কাব্য বা শিল্পসৌন্দর্যের মর্মমূলে প্রবেশাধিকার দিতে পারে এরকম বই বাংলাদেশী পণ্ডিতগণ বিশেষ লেখেন নি। ফলে বাংলাদেশী লেখক, পাঠক, সমালোচক, বিশ্লেষকদের নির্ভর করতে হতো বিদেশী বইপত্রের উপর। বাংলাদেশী সাহিত্যমোদীদের এই বিদেশনির্ভরতার মুক্তি ঘটান বিখ্যাত শিক্ষক ও আবৃত্তিশিল্পী নরেন বিশ্বাস। তার “অলঙ্কার অন্বেষা” বইটি বাংলাদেশী পণ্ডিত লিখিত অলঙ্কারশাস্ত্র বিষয়ক প্রথম বই। তার সামনে কোন সহজপ্রাপ্য নমুনা ছিল না। ফলে পরিশ্রম করতে হয়েছে খুব। প্রাচীন পণ্ডিতগণের লেখা বিভিন্ন বই ঘেটে প্রয়োজনীয় তথ্য একত্রিত করা হয়ত সহজ কাজ। কিন্তু তার বিশেষত্ব অন্যখানে। তিনি উদাহরণ ব্যবহারের ক্ষেত্রে পূর্বসুরীদের নিদর্শন পুনর্বার ব্যবহার করেন নি। নতুন উদাহরণ গ্রহণ করেছেন সংস্কৃত ও বাংলা উভয় ভাষার রচনা থেকে। এমনকী সমকালীন কবি-লেখকদের সার্থক রচনা থেকেও প্রয়োজনীয় বাক্য বা ছত্র গ্রহণ করেছেন অকৃপণভাবে। নিজের বই সম্পর্কে তিনি ‘গ্রন্থ প্রসঙ্গ’ অংশে বলেন -
অলঙ্কার-অন্বেষার গৃহীত পরিভাষা, শ্রেণী-বিভাজনে এবং বিশ্লেষণ-পদ্ধতিতে সর্বাধিক প্রচলিত ও যুক্তিগ্রাহ্য মতামতকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। এবং বিতর্কিত বিষয়সমূহের জটিল তাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় না গিয়ে মূল ভাষ্যকে যথাসম্ভব সহজবোধ্যভাবে তুলে আনার চেষ্টা করা হয়েছে। অলঙ্কারশাস্ত্র বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিমাত্রে স্বীকার করবেন - কাব্যসৌন্দর্য-বিজ্ঞান (Aesthetics of poetry) বিশাল ও ব্যাপক, কাব্য-বিচারের পথ ঋজু ও বঙ্কিম, তাঁর আস্বাদন বা উপলব্ধিতেও মাত্রাভেদ অনিবার্য। বিশেষ করে অর্থালঙ্কারে যেহেতু ‘রূপ’ নয় ‘স্বরূপ’ আন্তরস্থিত অর্থ বা ‘চিদ্রূপই’ নিয়ন্তা, সেজন্যে অলঙ্কার চিহ্নিতকরণে মতভেদের অবকাশ বর্তমান। এ গ্রন্থে শ্রদ্ধার সঙ্গে পূর্বসূরীদের মতামত বিচার করা হয়েছে। যদি তাঁদের সিদ্ধান্তকে কোথাও অযৌক্তিক বলে মনে হয়েছে, সেখানে আমি তার কারণ উল্লেখ করেছি এবং আমার মতের সপক্ষে প্রমাণ হাজির করেছি – যাতে বিদগ্ধ পাঠক সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেন। অলঙ্কার-অন্বেষা প্রাচীন পণ্ডিতদের বিচারের ‘সপ্তম বেদাঙ্গ’ও নয় কিংবা সংস্কৃত ভাষায় খ্যাতিমান মণীষীদের উচ্চাঙ্গের গবেষণাসমৃদ্ধ কোনো অনুপম কাব্যসৌন্দর্য-বিজ্ঞানও নয়, অথবা সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতের পাণ্ডিত্যপূর্ণ কোনো কাব্যতত্ত্ব নয়। এটি মূলত একজন সহৃদয় কাব্য-পাঠকের সংবেদনশীল কাব্য-বিচারের প্রচেষ্টা মাত্র।
অলঙ্কার শাস্ত্রের পরিধি ব্যাপক, দিগন্তবিস্তারী; বহুবিধ সংজ্ঞা, তত্ত্ব, নির্ণায়কের বৈচিত্রে জটিল ও দুষ্পাচ্য। নরেন বিশ্বাস পণ্ডিতগণের কাছ থেকে যা শিখেছেন, তা সংস্কৃত ও বাংলা সাহিত্যের আলোকে বুঝতে চেয়েছেন, আর এর বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে আলোচ্য বইয়ের প্রতিটি পাতায়। লোভনীয় সূচিপত্রটি সাজানো হয়েছে “বিষয়-ক্রম” শিরোনামে।
বিষয়-ক্রম
- প্রথম অধ্যায়
- অলঙ্কার: উৎস ও ক্রমবিকাশ
- দ্বিতীয় অধ্যায়
- অলঙ্কার
- শব্দালঙ্কার
- যমক
- শ্লেষ
- বক্রোক্তি
- তৃতীয় অধ্যায়
- অর্থালঙ্কার
- (ক) সাদৃশ্যমূলক অলঙ্কার
- (খ) বিরোধমূলক অলঙ্কার
- (গ) শৃঙ্খলামূলক অলঙ্কার
- (ঘ) ন্যায়মূলক অলঙ্কার
- (ঙ) গূঢ়ার্থপ্রতীমূলক অলঙ্কার
সাহিত্য সুন্দর হয়ে ওঠে অলঙ্কারের ব্যবহারে। একথা শুধু সাহিত্যক্ষেত্রে নয়, প্রিয়জন বা নিজের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। অলঙ্কার ব্যবহার করে নিজেকে, প্রিয়জনকে, পরিপার্শ্বকে সাজানোর জন্য প্রয়োজন রুচি ও পরিমিতি জ্ঞান। সাহিত্যক্ষেত্রে এই শাস্ত্রের প্রতি রচয়িতার কৃতজ্ঞতা কতটুকু তা নির্ণয়ে নির্দেশনা দেয় অলঙ্কারশাস্ত্র। অলঙ্কারশাস্ত্রকে অনেকে সৌন্দর্যশাস্ত্রের সমার্থক মনে করেন। তাই বলা যায়, সৌন্দর্যের যেমন একটা নিয়ম আছে, পরিমাপ আছে, অলঙ্কারশাস্ত্রেরও তেমন রয়েছে নানাবিধ বিধিবিধান।
সাহিত্য আস্বাদন করতে গেলে সাধারণভাবে ততটা জ্ঞানের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু অনুধাবন বা বিশ্লেষণ করা অন্য বিষয়। সেখানে প্রসঙ্গাতীত প্রসঙ্গ উপস্থাপন বাহুল্যমাত্র। যা থেকে রক্ষা করতে পারে শুধু অধীত জ্ঞান। যিনি সাহিত্য আলোচনা করতে আগ্রহী, তার অবশ্যই সাহিত্যের বুহুবিধ প্রসঙ্গ নিয়ে অন্য পণ্ডিতদের মতামত জানা থাকা প্রয়োজন। অন্যদের পাঠ বিশ্লেষণ ছাড়া কারও ব্যক্তিগত আত্মানুসন্ধান অর্থহীন হয়ে পরতে পারে। নরেন বিশ্বাস এই প্রসঙ্গে সচেতন। যে সব জায়গায় নিজে প্রাচীন পণ্ডিতদের মতানুসারী হতে পারেন নি, সেই সব জায়গায় সবিনয় থেকেছেন। ‘গ্রন্থ প্রসঙ্গ’ অংশে অকপটে স্বীকার করেন -
বাঙলা ভাষায় রচিত সমস্ত অলঙ্কারগ্রন্থের ধারায় আমার এ অলঙ্কার-অন্বেষা কোনো ব্যতিক্রমী প্রচেষ্টা বলে আমি দাবি করছি না, তবে কিছু বিষয়ে আমি স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গির আশ্রয় নিয়েছি। প্রথমত, প্রায় সমস্ত অলঙ্কারগ্রন্থে বৈদিক বা সংস্কৃত ভাষার অনুবাদ দেয়া হয় না, কারণ ঐ সমস্ত গ্রন্থ-প্রণেতার বিশ্বাস, যাঁরা অলঙ্কারশাস্ত্রের চর্চা করেন বা পড়েন তাঁরা সকলেই সংস্কৃত জানেন, এটা পশ্চিম বাঙলার অধিকাংশ পাঠকের ক্ষেত্রে সত্যি হলেও আমাদের দেশের বাঙলা কাব্যপাঠকের বেশিরভাগই সংস্কৃতজ্ঞ নন, ফলে উদ্ধৃত বৈদিক বা সংস্কৃতের অনুবাদ প্রাঞ্জল ভাষায় দিতে চেষ্টা করেছি যাতে প্রাচীন অলঙ্কারের ঐতিহ্য আমাদের মানসিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয়ত, প্রায় সব অলঙ্কারবিদ উদাহরণ সংগ্রহের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত, খুব বেশি হলে নজরুল ইসলাম কিংবা সত্যেন দত্তের কাব্য পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রেখেছেন। আমি এ-ক্ষেত্রে প্রচলিত প্রথায় সমর্পিত নই, কারণ শুধু প্রতিষ্ঠিত কবির সৃষ্টি-শরীরের অলঙ্কার বিচার নয়, সাম্প্রতিক কবিকর্মে অলঙ্কার নির্ণয়ের চেষ্টা করেছি। তাই বাঙলাদেশের সমকালীন বহুকবির সৃষ্টি থেকে উদাহরণ গ্রহণ করেছি।
প্রথম প্রকাশের কালে (১৯৭৬) এই বইয়ের ভূমিকা লিখেছিলেন প্রাচীন ভারতীয় দর্শন, সাহিত্য ও অলঙ্কারশাস্ত্রে সুপণ্ডিত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত ও পালি বিভাগের তৎকালীন চেয়ারম্যান রবীন্দ্রনাথ ঘোষঠাকুর। তিনি কথাপ্রসঙ্গে বলেন -
বাঙলাদেশে কবি ও কাব্যের অভাব নেই, কিন্তু বিগত দুই যুগের মধ্যেও কাব্য-সৌন্দর্য বিচারের এই ধরনের একটা গ্রন্থও আমার দৃষ্টিগোচর হয় নাই, সেই দিক দিয়া বিচার করিলে অধ্যাপক নরেন বিশ্বাস রচিত এই গ্রন্থ প্রথম প্রচেষ্টা হিসাবে বাঙালি-পাঠক সাধারণের নিকটে সত্যই অভিনন্দনযোগ্য।
অলঙ্কার অন্বেষা
নরেন বিশ্বাস
প্রচ্ছদশিল্পীঃ মানবেন্দ্র সুর
প্রকাশকঃ অনন্যা, ঢাকা।
প্রথম অনন্যা প্রকাশঃ ২০০০
দ্বিতীয় মুদ্রণঃ ২০০২
পৃষ্ঠাসংখ্যাঃ ১৪৪
মূল্যঃ ৯০ টাকা
ISBN: 984-412-118-3
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম