ইমতিয়াজ আহমেদ এর দৃষ্টিতে কবি মাহবুব আজীজের কাব্যগ্রন্থ - ‘নিঃসঙ্গতার মতো একা’ : জীবনের মুগ্ধ নার্সিসাস!

ইমতিয়াজ আহমেদ এর দৃষ্টিতে কবি মাহবুব আজীজের কাব্যগ্রন্থ - ‘নিঃসঙ্গতার মতো একা’ : জীবনের মুগ্ধ নার্সিসাস!
বিশ শতকের পুরোটা সময় ধরে বাঙালী তার শিল্প সাহিত্যে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে কবিতায়। বিষন্নতা, নৈঃশব্দ এবং দীর্ঘশ্বাসের কাব্য যা, শূন্য দশকে আসা অনেক কবিদের কবিতায় জীবনানন্দের প্রভাব বিদ্যমান ছিলো নিঃসন্দেহে। আর ঠিক সেই চর্চার সুযোগে আধুনিক কবিরা একটি নিজস্ব ঘরানায়  কবিতা লিখতেও সক্ষমতা অর্জন করে নেয় এতদিনে। অপার বিস্তৃত জীবনের বহু মাত্রায় জীবন রসায়নকে গড়ে তুলেন অভূত অনুপম। একসময় মানব অস্তিত্বের চিত্রকল্পকে কবিতায় রূপ দেয়াই বড় কনফ্লিকটিং হয়ে দাঁড়ায় শূন্য দশকের কবিদের কবিতা চর্চায়, যাতনার রোমান্টিক আর্তনাদে সংক্রমিত হতে থাকে কবিতার আদ্যপ্রান্ত তখন ক্লেদ আর কিন্নতা এক ঐশরীক সুখ দেয় কবিকে, পরিশেষে নিঃসঙ্গতাই আধুনিক কবিদের কবিতায় বাহু মেলে দেয় সর্বোপরি যা তারা চাষাবাদ করে অনন্তকাল জীবনের মুগ্ধ নার্সিসাসে। শূন্য দশকের অন্যতম কবিতা চাষী কবি মাহবুব আজীজ লেখেন তার কাব্যগ্রন্থ ‘নিসঙ্গতার মতো একা’
খুব  মন খারাপ, যেন একটা জলভর্তি গ্লাস
টলমল করে কাঁপে। তোমার দূরগত হাসির মতো-
দূর থেকে ভেসে আসে। শুধুই শোনা যায়
অবিরত। বাড়ে, বাড়তেই থাকে, বুকের ক্ষত ।
                                     (জলের গ্লাস )
কবি মাহবুব আজীজ তার কবিতায় আত্মকেন্দ্রিকতায় ব্যক্তিসত্তাকে সংক্রমিত করেছেন প্রবলভাবে যার ফলে আরো তুখোর হয়ে উঠেছে তার স্মৃতির বিবাদ। অনুভব আর অনুভূতির বেদনার ঘন নিশ্বাসে দুলে ওঠে তার নিসর্গ, হৃদয়ের সবটুকু অহং নিয়ে এক নিবিড় শব্দশূন্যতার কোটরে তার জন্ম, আর সেই থেকেই এক অমিত শক্তিময় অজানা-র পিছুটান থেকেও মুক্তি মেলে তার; যে কিনা পেগাসাসের মত পক্ষীরাজ ঘোড়ায় বায়ুতে ভেসে বেড়ান মর্তের আকাশে। আধুনিক মানুষের ক্রমাগত একা হতে থাকার শ্বাশ্বত বাস্তবতাকে মাহবুব আজীজ তুলে এনেছেন তার কবিতায়। এই একাকিত্বের মধ্যেই এক আশ্চর্য বিভায় প্রেমিকার স্পর্শ খুজে ফেরেন কবি দিগ্বিদিক।
ঝাপসা হয়ে আসে সবুজ- আবার মনে করিয়ে
দেয়-আমিও ছিলাম ওইখানে; ওই পাতায়, ঘ্রাণে;
আনত মুখের কিনারে সলজ্জ সেই প্রথম আভা-
সবুজে সবুজ তুমি-আমাকে নিয়ে যাও একটানে ।
ভ্রান্তি হোক যত-তবু তোমাকেই স্পর্শ চাই ।
সবুজ ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাব দিগ্বিদিক- পাই বা না পাই ।
                             (ঝাপসা হয়ে আসে)
আদতে যন্ত্রণার কোন পরিসীমা বা শেষ বলতে কিছু নেই, প্রেমিকের কাছে তার প্রেমের প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির বাহাস নিঃসন্দেহে বৃথাই, প্রেমিক জেগে উঠে তার পার্থিব ভালবাসায়। সে সিমাহীন শূন্যতায়ও বাধা পড়ে যন্ত্রনাময় শিকলে। কবি কখনো অসুখি  প্রেমিকের মতই খুজেছেন প্রেমিকার ন্যায় ধূপের স্বর্গীয় সুবাস। কবি কি বিষ্মিত? তবে কবির এমনটা হয় কেন? কবির বিনয়ী শব্দের ছলে কোন এক তাড়িত বসন্তের সকালে পুষ্পময় তৃনভূমিতে নৃত্যের লাবণ্যঝড়া অবগাহনে অলি আর ভ্রমরের গুঞ্জরনে ফুলেরা প্রস্ফুটিত হয়, আকাশে মেলে দেয় পাখিরাও তাদের উড়বার ডানা ।
ঘুম শেষে পাখি ডানা ঝাড়া দেয়।
আড়মোড়া ভাঙ্গে। বিধ্বস্ত শরীরে ফের আক্রান্ত হবার নেশা-
পাখি উড়ে চলে আবার।
আবার সে ঝাঁপিয়ে পড়ে নীল আকাশের প্রচ্ছদে-
আশ্চর্য সেই পাকখাওয়া ক্যানভাসে ।
আসন্ন আরেকটি ঝড়ে লুট হবার আগে-
পাখি আদিগন্ত নীলে লুটোপুটি খায় !!
                          (লুটোপুটি)
একটা মোহময় ঘোরগ্রস্থতা আচ্ছন্ন করে রাখে কবিকে, যা তার পাঠক চিন্তাকে আরো প্রফুল্ল করে  তুলে। উষর জমিন অংকুরিত শস্যদানায় লাবণ্যময় করে তুলতে দিনরাত চাষ করে কবি, ক্ষণকালের ফুল আর পত্রপল্লবের মায়া ফেলে উড়ে যায় বুকের খাঁচায় পুষে রাখা তার পাখিটাও, তখন সকল উজ্জ্বল সৌন্দর্য ছাপিয়ে বৃথাই যায় তার নাঙল ফলার গভীর নৃতত্ব বিদ্যা। আদতে একজন শিল্পীর সাথে তার কল্পনার জগতের কোন বিরোধ থাকে না। একটা মনখারাপের বিষয়ও তাকে রোমান্টিক করে তুমুলভাবে, লুটোপুটি খাওয়া পাখিটার মত করে কবি লিখে রাখতে চায় নীলিমায় তার নাম - নাগরিক অপেক্ষায় থাকে কবিও একটি টেলিফোন বেজে ওঠার শব্দের।
প্রতি ভোর আর গভীর রাতে কান পেতে থাকি;
বিমগ্ন ধ্যানির মতো- শান্ত হয়ে অপেক্ষায় থাকি-
টেলিফোন আসবে !
হাত চলে যায় বাটনে বারবার- ফোন দিই!
হাত গুটিয়ে নিই বুজে যাওয়া মাকড়সার মতো
নিজেরই দিকে। ঘুম ভাঙার পর জলতেষ্টা পাবারও
আগে ইচ্ছে হয়- কেউ একজন আমার
ঋুলে যাওয়া নাম ধরে  ডাকবে!
                              (নীলিমায় লিখেরাখি) 
কামনায় তাড়িত হয় কবি, জীবনের প্রগাঢ় অনুভূতি থেকেই একজন কবি রোমান্টিক হয়ে উঠে। প্রেমকে উপলব্ধি করার সর্বাধুনিক যন্ত্র ইন্দ্রিয়, যার মন্ত্রজালে প্রেমিকের কাছে প্রেমিকা পেয়েছে চিরন্তন রূপ। নাগরিক জীবনধারার সঙ্গে কবি মাহবুব আজীজ তার প্রেমকে মিলিয়েছেন কখনো কখনো যা রোমান্টিক বিস্ফরণ ঘটায় পাঠক-হৃদয়ে । এভাবেই ব্যক্তিগত একাকিত্ব থেকে কবি হয়ে ওঠেছেন কল্পনাস্পন্দিত বড় বেশি প্রেমমথিত কিংবা এই কলহাস্য মুখরিত থৈথৈ মানুষের ভীড়ে নিঃশব্দে স্থির; কবি লিখেছেন  -
এখানে - এই কলহাস্য মুখরিত থৈথৈ
মানুষের ভীড়ে। আমার দাঁড়িয়ে থাকতেই
ভালো লাগছে। আসবে আরোও
 আরোও ট্রেন-
হুইসেল তুলে দিগ্বিদিক; আমি অনড়
দাঁড়িয়ে থাকবো। দাঁড়িয়েই থাকব
                             (আরো একটি ট্রেন)
মোটা দাগে বলা যায় এই রক্তমাংসের জীবনে নিজের অস্তিত্বকে বারবার খুঁজেছেন কবি মাহবুব আজীজ। তার ভাবনা কিংবা কল্পনার অদৃশ্য বৈরিতায় বাস্তবিক অমিল কখনো তাকে দিয়েছে বেদনা আর তাই হয়ত তাবৎ নিঃসঙ্গতা কাটাতে কবি ছুটে গেছেন মুখরিত মানুষের ভীড়ে। দুঃখ, কষ্ট আর ক্রমাগত ক্ষয় হওয়া জীবনে আবিষ্কার করেন নিঃসঙ্গতার মত একা থাকার কলহাস্যমুখরিত মানুষের সখ্যতা। কবি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন এই রোদ চশমার নাগরিক ঢাকা শহরে থাকবো না আর -
তোমাদের রোদচশমায় ঢাকা নগরে
আমি থাকবো না। সোজা চলে যাবো-
শহরের মাঝরাস্তা বরাবর হেঁটে;
তোমাদের পাসপোর্ট, দলিল- দস্তাবেজ, এটিএম কার্ড-
কিচ্ছু লাগবেনা। দ্রুত আমি চলে যাবো শূন্য হাতে;
খুব তাড়াতাড়ি; অলিগলির ধারও আমি ধারবো না।
                                        (ধূলি ধূসরিত)  
নাগরিক জীবনের বিষণ্ণতাবোধ, জীবন যন্ত্রণা, মানুষের ক্রমাগত নৈতিক অবক্ষয়ের চিত্র মাহবুব আজীজ তার কবিতায় খুব সাবলীল কাব্যময়তায় তা স্পষ্ট করেছেন তিনি। সমকালের আয়নায় কবি নিজেকে বারবার দেখবার চেষ্টায় ব্যাকুল; প্রতিদিন নিজের প্রতিচ্ছবিতে যাকে আবিষ্কার করেন সে আসলে তিনি নন। এর আগেও যে বিষয়টা বলবার চেষ্টা করেছি তা হলো, সময়ের বিবর্তনে আধুনিক মানুষের একা হয়ে যাবার যে অনিবার্য পরিণতি কিংবা অবক্ষয় তা কবির অন্তক্ষরণ ঘটায় বৈকি। সেই ক্লেদ, হতাশা , নাগরিক অবক্ষয় থেকেই কি কবির এই প্রস্থান এক প্রকারের পলায়ন কিনা; নাকি এর মধ্যেও জীবনের অবশিষ্ট সুরটুকুও পান করেত চান কবিতার এই লাইনটার মধ্য দিয়ে -
যাবার আগে তোমাদের ধূলি ধূসরিত গোলাপফুলগুলিকে
আরও একটু ভালোবেসে নিই। 
কবি বুঝেছেন হৃদয়ের টুকরো কষ্টেরা একদিন সবই পুরনো হবে দীর্ঘশ্বাসের মতই-
জানি, একদিন সবই  পুরনো হবে-
এলেবেলে না-পাওয়া, দীর্ঘশ্বাস, টুকরো কষ্ট ।
ঝড়াপাতার মতো পড়ে থাকবো কোন বিস্মৃতির
অতলে। কবেকার ম্লান মুখ- কেউ মনেও রাখবে না।
কোন কোন রাত্রি এসে তারার উৎসব সাজাবে-
জ্যোৎস্নায় অপার আলোয় ভেসে যাবে দশদিক;
বালক-বালিকারা বনের দিকে ছুটে ছুটে যাবে!
প্রগাঢ় উচ্ছ্বাসে মানুষ মানুষীরা হেসে উঠবে...
                                           (একা)  
নিশ্চই একজন কাপুরুষীভাবে তার বেঁচে থাকা হবে অনন্তকাল, সেই দিক দিয়ে কবি মনে নিয়েছেন মৃত্যুর অনিবার্য পরিণতি। নিঃসঙ্গতার ভেতরেও রোমান্টিকতার এক চরম মূর্তি একেছেন কবি মাহবুব আজীজ। খুব নিরবে নিভৃতে তার পলায়ন পর্বের নাগরিক রুচিবোধ নিঃসন্দেহে রোমান্টিক; স্মৃতিকাতর জ্যোৎস্নাভুক এই কবি চরমভাবে বিয়োগান্তক রেখাপাত টেনে যান পাঠক হৃদয়ে। সত্যিই যে পাখির জিভ কাটা সে পাখি ঠিকি কিচির মিচির করতে পারে শীস তো দিতে পারে, তার গান মানুষকে আনমনা করে না। মৃতদের শীতল রাজ্যে কবেকার ম্লানমুখে কবির এই একা প্রস্থানকেকে, নির্ধারণ করে তার নিয়তিকে? ফুল-পাখি , বৃক্ষরাজী, নদী, সমতল আর অতল এই সবকিছুর মাঝেই মানুষ মানুষকে আনন্দ দেয়, মানুষ তার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই মানুষের মাঝে থেকেই নিজের শারীরিক অস্তিত্বকে হারাতে চায় কবি নিজেও তার ব্যতিক্রম নয়। কবি লিখেছেনঃ
বহমান অমেয় বাতাসের মতো
অবিরাম দাঁড়িয়ে থাকা বৃক্ষেরও মতো
চিরমূক পাহাড়ের মতো
আজন্ম একা বয়ে চলা সমুদ্রের মতো
সীমিত আয়ের মানুষও চিরপ্রবহমান-
একাকী, অনাদী ও অন্তহীন –
নিঃসঙ্গতার মত একা !
                       (নিঃসঙ্গতার মত একা)
কবিতাগুলো পাঠ করলেই, বুনো লতাগুল্মের মতই মুহূর্তে বেড়ে উঠতে বাধ্য আমার মত পাঠকের শিরা উপশিরায়। জীবনের বেদনাকে তখন অতি সামান্যই আশ্রয় দেয়া যায়;  আমার মনে পড়ে যায় গ্রীক পুরাণের নার্সিসাস নামক সুদর্শন যুবকটির কথা। যিনি সুন্দরীতম উপদেবী ইকোর ভালবাসাকেও অবলীলায় ত্যাগ করেন, কেননা মর্তের পৃথিবীতে নার্সিসাস সবচেয়ে বেশি মুগ্ধতা নিয়ে ভালোবেসেছেন নিজেকেই। তাইতো তার দেহাবশেষ খুজতে গিয়ে দেবতারা খুজেপেলো এক স্নিগ্ধ, উজ্জ্বল সুবাসিত ফুলের - কবির সাথে গলা মিলিয়ে আমিও বলতে চাই -
হে নিষ্ঠুর সময় ! হে পার্থিব বাস্তবতা !
হে প্রিয় পদরেখা -
এই পৃথিবী একবারই পায় তাকে !
                               (প্রিয় পদরেখা )
~=~=~=~=~=~=~=~=~=~=-

নিঃসঙ্গতার মতো একা
মাহবুব আজীজ

প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ
প্রকাশক: কথাপ্রকাশ, ঢাকা।
প্রকাশকাল :ফেব্রুয়ারী ২০১৭
মূল্য: ১৫০.০০
ISBN : 984701200637 5

আলোচকঃ ইমতিয়াজ আহমেদ, লেখক, সংবাদকর্মী। imtiazmyn@gmail.com

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ