আজ আমরা গণিতের নানারকম মজার মজার আনন্দের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবে এমন একটি বইয়ের কথা জানবো। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী প্রকৌশলী ‘চমক হাসান’ তার “গণিতের রঙ্গে হাসিখুশি গণিত” বইতে গণিতের বিভিন্ন মজার রঙ্গ-ব্যঙ্গের সাথে পাঠকের দেখা করিয়ে দিয়েছেন।
আমরা অনেকে অংককে ভয় পাই। সংখ্যা দেখলেই বা অংক কষতে বসলে মাথা গুলিয়ে যায়, মগজের কোষে কোষে যেন জট লাগে। কিন্তু বাস্তবে গণিত অতটা ভয়ের কিছু নয়। এই পৃথিবীতে এমন অনেক মানুষ আছে যারা গণিতকে ভালবাসেন; সংখ্যার সাথে খেলা করেন। তারা সারাক্ষণ সংখ্যা ও গণিত নিয়ে চিন্তা করেন। তারা গণিতকে আমাদের মত ভয় পান না। কারণ গণিতের যে আনন্দ আছে তা তারা অনুভব করেন। গণিত তাদের কাছে আনন্দের, সংখ্যা তাদের কাছে কোন রহস্য নয় বরং খুশির বার্তা নিয়ে আসে। গণিতের আনন্দ তারা অনুভব করেন। যারা গণিতকে ভয় পায়, তারা জানে না যে গণিত মানুষকে আনন্দ দিতে পারে, তার মধ্যে যুক্তিবোধ তৈরি করে। এর জন্য জন্য গণিতকে অনুভব করা প্রয়োজন। লেখক চমক হাসান ১ম সংস্করণের ভূমিকায় বলেন -
সুন্দর চিন্তা অনেক আনন্দের একটা ব্যাপার। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, খাবারের সংস্থান থাকলে, শুধু চিন্তার আনন্দেই একটা অর্থবহ জীবন পার করে দেয়া যায়। গণিত হলো গুছিয়ে চিন্তা করার ভাষা, বিজ্ঞানের ভাষা। গণিতের আনন্দ পেতে হলে গণিত অনুভব করতে হয়।
প্রকাশকালের তালিকা দেখলে বোঝা যায় বাংলাভাষী গণিতপ্রেমীদের মধ্যে চমক হাসানের এই বই বেশ জনপ্রিয়। ২০১৯ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি তারিখ পর্যন্ত মোট এগারবার প্রকাশ হয়েছে। প্রত্যেক সংস্করণের একাধিকবার মুদ্রণ করতে হয়েছে। ২য় সংস্করণ তো সেকায়েপ মুদ্রণসহ মোট ছয়বার মুদ্রণ করতে হয়েছে। এত চাহিদা থাকার অর্থ গণিতের মধ্যে আনন্দ খোঁজেন এমন মানুষের সংখ্যা বাংলাদেশে বাড়ছে। গণিত অনেকভাবেই আমাদের আনন্দ দিতে পারে। গণিতের বৈচিত্র্যময় ভূবনের মাত্র বারটি প্রসঙ্গ দিয়ে সাজানো এই বই। বইয়ের শেষের তিনটি পাতার পরিশিষ্ট অংশে গণিত বিষয়ক বিভিন্ন শব্দ, ঘটনা, স্থান, গণিতবিদ, সংশ্লিষ্ট বই ও ওয়েবসাইটের নাম সংযোজন করে লেখক বুদ্ধিমানের মত কাজ করেছেন। গণিতের আকর্ষণীয় ও আনন্দদায়ক দিকগুলো জানতে সূচিপত্রে একবার চোখ বোলানো যাক।
সূচিপত্র
- আল মুকাবালা
- কী নিষ্ঠুর!
- হায়রে শূন্য!
- ৩টি মেয়ে!
- মাথায় চুল কয়টি
- মিস্টার বাটা
- প্রিয় পাই (Π)
- অসীম ও কুমড়া
- ডিজে পিথাগোরাস
- তেমন কিছু নয় (৯)
- নিঃস্বার্থ গণিত: What is Math
- গোলকবাবু ও ঘ্যাচাং মাস্টার
- পরিশিষ্ট
শিরোনামগুলো পড়েই আনন্দের কিছুটা ছোঁয়া পাওয়া যাচ্ছে। লেখক অধ্যায়গুলোর নাম রেখেছেন বেশ রহস্য করে। আগ্রহী পাঠক এই বই পড়ার জন্য আকর্ষণবোধ না করে যাবেন কোথায়? লেখকের উপস্থাপনভঙ্গি প্রমাণ করে যে সমকালে গণিতের প্রতি বাংলাদেশী তরুণ প্রজন্মের ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়েছে। আত্মপরিচয়ের ইতিহাস সন্ধানে প্রয়োজন যুক্তিসিদ্ধ মানসিকতা। সমাজে যার বিকাশ ধীরগতির হলেও অগ্রসর হচ্ছে।
চমক হাসান প্রতিটি অধ্যায়ে সংখ্যা সংশ্লিষ্ট বেশ কিছু মজার ও অবাক করা দিকের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। সেই বিস্ময়কর ঘটনার সাথে জড়িত কাহিনী বর্ণনাও করেছেন নিজের ভাষায়, গল্পের মত করে। তিনি নিজে ব্যক্তিগত জীবনে সম্ভবত হাসিখুশী মানুষ। সেজন্য তার ভাষাতেও হাস্যরসের স্পর্শ অনুভব করা যায়। এই বই হাতে নিয়ে পাঠক পড়ার আনন্দেই পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ওল্টাতে থাকবেন।
তার বই থেকে দুটো মজার প্রসঙ্গ উপস্থাপন করি। পিথাগোরাসের উপপাদ্যের কথা আমরা সবাই শুনেছি। তিনি সংখ্যাকে খুব ভালবাসেন। সবকিছু সংখ্যা দিয়ে প্রকাশ করতেন। তার মতে ২২০ আর ২৮৪ এর মধ্যে যে সম্পর্ক তাই বন্ধুত্ব। কারণ একজনের প্রকৃত উৎপাদকগুলোর যোগফল অন্যজন। এ যেন একজনের ভেতরে অন্যজনের বসবাস। কী মজার তাই না?
সংখ্যা নিয়ে আরেকটি মজার প্রসঙ্গ টানি। লেখকের প্রিয় পূর্ণ সংখ্যা হচ্ছে ১১। এই সংখ্যাটি খাঁটি বাংলা ভাষায় সত্য কথা বলে। কেমন করে? সেটাই তো মজার! কারণ ১ কে ১১ দিয়ে ভাগ করলে কখনও শূন্য হয় না। সেটা ফলেই প্রমাণ। ১ কে ১১ দিয়ে ভাগ করলে হয় ০.০৯০৯০৯০৯০৯০৯০৯০৯...। এই সংখ্যাগুলো “শূন্য নয় শূন্য নয় শূন্য নয় শূন্য নয় শূন্য নয় শূন্য নয় শূন্য নয়” বলে নিরন্তর সত্যি কথা উচ্চারণ করে চলছে। কারণ ১কে ১১ দিয়ে ভাগ করে শূন্য হয় নি।
বাংলা ভাষায় গণিত নিয়ে এই ধরণের মজার বই খুব বেশি নেই। আসলে ১৫/২০ বৎসর আগে গণিত বা অংক নিয়ে কোন বই বাংলা ভাষায় লেখা হত বলে জানা যায় না। গণিতের প্রতি এক অজানা আতংক নিয়ে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করত। চমক হাসানের মত নতুন প্রজন্মের গণিতপ্রেমীরা বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে গণিতের আনন্দ ছড়ানোর জন্য নিরন্তর চেষ্টা করে চলছেন। এটা ভাল উদ্যোগ। গণিতের মজার মজার বিষয় বলতে গিয়ে তিনি বেশ কয়েকজন প্রাচীণ গণিতবিদের প্রতি তার শ্রদ্ধার্ঘ অর্পণ করেছেন। আর্যভট্ট, ব্রহ্মগুপ্ত, পিথাগোরাস, হাইপেশিয়া, আল খাওয়ারিজমি প্রত্যেককেই জানিয়েছেন যথাযথ সম্মান।
বইয়ে উপস্থাপিত গাণিতিক অংকগুলো বা জ্যামিতির সূত্রগুলো বোঝানোর জন্য পাতায় পাতায় অংক, ছক, জ্যামিতিক আকার ইত্যাদির ছবি রয়েছে। এগুলো এতটাই সহজ যে সাধারণ পাঠকেরও বুঝতে কোন সমস্যা হবে না। গণিত বিষয়ে আগ্রহী শিক্ষার্থী এই বই পড়ে গণিতকে আরও বেশি ভালবাসতে ও অনুভব করতে শিখবে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
~0~0~0~0~0~0~0~0~0~0~
গণিতের রঙ্গে হাসিখুশি গণিত
চমক হাসান
প্রচ্ছদ ও ভেতরের অংকনঃ চমক হাসান
প্রকাশকঃ আদর্শ, ঢাকা।
প্রকাশকালঃ প্রথম প্রকাশ: ২০১৫, ৩য় সংস্করণ, ৩য় মুদ্রণ: ২০১৯ (এটা ১১তম মুদ্রণ)
পৃষ্ঠাসংখ্যাঃ ১২৮
মূল্যঃ ২৫০
ISBN: 987-984-9266-21-1
গণিত নিয়ে আরও পড়ুনঃ-
- ‘সফিক ইসলাম’ লিখিত “গণিত আমাদের কী কাজে লাগে?”
- ‘শফিকুল ইসলাম’ অনুদিত ‘দিলীপ এম সালভি’ রচিত “শূন্যের ইতিকথা”
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম