল পেরিয়ে সাহিত্যের মধ্যে মহাজগৎকে দেখেছিলাম, লাল নীল দীপাবলি তাদেরই জন্যে যারা আজ একদা আমার মতো। তবে তারা কি আজ আছে? শুনতে পাই সময় তাদেরও নষ্ট করেছে, তারা আর সাহিত্যের স্বর্ণশস্যে বুক ভরিয়ে তোলে না। অন্য নানা সোনায় তাদের বুক পরিপূর্ণ। বাঙলা সাহিত্যের দিকে তাকালে এক সময় আমার চোখে শুধু লাল নীল প্রদীপমালার রূপ ভেসে উঠতো, দেখতে পেতাম হাজার বছর ধ'রে জ্বেলে দেয়া ঝাড়লণ্ঠনের মালা। দীপ জ্বেলেছেন কাহ্নপাদ, দীপ জ্বেলেছেন বড়ু চণ্ডীদাস; হাজার বছর ধ'রে দীপ জ্বেলেছেন মুকুন্দরাম, চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি, বিদ্যাসাগর, মধুসূদন, বিহারীলাল, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, ও আরো অনেকে। লাল নীল দীপাবলিতে আমি স্বপ্ননীল কিশোরকিশোরী তরুণতরুণীদের চোখের সামনে বাঙলা সাহিত্যের হাজার বছরকে আলোকমালার মতো জ্বেলে দিতে চেয়েছিলাম।
তাঁর ইচ্ছে বিফল হয় নি। তা সে বইয়ের পুনঃমুদ্রণ সংখ্যা দেখেই বোঝা যায়। এই বই অল্প বয়সীদের যেমন তৃপ্ত করেছে, তেমনি করেছে বড়োদেরও। বাংলা সাহিত্যের হাজার বছরের ইতিহাস অল্পকথায়, অল্পায়াসে জানা সম্ভব এই বই পড়ে। আর এরকম বই বাংলা ভাষাতেও আর একটাও নেই। অর্থাৎ ছোটদের জন্য বা সংক্ষেপে সহজ ভাষায় বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস জানতে এই বইয়ের বিকল্প আর নেই।
# এই বইয়ে ‘বাংলা’ শব্দটির বানান সর্বত্র ‘বাঙলা’ লেখা হয়েছে।
≈~≈~≈~≈~≈~≈~≈
লাল নীল দীপাবলি বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী
হুমায়ুন আজাদ
প্রচ্ছদ: সব্যসাচী মিস্ত্রী
প্রকাশক: আগামী প্রকাশনী, ঢাকা।
প্রথম প্রকাশ: ১৯৭৬
পঞ্চম পেপারব্যাক মুদ্রণ: ২০১৭
পৃষ্ঠাসংখ্যা: ১০৪
মূল্য: ১০০ টাকা
ISBN: 978-984-04-1995-1
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম