বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের হৃদয়ে গণিতের প্রতি উৎসাহ জাগিয়ে তোলার মত বই ‘সৌমেন সাহা’ রচিত “গণিত চর্চা”। প্রযুক্তি প্রভাবিত এই যুগে গণিতে দক্ষতা ছাড়া টিকে থাকা কঠিন। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় গণিত সংশ্লিষ্ট সবকিছুই অহংকারের ভারে ন্যুজ্ব। ফলে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সাথে গণিতের একটা ভীতিকর দূরত্ব থেকেই যায়। শিক্ষার্থীদের মন থেকে গণিতের প্রতি এই অনাকাঙ্ক্ষিত ভয় দূর করা প্রয়োজন। সেজন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সিলেবাসের বাইরের গণিত বিষয়ক বই পড়তে হবে। আশার কথা হল দুই হাজার সালের পর থেকে বাংলা ভাষায় গণিতের আনন্দময়, আকর্ষণীয়, রহস্যময়, রোমাঞ্চকর, মজার ও ঐতিহাসিক দিকগুলো নিয়ে বই প্রকাশের পরিমাণ বেড়েছে। ‘গ্রন্থগত’ ওয়েবসাইটে আমরা মুহম্মদ জাফর ইকবাল, চমক হাসান, সফিক ইসলাম প্রমুখের বইয়ের আলোচনা প্রকাশ করেছি। আজ পরিচিত হব সৌমেন সাহা’ রচিত “গণিত চর্চা” বইটির সাথে।
নিজের বই প্রকাশের উদ্দেশ্য সম্পর্কে ‘ভূমিকা’য় বলেন-
অন্যান্য বিষয়ের থেকে অঙ্ক বিষয়টি একটু আলাদা। অঙ্ক শিখন এমন একটি শিখন প্রক্রিয়া, যে প্রক্রিয়া সম্পূর্ণভাবে চিন্তনের উপর নির্ভরশীল। অঙ্কশাস্ত্র শিক্ষার্থীকে চিন্তা করতে বাধ্য করায়। বর্তমান গ্রন্থটি বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষার্থীদেরকে সেই গণিত চিন্তা করার শক্তি যোগাবে বলে আমি বিশ্বাসী।
গণিতের কোন কোন বিষয় বা দিক শিক্ষার্থীদেরকে চিন্তা করার শক্তি দেবে বলে লেখক মনে করেন, তা সূচিপত্র দেখলে বোঝা যাবে।
সূচিপত্র
- গণিত ও প্রকৃতি
- গণিতের সৌন্দর্য
- কয়েকটি গাণিতিক প্রশ্নের ইতিহাসভিত্তিক আলোচনা
- ইতিহাস থেকে বিমূর্ত বীজগণিত
- আর্কেমিডিস ও গবাদি সমস্যা
- ফাই (φ) একটি স্বর্ণ সংখ্যা
- সমীকরণ ও তাদের সমাধান
- একটি গাণিতিক কোলাজ
- গণিত ও ডাকটিকিটের ছবি
- যদিও ভিন্নঘাত, তবুও অভিন্নে বাজিমাত
- “অনন্ত” ভূতের তাড়া
- অনুক্রম ও শ্রেণি
- সাইক্লয়েড ও তার আত্মীয়রা
- জীববিজ্ঞানে সমাকলনের প্রয়োগ
- বাস্তুসংস্থান ও পরিবেশ দূষণে গণিতের ভূমিকা
- সহায়ক তথ্যসূত্র
মোট পনেরোটি অধ্যায়ে লেখক গণিতের বিভিন্নমুখী শক্তি ও সৌন্দর্য প্রকাশ করেছেন। শেষের একটি অধ্যায়ে গণিত বিষয়ক যে বইগুলো থেকে লেখক তথ্য নিয়েছেন তার একটি তালিকা প্রকাশ করেছেন। পঞ্চাশটিরও অধিক বইয়ের এই তালিকাটি গণিতপ্রেমী সকলের জানা থাকা উচিত। সেজন্য আমরা সময় ও সুযোগমত ভবিষ্যতে এই গ্রন্থপঞ্জীটি প্রকাশ করার আশা রাখি।
পিথাগোরাস ও তার উপপাদ্য |
এই বইয়ে আলোচিত প্রত্যেকটি অধ্যায় বিভিন্ন তথ্য, চিত্র, মডেল, গ্রাফ দিয়ে সাজানো। পাতায় পাতায় ছবির ব্যবহার উপস্থাপিত প্রসঙ্গকে মনোহর করেছে। প্রথম অধ্যায়ে প্রকৃতি ও গণিতের আন্তসম্পর্কীয় বিভিন্ন তথ্য ও উপাত্ত সরল ভাষায় সহজ ভঙ্গিতে পরিবেশিত হয়েছে। প্রাকৃতিক নিয়মকে বোঝা ও ব্যাখ্যা করার জন্য গণিতের জ্ঞান থাকা অপরিহার্য। প্রকৃতির নিয়মকে অনুধাবনের জন্য গণিতজ্ঞ হওয়ার দরকার নেই। কিন্তু গণিত বুঝলে প্রকৃতির অনুধাবনকে পুনরুৎপাদন করা যায়। যেমন বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রে পূর্বনির্ধারিত সুর-তরঙ্গ তৈরির জন্য শিল্পী-কারিগরগণ আদিম কাল থেকে সচেতন বা অবচেতনভাবে গণিতের ব্যবহার করে আসছেন। মহাবিশ্বকে উপলব্ধি, তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার, এক্সরে, লেজার রশ্মি, চিকিৎসাবিদ্যা, ধাতুবিদ্যা, যোগাযোগ ব্যবস্থা, স্থাপত্য কীর্তি, যাবতীয় প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন সবক্ষেত্রে সরাসরি গণিতের প্রভাব রয়েছে।
- শফিকুল ইসলাম অনুদিত ‘দিলীপ এম সালভি’ রচিত “শূন্যের ইতিকথা”
- সফিক ইসলাম লিখিত “গণিত আমাদের কী কাজে লাগে?”
- চমক হাসান এর “গণিতের রঙ্গে হাসিখুশি গণিত”
- মুহম্মদ জাফর ইকবাল এর “গণিতের মজা মজার গণিত”
Freeman Dyson, George Eyre, Andrews-Ken, Ono_Karl, Mahiburg |
“গণিতের সৌন্দর্য” অধ্যায়ের শুরুতে লেখক প্রশ্ন করেন-
বিজ্ঞানের সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর সমীকরণ কোনটি?
“সৌন্দর্য=সত্য” এই সমীকরণটি জ্ঞান-বিজ্ঞানের সব শাখার জন্য প্রযোজ্য। গণিতও এর ব্যতিক্রম নয়। গণিতপ্রেমীদের কাছে গণিত সুন্দর। কিন্তু কেন সুন্দর? লেখক মনে করেন-
মন যেদিকে আকৃষ্ট হয়, যাতে সুখের এবং আনন্দের অনুভব হয়, যাতে মন তৃপ্ত হয় তাকেই আমরা সুন্দর বলি। পৃষ্ঠা- ১৫
গণিতের সৌন্দর্য কীরূপ? প্লেটো, অ্যারিস্টটল, পীথাগোরাস, বার্ট্রান্ড রাসেল, হাঙ্গেরীয় গণিতজ্ঞ পল এরডোস সকলে গণিতকে শুধু সত্য নয়, সীমাহীন সৌন্দর্যময় মনে করেছেন। পল এরডোস গণিতের অনবদ্যতা সম্পর্কে বলেন-
সংখ্যাগুলো কেন সুন্দর? এ প্রশ্নটি বিটোফেনের নবম সিমফনি কেন সুন্দর তা জিজ্ঞাসা করার তুল্য। কেন তা সুন্দর সেটা যদি তুমি বুঝতে না পারো তবে তা তোমাকে কেউ বুঝিয়ে দিতে পারবে না। আমি জানি সংখ্যাগুলো সুন্দর। তারা যদি সুন্দর না হয় তবে বিশ্বে সুন্দর বলে কিছু নেই। পৃষ্ঠা - ১৮
সৌন্দর্যের ধারণা মানুষের মননে দার্শনিক উপলব্ধির জন্ম দেয়। অর্থাৎ গণিতজ্ঞরা যেভাবে সৌন্দর্যকে ব্যাখ্যা করেন তা এক বিশেষ ধরনের দর্শনতত্ত্বের কথা বলে। যা অনেকটাই অতীন্দ্রিয়বাদ (Mysticism) নামক দার্শনিক তত্ত্বের মত।
এই অধ্যায়ে লেখক ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ের বিভিন্ন গণিতবিদের গণিতের সৌন্দর্য ও দর্শন সম্পর্কিত মতামত আলোচনা করেছেন; সাথে প্রায় প্রত্যেকের ছবি রয়েছে। ফলে উৎসাহী পাঠকের কাছে আলোচনাটি একেবারে বিমূর্ত ঠেকবে না।
ব্রহ্মগুপ্ত, আর্যভট্ট, ভাস্করাচার্য |
সূচিপত্র পাঠে আমরা জেনেছি এই বইয়ের প্রত্যেকটি প্রসঙ্গ আকর্ষণীয় ও কৌতুহল সঞ্চারী। যে পাঠক গণিতের অনাবিষ্কৃত জগতে পা ফেলতে উৎসাহী, তার পিছু হটার উপায় নেই। একের পর এক রহস্যময় সংখ্যা, উপপাদ্য, জ্যামিতি, সূত্র, ভগ্নাংশ তাকে কৌতুহলী করে তুলবে। এক দুর্নিবার আকর্ষণ বইয়ের পাতায় মুখ গুজে রাখতে বাধ্য করবে।
এই বইয়ের সবচাইতে আকর্ষণীয় অধ্যায় হল “গণিত ও ডাকটিকিটের ছবি”। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ গণিত চর্চাকে উৎসাহিত করতে ও চিন্তাশীল গণিতবিদগণকে সম্মানিত করতে ডাকটিকিট প্রকাশ করেছে। সে সব ডাকটিকিটের ছবি, ইতিহাস ও সংশ্লিষ্ট ঘটনা জেনে ভাল লেগেছে। আমরা আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্যকে যেমন উপেক্ষা করতে, তেমন সমকালীন মেধাবীদেরকে অবহেলা করতে পারঙ্গম। ফলে বাংলাদেশের ডাকটিকিটে সুদূর ভবিষ্যতে গণিতের উপস্থিতি দৃশ্যমান হবে, সে আশা করতেই পারি। বাইশটির মত গণিত অঙ্কিত ডাকটিকিটের ছবিগুলো কিশোর মনকে আলোড়িত করবে এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়।
বিভিন্ন দেশের ডাকটিকিটে গণিত ও গণিতজ্ঞের ছবি |
‘সৌমেন সাহা’র “গণিত চর্চা” বইয়ের মূল ভাবটি সহজ করে প্রথম প্রচ্ছদের পরের ফ্ল্যাপে জানিয়ে দেয়া আছে।
অঙ্ক মানেই ভাবগম্ভীর একটি বিষয়। আর অঙ্কের শিক্ষক-শিক্ষিকারা নিজেদের চারপাশে অযথা একটা গাম্ভীর্যের রেখা টেনে রাখেন বলেই সকলে অঙ্ককে ভয় পায়। এছাড়া উপস্থাপনার বৈচিত্র্যের অভাব বিষয়টিকে আরো দুর্বোধ্য ও নীরস করে তোলে।… আসলে অঙ্ক করার জন্য চাই সুস্থ ও যুক্তিশীল মন, যা গড়ে নিতে হবে শৈশবেই। অঙ্ক শিখতে হলে অঙ্ক বই পড়তে হবে। তার ভিতরের মূল সত্যকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করতে হবে। বর্তমান গ্রন্থটিতে গণিতের এমনসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে যা শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের পরিসীমাকে আরো বাড়িয়ে দেবে এবং ছাত্র-ছাত্রীদের মনে অঙ্কের ভীতি দূর করতেও অনেকটা চেষ্টা করবে।
বইয়ের প্রচ্ছদটি সুন্দর। প্রখ্যাত প্রচ্ছদশিল্পী ধ্রুব এষ তাঁর নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় বইটির মুখাবয়বকে রহস্যময় করে তুলেছেন। এ্যাবাকাসের ছবি, ম্যাট্রিক্স সিনেমার মত সবুজ রঙের সংখ্যাক্রম ব্যবহার প্রচ্ছদটিকে বৈচিত্র দিয়েছে। সাদা পৃষ্ঠায় ছাপার মান ভাল। গাণিতিক সূত্র ও গণিতজ্ঞদের ছবি স্পষ্টভাবে ছাপানো হয়েছে। সারা বইতে সম্ভবত শতাধিক ছবি আছে। এত বেশি গণিতবিদের ছবি এত অল্প পৃষ্ঠার আর কোন বইতে আছে বলে আমরা জানা নেই। বাংলাদেশের তরুণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে গণিতকে জনপ্রিয় করতে ‘সৌমেন সাহা’ রচিত “গণিত চর্চা” বইটি সহায়ক হবে। বাংলাদেশের সকল স্কুল কলেজের লাইব্রেরিতে এই বইটির একাধিক কপি রাখার প্রস্তাব করছি।
-+-+-+-+-+-
গণিত চর্চা
সৌমেন সাহা
প্রচ্ছদঃ ধ্রুব এষ
প্রকাশকঃ অক্ষর প্রকাশনী, ঢাকা।
প্রকাশকালঃ ২০১৪
পৃষ্ঠাসংখ্যাঃ ১২৮
মূল্যঃ ২০০ টাকা
ISBN: 978-984-90414-3-6
2 মন্তব্যসমূহ
দারুন বই৷ আমার প্রিয় বই৷
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
মুছুনমার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম