আমরা এর আগে ‘বিপ্রদাশ বড়ুয়া’ রচিত “পাখির ভূবন” বইয়ের কথা জেনেছিলাম। পাখির উপরে অনেক রকমের তথ্য এবং পাখি চেনার বিভিন্ন পদ্ধতি জেনেছিলাম সেই বই থেকে। আজ জানবো রহীম শাহ লিখিত "রঙিন ডানার পাখি" নামের বই সম্পর্কে। পাখি নিয়ে বেশ সুলিখিত বই এটাও। প্রকৃতির অন্যতম সদস্য পাখি সম্পর্কে আমাদের প্রবল আগ্রহ। পাখি সম্পর্কে সম্ভাব্য সব তথ্য আমাদের জানা চাই। তবেই না দিনে-রাতে বাইরে বের হলে যে আকর্ষণীয় প্রাণীটির মুখোমুখি হই, তাকে ভালভাবে চিনতে পারব, আরও বেশ ভালবাসতে পারব। রহীম শাহ তার বইতে যত বেশি সম্ভব তথ্য দেয়ার চেষ্টা যে করেছেন, তা বেশ বোঝা যায়। তিনি নিজে পাখিপ্রেমিক; আরেক বিখ্যাত প্রকৃতিপ্রেমিক দ্বিজেন শর্মা তাকে 'খ্যাতিমান বিহঙ্গবিদ' বলেছেন; তিনি বোঝেন নবীন পাখিপ্রেমিকদের মন। সেভাবেই বইটিকে উপস্থাপন করেছেন। বইয়ের সাধারণ রূপ যে খাড়াখাড়ি, সেটা তিনি গ্রহণ করেন নি। বইকে করেছেন পাশাপাশি অবয়বের। পাঠককে লম্বা আকারের পৃষ্ঠা ওল্টাতে হবে। তবে সে পরিশ্রম বৃথা যাবে না। কারণ প্রত্যেক পাতায় রয়েছে পাখিদের একাধিক আকর্ষণীয় ছবি। পাখির বিভিন্ন দিকের, বা ভঙ্গির বা বয়সের একাধিক ছবি প্রত্যেক পাতায় রয়েছে। প্রত্যেকটি পাতায় রয়েছে একটি করে পাখির বর্ণনা। একাধিক পাখির বিবরণ রয়েছে শুধু একটি পাতায়।
মোট আটচল্লিশ পৃষ্ঠার স্বল্প পরিসরে তিনি চৌত্রিশটি বাংলাদেশি পাখির পরিচিতি দিয়েছেন। প্রত্যেকটি পৃষ্ঠা চকচকে আর্ট পেপারের। ফলে চার রঙে ছাপানো ছবিগুলো হয়েছে অনেক বেশি স্পষ্ট ও জীবন্ত। এটা ছবি তোলারও কৃতিত্ব বটে। এক পৃষ্ঠায় একটি পাখি- এভাবে পুরো বইটি সাজানো। ওই এক পৃষ্ঠাতেই রয়েছে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা ও দুইটি করে ছবি। দুইটি ভিন্ন ভঙ্গির, পাখির সঙ্গী বা দল, বাসা, ছানা, ডিম, উড়ন্ত বা আঁকাবাঁকা বিভিন্ন ভঙ্গিমার আলাদা ছবি। ফলে এক পৃষ্ঠা থেকেই একটি পাখি সম্পর্কে অনেকগুলো তথ্য পাওয়া যায়।
লেখক পাখিদের উপর তথ্যবহুল ও আকর্ষণীয় এই বইয়ের শুরু করেছেন "শুরুর কথা" দিয়ে। একে একে বলে যান "পাখিদের বর্ণের খেলা", “অতিথি পাখির মায়াবি ডানা" ও "পাখির সঙ্গে বন্ধুত্ব"- এসব নিয়ে যৌক্তিক ও তথ্যনির্ভর আলোচনা।
"শুরুর কথা" প্রবন্ধে পাখিদের সম্পর্কে যা কিছু জানার তা সংক্ষেপে, যথাযথ শব্দ ব্যবহার করে জানিয়ে দেন। এই আলোচনাটি যে পৃষ্ঠায় তার ডানপাশের অর্ধেক জুড়ে রয়েছে মাছরাঙ্গা পাখির মাছ ধরার মুহুর্তগুলোর ধারাবাহিক ছবি। মোট ছয়টি ছবিতে মাছরাঙ্গার মাছ ধরার বিষয়টি যতটা নান্দনিক ভাবে এসেছে, তা ভাষা দিয়ে বোঝানো সম্ভব নয়। পাশের ছবিতে দেখলেই বরং বিষয়টির যথার্থ অনুধাবন হবে। আরেক পাশের পৃষ্ঠায় কোন একটি সিনেমা থেকে নেয়া দুটি টেরোডাকটিলের উড়ে যাওয়ার ছবি এতটাই স্পষ্ট যে অনেকে সত্যি ভেবে বিভ্রান্ত হতে পারে।
লেখক তাঁর "শুরুর কথা"র শুরুর দিকে বলেন-
বাংলাদেশের প্রকৃতিকে স্নিগ্ধ সুষমাময় করে রেখেছে পাখিরা। আমাদের দেশে প্রায় ৫২৫ প্রজাতির পাখি আছে। পৃ-৭
লেখক এই অংশে নানারকম পাখির বর্ণনা দেন। জলজ, মাংসাশী, শিকারী, গায়ক পাখিসহ নানা প্রকারের পাখির কথা বলেন।
মানুষ পাখিদের ভালোবাসে শুরু রংয়ের জন্য নয়, গানের জন্যও। গানের পাখিদের মধ্যে আছে-দোয়েল, টুনটুনি, ফটিকজণ, ঘুঘু, মৌটুসি, শামা, দামা, বুলবুলি, বেনেবউ, সোনাবউ, দুধরাজ, লেজনাচুনে, ফুটফুটি, নীল ফুটফুটি, বাঁশপাতি, খঞ্জনা ইত্যাদি।
কোকিলের ডাক শুরু আমরা বসন্তের আগমনী বার্তা শুনি। কিন্তু কোকিলকে গানের পাখি বলা যায় না। কারণ, কোকিল তার স্বর পরিবর্তন করতে পারে না। এ পর্যায়ে কাককে গানের পাখির পর্যায়ে ফেলা যায়। পক্ষীবিজ্ঞানীরা কাকের এ পর্যন্ত ১১ রকম গলার স্বর আবিষ্কার করেছেন। পৃ-৭
“পাখিদের বর্ণের খেলা" নিবন্ধে প্রকৃতিকে রঙিন করে রাখা পাখিদের শরীর সাজিয়ে দেয়া রঙের কথা বলা হয়েছে। মাত্র এক পৃষ্ঠার আলোচনায় লেখক সহজ করে পাখিদের শরীরে বিভিন্ন রং থাকার কার্যকারণ বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন
ঘন সবুজ পাতার মধ্যে যেসব পাখি বাস করে তাদের গায়ের রং হয় সাধারণত টকটকে লাল, উজ্জ্বল নীল, হলুদ বা সবুজ। প্রখর রোদের আলোয় শিকারি পাখিরা যখন এদের দেখে, তখন চোখ ধাঁধিয়ে যায় শিকারির। এসব উজ্জ্বল রংয়ের পাখিদের উপর রোদের আলো পড়লে ঝলমল করে ওঠে চোখ। ফলে ভালোভাবে শিকারকে দেখা মুশকিল হয়ে পড়ে। একে বলা যেতে পারে 'আত্মরক্ষাকারী বর্ণবৈচিত্র্য'। এসব রঙিন পাখিদের মধ্যে আছে – নানা রকম বসন্তবউরি, ফটিকজল, মৌটুসি, ফুটফুটি, বেনেবউ, নীল ফুটফুটি, আলতাপরি, সহেলি, কাঠঠোকরা, ফুলটুসি, রাজবুলবুল, টুনটুনি, চশমাপাখি, হরবোলা ইত্যাদি। পৃষ্ঠা -১০
“অতিথি পাখির মায়াবি ডানা" শীর্ষক অধ্যায়ে লেখক অতিথি পাখিদের প্রতি আমাদের সচেতনতা বৃদ্ধির কথা বলেছেন। অতিথি পাখি কি বা কাকে বলে? কোন প্রজাতির পাখি গুলো বাংলাদেশে অতিথি পাখি হয়ে আসে? কোন সময়ে, কোন এলাকায় তারা ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে বেড়াতে আসে অথবা সাময়িকভাবে থাকতে আসে, লেখক এধরণের অনেক প্রশ্নের উত্তর খুব স্বল্পকথায় তথ্যসমৃদ্ধ ভাবে পরিষ্কার করে ব্যাখ্যা করেছেন। কয়েক পৃষ্ঠাব্যাপী আলোচনায় তিনি অনেকগুলো প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন। প্রতিটি পৃষ্ঠায় রয়েছে অতিথি পাখিদের নান্দনিক ছবি। পাখিদের বিভিন্ন ভঙ্গিমার ছবিগুলো দেখে মন নিমেষে ভাল হয়ে যায়। অথচ আমাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা অতিথি পাখিদের দেখলেই তাদের খেয়ে ফেলতে চান।
“পাখির সঙ্গে বন্ধুত্ব" অধ্যায়ে পাখি দেখার প্রয়োজনীয়তা ও পদ্ধতির কথা বলেন। তিনি খুব আন্তরিকতা নিয়ে বলেন-
পাখির প্রতি মানুষের আকর্ষণ হাজার হাজার বছর আগের। প্রাচীন মিশরের রহস্যময় পিরামিডের দেয়ালে দেয়ালে পাখি, মোগল চিত্রকলার বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে পাখি, ‘পঞ্চতন্ত্র' এ রয়েছে অসংখ্য পাখির বর্ণনা, যে বইটি লেখা হয়েছে যিশু খ্রিস্টের জন্মের দুশো বছর আগে। মানুষের প্রত্যেকটি সৃজনশীল সৃষ্টিই উঠে এসেছে শখ থেকে। স্বাভাবিকভাবেই মানুষের পাখি দেখার শখ ধীরে ধীরে পাখি পর্যবেক্ষণে রূপ নেয়। আর এই পাখি পর্যবেক্ষণের প্রথম ধাপ হল যে কোনো অঞ্চলের সাধারণ পাখিকে ঠিকমতো চিনতে পারা। অক্ষর পরিচয় ছাড়া যেমন জ্ঞানার্জন সম্ভব নয়, তেমনি পাখি চিনতে না পারলে পাখি দেখার শখ দৃষ্টিনন্দনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যাবে। পৃষ্ঠা- ১৪
লেখক এই অংশে পাখি দেখা শিখতে সহায়ক বেশ কয়েকটি বইয়ের নাম উচ্চারণ করেন। বইগুলো হল হুইসলারের 'পপুলার হ্যান্ডসবুক অফ ইন্ডিয়ান বার্ডস', সালিম আলির 'দ্যা বুক অফ ইন্ডিয়ান বার্ডস', অজয় হোমের 'বাংলার পাখি' ও 'চেনা-অচেনা পাখি'। পাখিদের চেনার জন্য রহীম শাহ'র টিপস ও পরামর্শগুলোও কম মূল্যবান নয়। মনে রাখতে হবে, তিনি নতুন পাখিপ্রেমীদের কথা মাথায় রেখে এই বই সাজিয়েছেন। ফলে এই বই হাতে থাকলেও অনেক পাখি চেনা সহজ হয়ে যাবে।
বাংলাদেশে পাখি প্রেমী মানুষের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। পাখি চিনতে আগ্রহী মানুষ দিন দিন বাড়ছে। ফলে পাখি কীভাবে দেখতে হয়, কিভাবে পাখির পরিচয় বের করতে হয়, কোন বই নিয়ে পাখি দেখতে যাওয়া উচিত- কোন বইতে পাখিদের পরিচয়, বৈশিষ্ট্য সুন্দরভাবে তথ্য সহকারে দেয়া হয়েছে -- অনেকে এসব তথ্য জানতে চায়। আসলে সহজবোধ্য পাখি বিষয়ক বাংলা বই খুব একটা নেই। যে কয়েকটি রয়েছে, তার মধ্যে রহীম শাহ লিখিত রঙিন ডানার পাখি বইটি অল্প সময়ে পাখিপ্রেমি অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছে। তাঁর ভাষা সহজ। ছোট ছোট বাক্যে উপস্থাপিত বক্তব্য সহজে বোধগম্য হয়। সমগ্র বইয়ের কোথাও বাক্যরচনায় স্বাভাবিক গতির পতন ঘটেনি।
বইয়ের প্রচ্ছদ করেছেন চঞ্চল হোসেন। তিনি প্রচ্ছদে বাংলাদেশের বিখ্যাত দুধরাজ পাখির ছবি ব্যবহার করেছেন। দুঃখজনক যে অনিন্দ্যসুন্দর এই পাখিটি বর্তমানে বিলুপ্তপ্রায়। তিন বৎসর বয়সী দীর্ঘ লেজ সজ্জিত পুরুষ ও তামাটে রঙে রাঙানো নারী দুধরাজ পাখির ছবিদুটো বইটিকে আকর্ষণীয় করেছে। ভিতরে বইয়ের শিরোনামপৃষ্ঠায় ব্যানারের মত করে ব্যবহার করা হয়েছে ডিমে তা দেয়ারত পুরুষ পাখির ছবি। দীর্ঘ সুবঙ্কিম লেজটির সৌন্দর্য যেন সত্যিই অপার্থিব।
ডিমে তা দিচ্ছে লম্বা সাদা বাঁকানো লেজযুক্ত পুরুষ দুধরাজ পাখি |
পাশাপাশি ভাবে সাজানো বইটি পাখি দেখার সময় হ্যান্ডবুকের মত করে ব্যবহার করা যাবে। ছাপার মান বেশ ভাল। চার রঙা ছবিতে পাখিগুলো স্পষ্ট ও জীবন্ত হয়ে উঠেছে। প্রত্যেকটি পৃষ্ঠা চকচকে অফসেট কাগজে ছাপানো। ফলে দাম বেশি হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। কাগজগুলো বেশ শক্ত হওয়ায় সহজে ছিঁড়ে যাবে না। শক্ত মলাটের উপরে আবার একটি মোটা ল্যামিনেট করা অফসেট কাগজের প্রচ্ছদ ছাপানো জ্যাকেট রয়েছে। অর্থাৎ মাঠে গিয়ে পাখি দেখতে দেখতে বইয়ের স্থায়ীত্ব সহজে কমবে না। প্রত্যাশা করি বাংলাদেশের পাখিদের চিনতে এই বই নবীন প্রবীণ সব বয়সের পাখিপ্রেমীদের মধ্যে আদরণীয় হবে।
* ছবি ব্যবহারে কোন নিষেধাজ্ঞা না থাকায় বই থেকে একাধিক ছবি প্রকাশ করা হল।
-----------------------------------
রঙিন ডানার পাখি
রহীম শাহ
প্রচ্ছদঃ চঞ্চল হোসেন
প্রকাশকঃ আদিগন্ত প্রকাশন, ঢাকা।
প্রকাশকালঃ ২০১৫
পৃষ্ঠাঃ
মূল্যঃ ২৫০ টাকা
ISBN: 984-70325-0252-1
1 মন্তব্যসমূহ
লম্বা সাদা লেজগজিত পাখির সৈন্দর্য বড়েই মনোরম!
উত্তরমুছুনমার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম