কয়েক বছর আগে আবার অনুপ্রাণিত হয়ে আমার আরেক প্রিয় সম্পর্কে লিখি এ-বইটি। এ-প্রিয়র নাম বাঙলা ভাষা। আমার ভেতরে এর নাম জেগে ওঠে "কতো নদী সরোবর বা বাঙলা ভাষার জীবনী"। এটিও প্রথাগত রীতি ও ভাষায় ও প্রাজ্ঞ পাঠকদের জন্যে লিখি নি। লিখেছি কিশোরতরুণদের জন্যে, যাদের কাছে বাস্তবও অনেকটা স্বপ্নের মতো। জ্ঞান যাদের কাছে এক রকম আবেগ ও সৌন্দর্য।এতটা ভালবাসা মাখিয়ে তিনি যে বই লিখেছেন, তার সূচিপত্র একবার দেখে নেয়া যাক।
সূচিপত্র
- চাতকচাতকীর মতো
- জন্মকথা
- আদি-মধ্য-আধুনিকঃ বাঙলার জীবনের তিন কাল
- গঙ্গা জউনা মাঝেঁ রে বহই নাঈ
- কালিন্দীর কুলে বাঁশি বাজে
- হাজার বছর ধ'রে
- ধ্বনিবদলের কথা
- ধ্বনিপরিবর্তনঃ শব্দের রূপবদল
- আমি তুমি সে
- জলেতে উঠিলী রাহী
- বহুবচন
- আইসসি যাসি করসি
- সোনালি রুপোলি শিকি
- বাঙলা শব্দ
- ভিন্ন ভাষার শব্দ
- বাঙলা ভাষার ভূগোল
- আ কালো অ শাদা ই লাল
- গদ্যের কথা
- মান বাঙলা ভাষাঃ সাধু ও চলতি
- অভিধানের কথা
- ব্যাকরণের কথা
- যে-সব বঙ্গেত জন্মি
- বাঙলা ভাষাঃ তোমার মুখের দিকে
ভাষাতত্ত্বের জটিল বিষয়গুলো নিয়ে এরকম করে শিশু কিশোর নবীন পাঠক উপযোগী করে কেউ কখনও বাংলা ভাষায় কোন বই রচনা করেছেন কি না জানা নেই। হুমায়ুন আজাদ এক্ষেত্রে অগ্রপথিক। ভাষার জন্ম ও ইতিহাস নিয়ে মানুষ বিভিন্ন কুসংস্কার ও অপবিশ্বাসের শিকার হয়। শিশু কিশোরদের এরকম অপধারণার আগ্রাসন থেকে রক্ষা করা দরকার। এর মধ্যে বাংলা ভাষার ইতিহাস সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক ও যুক্তি ও তথ্যনির্ভর আলোচনা অল্প বয়সীদের হাতে তুলে দেয়ার জন্য এই বইয়ের বিকল্প নেই। বাংলা ভাষার ইতিহাস সম্পর্কে বয়স্ক কৌতুহলী পাঠকও এই বই পাঠে জানতে পারবেন মৌলিক তথ্যগুলো।
বাংলা ভাষার প্রতি লেখকের আবেগ ও আগ্রহের কোন শেষ নেই। তিনি পড়াশোনা ও কর্মজীবন বেছে নিয়েছেন বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে। লেখালেখি করেছেন বাংলার ভাষা, ইতিহাস, সমাজ, তথা মানব-মানবী ও অন্য বিবিধ অনুষঙ্গ সমূহকে নিয়ে। যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন তাঁর হৃদয়ে বাংলা ভাষার জন্য অপার ভালবাসা বারবার জেগে উঠত। তিনি 'চাতকচাতকীর মতো' অধ্যায়ে হৃদয়ের দ্বার খুলে দিয়ে উচ্চারণ করেন-
বাঙলা আমার মাতৃভাষা। আমাদের মাতৃভাষা। তার রূপ আর শোভায় আর সৌন্দর্যে আমি মুগ্ধ। পৃথিবীতে আরো বহু ভাষা আছে। তাদের কোনোটির সৌন্দর্যে অন্ধ হয়ে যায় চোখ। কোনোটির ঐশ্বর্যের কাছে নুয়ে আসে মাথা। কোনোটির দর্পের কাছে হার মানতে হয় মুখোমুখি হওয়ার সাথেসাথে। তবুও আমার কাছে বাঙলার মতো আর কোনো ভাষা নেই। বাঙলা আমার মাতৃভাষা। আমার ভাষা। আমার আনন্দ এ-ভাষায় নেচে ওঠে ময়ুরের মতো। আমার সুখ ভোরের রৌদ্র বিকেলের ছায়া আর সন্ধ্যার আভার মতো বিচ্ছুরিত হয় বাঙলা ভাষায়। আমার বেদনা আমার দুঃখ থরো থরো ক'রে ওঠে বাঙলা ভাষায়। আর কোনো ভাষা আমার দুঃখে কাতর হয় না। আর কোনো ভাষা পুলকিত শিহরিত মর্মরিত আকুল ব্যাকুল চঞ্চল অধীর হয় না আমার সুখে আমার আনন্দে। পৃষ্ঠা-১০প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার একটি অঞ্চলভিত্তিক রূপ বাংলা ভাষা ইতিহাসের ধারাবাহিক পথ ধরে চর্যাপদ, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, চণ্ডিমঙ্গল প্রভৃতি মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব পদাবলী, পদ্মাবতী-ইউসুফ জোলেখা ইত্যাদি রোমান্স সাহিত্য, গীতিকবিতার শরীর বেয়ে আধুনিক রূপ লাভ করেছে। এই হাজার বৎসরব্যাপী যাত্রাপথে বাংলা ভাষা গ্রহণ, বর্জন, পরিমার্জন করেছে অনেক অনেক শব্দ, বাক্য ও ব্যাকরণিক, ভৌগলিক নানাবিধ পরিবর্তন। ক্রমাগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষা এসে পৌঁছেছে বর্তমান কালে। এই সুদীর্ঘ যাত্রাপথের প্রত্যেকটি প্রধান বাঁক হুমায়ুন আজাদ আলোচনা করেছেন। প্রয়োজনীয় উদাহরণ আলোচনাগুলোকে করেছে সহজবোধ্য ও আকর্ষণীয়। প্রসঙ্গক্রমে বিদেশী প্রসঙ্গ আগ্রহের সাথে উপস্থাপন করেছেন। যেমনঃ বাংলা বর্ণগুলো অর্থাৎ 'অ' ‘আ' প্রভৃতি কোন রঙ প্রকাশ করে না। অথচ বর্ণ শব্দটিই রঙজ্ঞাপক। ফরাশি কবি 'জাঁ আর্তুর ব়্যাঁবো' স্বরবর্ণের রঙ নিয়ে কবিতা লিখেছিলেন (গ্রন্থগত ওয়েবসাইটে তাঁর জীবনীগ্রন্থ সম্পর্কে পড়ুন আলোচনাঃ ‘মলয় রায়চৌধুরী’র ভাষ্যে “জাঁ আর্তুর ব়্যাবো”)। হুমাযুন আজাদ বাংলা লিপির ইতিহাস লিখতে গিয়ে ভূমিকায় স্মরণ করেন এই কিশোর প্রতিবাদী কবির রূপময় বর্ণিল কল্পনাকে।
এরকম ইতিহাস থেকে, বিশ্বের অন্যান্য ভাষাভাষী অঞ্চল থেকে প্রয়োজনীয় উপাদান দিয়ে লেখক তাঁর আলোচনাকে আরও বেশি তথ্যসমৃদ্ধ করে তুলেছেন। বইয়ের শেষে পাঁচ পৃষ্ঠাব্যাপী বেশ কিছু ছবি পুনঃপ্রকাশ করেছেন। এর মধ্যে ন্যাথানিয়েল হ্যালহেড, উইলিয়ম কেরি, প্রথম মুদ্রিত দু'একটা বইয়ের প্রথম পাতা, মধ্যযুগের পুঁথি ও হ্যালহেড মুদ্রিত ব্যাকরণের পাতা, ভাষা সংস্কারক বাঙালী পণ্ডিতগণ প্রমুখের ছবি বাংলা ভাষার বিস্তারিত বিবর্তন জানতে পাঠককে কৌতুহলী করে তুলবে। উৎসাহী পাঠক এই বই পড়তে গিয়ে আরও অনেকগুলো বই পড়ার প্রেরণা অনুভব করবেন।
‘হুমায়ুন আজাদ’ এর “কতো নদী সরোবর বা বাঙলা ভাষার জীবনী” বইটি বেশ জনপ্রিয়। বাংলা ভাষা চিনতে, পড়তে ও বুঝতে গিয়ে প্রথম বই হিসেবে এই বইকে হাতে নেয়া যেতে পারে। বিশ্বের অন্যান্য ভাষার মত বাংলা ভাষারও একটি সমৃদ্ধ রাজনৈতিক, সাহিত্যিক ও ভাষাতাত্ত্বিক ইতিহাস রয়েছে। এই সবগুলো বিষয়কে সহজ সাবলীল ঐশ্বর্যময় বর্ণিল উপমামুখর স্বপ্নের মতো ভাষায় উপস্থাপন করা হয়েছে এই বইতে। অতএব শিক্ষিত আত্মসচেতন ইতিহাসপ্রেমী বাঙালি এই বই পড়বেন না তা কি হয়?
* বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস সহজবোধ্য ভাষায় জানতে পড়ুন ‘হুমায়ুন আজাদ’ রচিত “লাল নীল দীপাবলি বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী”
* এই বইয়ে 'বাংলা' শব্দটির বানান 'বাঙলা' লেখা হয়েছে।
-−-−-−-−-−-−-
কতো নদী সরোবর বা বাঙলা ভাষার জীবনী
হুমায়ুন আজাদ
প্রচ্ছদঃ সমর মজুমদার
প্রকাশক: আগামী প্রকাশনী, ঢাকা
প্রথম প্রকাশঃ ১৯৮৭
দ্বিতীয় সংস্করণ: নবম মুদ্রণঃ ২০১৬
পৃষ্ঠাসংখ্যাঃ ১০৬+৫ (চিত্র সম্বলিত)
মূল্যঃ ১৫০ টাকা
ISBN: 978-984-04-1421-5
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম