মধ্যযুগে কাঁচ ঘষে তৈরি করা লেন্স মানুষের দৃষ্টিসীমা বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। মাইক্রোস্কোপ যন্ত্র দিয়ে মানুষ আকাশে-বাতাসে চারপাশে ভেসে বেড়ানো, মানুষের শরীরে- খাদ্যে গিজগিজ করা জীবাণুদের পরিচয় জানতে পেরেছে (পড়ুন ‘আইজ্যাক আসিমভ’ এর বই “জীবাণু বিষয়ে আমরা যেভাবে জানলাম”)। আর টেলিস্কোপ নামক যন্ত্রটি মানুষের দৃষ্টিকে মহাকাশের অনেক গভীর পর্যন্ত বিস্তৃত, প্রসারিত করেছে। মধ্যযুগে ঠিক কার হাতে টেলিস্কোপ আবিষ্কার হয়েছে তা জানা যায় না। তবে ইতালি নিবাসী গ্যালিলিও গ্যালিলি এই যন্ত্রের অনেক রকমের উন্নতি করেন। এই টেলিস্কোপ যন্ত্রটি মানব প্রজাতির জন্য কোন কোন রহস্যভান্ডার খুলে দিয়েছে তার মনোজ্ঞ বর্ণনা রয়েছে “টেলিস্কোপ কী বলে” নামক শিশু-কিশোর পাঠ্য বইতে। লিখেছেন প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের লেখক পাভেল ক্লুশানৎসেভ। সে দেশে একসময় বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় জ্ঞান বিজ্ঞানের বই অনুবাদ করে প্রকাশ করা হত। এই বইটি বাংলা ভাষায় প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮৬ সালে। প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের রাদুগা প্রকাশনী থেকে। পাতায় পাতায় রঙিন ছবি সজ্জিত এই বই নবীন পাঠকদের জন্য নতুনভাবে প্রকাশ করেছে বাংলাদেশের দ্যু প্রকাশন ২০১৭ সালে।
আকাশের দিকে মানুষের দৃষ্টিসীমা বাড়িয়ে দেয় টেলিস্কোপ। আর তাই আকাশ-মহাকাশের আকর্ষণীয় দৃশ্য-অদৃশ্য মহাজাগতিক বস্তুগুলো এই বইয়ের আলোচ্য বিষয়। সূচিপত্র দেখলে প্রসঙ্গগুলোকে এক নজরে দেখে নেয়া যাবে।
সূচিপত্র
- পৃথিবীর শেষ কোথায়?
- আকাশের তারা এত সুন্দর কেন?
- আকাশ কি ছেঁদা করা যায়?
- সূর্য আর চাঁদ কীসে তৈরি?
- মহাকাশের বস্তুপুঞ্জের অবলম্বন কী?
- সূর্য কেন উদয় হয়, কেনই-বা অস্ত যায়?
- গ্রীষ্মকালে সূর্যের তাপ বেশি কেন?
- চাঁদ কেন ফালি
- চাঁদে কী আছে?
- গ্রহ কী?
- বুধগ্রহে নামা যায় কি?
- শুক্রগ্রহে আমরা কী দেখতে পাব?
- মঙ্গলগ্রহে মঙ্গলবাসী আছে কি?
- বৃহস্পতি আর শনি কেমন?
- মানুষ কবে অন্যান্য গ্রহ সম্পর্কে আরও জানতে পারবে?
সূর্য আর চাঁদ কীসে তৈরি? ...
সূর্য কেন উদয় হয়, কেনই-বা অস্ত যায়? ... বুধগ্রহে নামা যায় কি?
হাজার বৎসর আগে আদিম মানুষের জানাশোনার পরিধি কম ছিল। তারা চারপাশের ভূপ্রকৃতি, গাছপালা, পরিবেশ, মাথার উপরের চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র, আকাশ, মহাকাশ প্রভৃতিকে চিনতে চাইত। এসবের পরিচয় কি, কোথা থেকে এল, কীভাবে তৈরি বা সৃষ্টি হল – এরকম অনেক প্রশ্নের উত্তর তাদের অজানা ছিল। কিন্তু মানুষের অজ্ঞতাকে তার অহংবোধ স্বীকার করতে চায় না। তাই কল্পিত যে কোন কিছু একটা মনমতো হলে তাকেই গ্রহণ করত জ্ঞান বলে। আধুনিক যুগের প্রেক্ষিতে তা যতই হাস্যকর বা অবাস্তব হোক না কেন, নির্বিরোধী সাধারণ মানুষের সন্তুষ্ট হতে তাতে কোন সমস্যা হত না। প্রাচীন মানুষের এইসব ভাবনাগুলো ইতিহাস বা বিজ্ঞানের মর্যাদা না পেলেও পৌরাণিক কাহিনী হিসেবে বেশ উপভোগ্য।মধ্যযুগে ইউরোপে টেলিস্কোপ আবিষ্কারের পূর্বে মহাকাশ সম্বন্ধে বৈজ্ঞানিক তথ্যসমৃদ্ধ জ্ঞান অর্জন দুরূহ ছিল। আর তাই সারা পৃথিবীর বিভিন্ন ভৌগলিক পরিবেশে বসবাস করা মানুষ নিজেদের মনমতো করে আকাশ বাতাস মহাকাশকে চিনে নিয়েছিল। টেলিস্কোপ যন্ত্র হাতে পাওয়ার সাথে সাথে অনেক দূরের মহাকাশচারী গ্রহ নক্ষত্রগুলো মানুষের একেবারে চোখের সামনে চলে আসে। এর ফলে মহাকাশের অপরাপর বস্তুগুলোকে মানুষ যেমন চিনতে পারল, তেমনি বুঝতে পারল মহাকাশের প্রেক্ষিতে নিজেদের অবস্থান। শুধু অতীত বা বর্তমান নয়, টেলিস্কোপ মানুষকে ভবিষ্যতে দূর মহাকাশে পরিভ্রমণের সুখ কল্পনার আস্বাদও দিয়েছে। বইয়ের শেষের দিকে লেখক বলেন -
অদূর ভবিষ্যতে আরও বিভিন্ন রকমের এবং জটিল থেকে জটিলতর আন্তঃগ্রহ স্বয়ংক্রিয় স্টেশন বুধ, শুক্র, মঙ্গল ও বৃহস্পতির দিকে যাত্রা করবে। তারা ওখানকার হালচাল দেখেশুনে আসবে। এরপর ওখানে মানুষের জন্য কী অপেক্ষা করছে সঠিকভাবে অবহিত হয়ে তবেই মানুষ নিজে ঐ সমস্ত গ্রহে যাত্রা করবে। পৃষ্ঠা - ১৬৬আজকের কিশোর কিশোরী আগামী দিনে বড় হয়ে কী ধরণের মানুষ হবে, তা নির্ভর করবে তার বর্তমানের ভবিষ্যত ভাবনা। প্রতিটি শিশু তার পরিপার্শ্ব নিয়ে প্রশ্ন করে। জানতে চায় অজানা সবকিছু। তার অন্তহীন প্রশ্নের ঝাঁপিতে আকাশ, মহাকাশ বিষয়ক প্রশ্নের অভাব নেই। তাদের অপরিণত অনভিজ্ঞ মনে যে সব প্রশ্ন আসে, সেগুলোকে কল্পিত চরিত্র দিয়ে না সাজিয়ে তথ্যভিত্তিক বৈজ্ঞানিক মতবাদ জানানোই শ্রেয়। তাহলে সে ভবিষ্যতে বিজ্ঞানকে ভিত্তি করে জীবন যাপনের কল্পনা করতে পারবে। গড়ে তুলতে পারবে বিজ্ঞাননির্ভর মানবিক সমাজ ব্যবস্থা। যুক্তিবোধ সম্পন্ন প্রজন্ম তৈরিতে এই ধরণের বিজ্ঞানভিত্তিক বইয়ের পাঠ খুব জরুরী। সেই প্রয়োজন অনুভব করে দ্যু প্রকাশন এই বই বের করেছে একথা নিশ্চিত করে বলা যায়।
যুক্তিবোধ সম্পন্ন প্রজন্ম তৈরিতে এই ধরণের বিজ্ঞানভিত্তিক বইয়ের পাঠ খুব জরুরী।
বইয়ের অনুবাদ বেশ ঝরঝরে। বাক্য সরল। কোন জটিল শব্দ নেই। অল্পবয়সী বালক - বালিকার উপযোগী শব্দ, বাক্য ও উপস্থাপনা। বইয়ের প্রায় প্রত্যেক পাতায় অর্ধপৃষ্ঠা বা পূর্ণপৃষ্ঠার রঙিন ছবি আছে। হাতে আঁকা রঙিন ছবিগুলো অপরিণত চিন্তাকে যথাযথ অবয়ব দেবে। মোটা অফসেট কাগজ হওয়ায় হাতে নিতেও ভাল লাগে। ছাপানোর মান ভাল। অপেক্ষাকৃত বড় ফন্টে ছাপা হওয়ায় দ্রুত পড়া যায়। ছবিগুলো চাররঙা হওয়ায় মূল বইয়ের নান্দনিকতা অক্ষুন্ন রয়েছে। মোটা কাগজ ও রঙিন ছবির জন্য দামটা একটু বেশি হয়ে গেছে। তবে ছোটদের উপযোগী মহাকাশ সন্বন্ধীয় বই বাংলা ভাষায় বাংলাদেশে খুব বেশি নেই। সেই দিক থেকে দামটাকে সহ্য করা যেতে পারে। প্রত্যাশা করি বইপ্রেমী, বিজ্ঞানপ্রেমী, যুক্তিপ্রেমী, মহাকাশপ্রেমী অভিভাবক তার শিশু সন্তানের মাঝে মহাকাশ জয়ের স্বপ্ন এই বইয়ের মাধ্যমে বপন করতে পারবেন।~~~~~~~~~~~~
টেলিস্কোপ কী বলে
পাভেল ক্লুশানৎসেভ
রুশ থেকে অনুবাদঃ অরুণ সোম
প্রচ্ছদ ও নামপত্রঃ ইউ কিসিলিওভ
আঁকিয়েঃ ইয়ে ভোইশ্ভিল্লো, ব কালাউশিন, ব স্তারোদুবৃৎসেভ
প্রথম বাংলা প্রকাশঃ রাদুগা প্রকাশন, মস্কো, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ১৯৮৬
প্রথম দ্যু প্রকাশঃ ২০১৭
পৃষ্ঠাঃ ১৬৮
মূল্যঃ ২৫০ টাকা
ISBN: 978-984-92972-6-0
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম