সহজভাবে বললে যাদের আবিষ্কার আমাদের জীবনযাত্রা আরামদায়ক করেছে তারা বিজ্ঞানী। বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপদ আপদে তাদের অবদান ছাড়া মানবজাতির অস্তিত্ব বিপন্ন হত। মানুষের জীবনকে সুস্থতায়, আনন্দে যারা ভরিয়ে তোলেন তাদের জীবনযাত্রা কীরকম তা অনেকের জানতে ইচ্ছা করে। বিজ্ঞানীদের জীবনী বা জীবনকথা নিয়ে বাংলা ভাষায় বেশ কয়েকটি বই আছে। আজ আমরা প্রখ্যাত কম্পিউটার বিজ্ঞানী ও বাংলা উইকিপিডিয়ার প্রশাসক রাগীব হাসান লিখিত “বিজ্ঞানীদের কাণ্ড কারখানা” বইটির সাথে পরিচিত হব। লেখক বইয়ের ভূমিকায় বিষয়টি দুয়েক কথায় স্পষ্টভাবে প্রকাশ করেছেন। তিনি জানান –
বিজ্ঞানীদের জীবনীর কথা শুনলেই মনে হয় খটোমটো কিছু একটা, চোখে মোটা চশমাওয়ালা খুব প্রচণ্ড পড়ুয়া কারও কাহিনি, সারা জীবন ধরে যে বইয়ে নাক গুঁজে কাটিয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞানীদের জীবনটা আসলে মোটেও সে রকম নয়, বরং বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীদের জীবনে অসাধারণ, মজার, অভাবনীয় সব ঘটনা ঘটেছে।
যে বিজ্ঞানীদের জীবনের মজার ঘটনা বা কাণ্ডকারখানা এই বইতে রয়েছে তার তালিকা রয়েছে সূচিপত্রে। অতএব বইয়ের মূল পাঠ শুরু করার আগে সূচিপত্রটি একবার দেখে নেয়া যেতে পারে।
সূচিপত্র
- ভূমিকা
- বোস স্যারের ভুল
- রাজার ভেজাল মুকুট
- আর্কিমিডিসের তাপরশ্মি
- আত্মভোলা আইনস্টাইন
- দুষ্ট ছেলে গাউস
- আপেল বালকের মন্দ ভাগ্য
- হাউই সাহেবের দুঃস্বপ্ন
- হ্যালো ওয়াটসন সাহেব, একটু আসবেন কি?
- হাবাগোবা ছেলের মহা মহা আবিষ্কার
- তেজস্বী মারি
- সূর্যের আলোকে কি পেটেন্ট করে আটকে রাখা যায়?
- যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে…
- ড. ফ্লেমিংয়ের বিদঘুটে ছত্রাক
- চন্দ্রের সীমা
- খাদ্যরসিক প্রকৌশলীর আগুনহীন চুলা
- বেকেরেলের জ্বলজ্বলে পাথর
- লীলাবতীর লীলা
- বিক্রমপুরের পোলার আপসহীন সাধনা
- জীবনকণিকা
সূচিপত্র পাঠে জানা যায় যে, বইয়ে সূচনার ‘ভূমিকা’ ও শেষের ‘জীবনকণিকা’ নামক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়টিসহ মোট বিশটি প্রবন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে আঠারোটি অধ্যায়ে সতেরোজন বিজ্ঞানীর মজার, রসালো, অভাবনীয়, চমকপ্রদ, কাকতালীয় ঘটনার বর্ণনা আবেগপ্রবণ পাঠককে আনন্দ দেবে। পাঠক বুঝতে পারবেন বিজ্ঞানীগণ চিন্তায় এবং কর্মে বিশিষ্ট হলেও আসলে তারা আমাদের মতই রক্তমাংসের মানুষ। তারাও আমাদের মত আবেগের প্রাবল্যে আলোড়িত হন। বুদ্ধিদীপ্ত কাজ দিয়ে নিজেকে এবং পরিপার্শ্বকে বাঁচিয়ে তোলেন শত্রুর হাত থেকে। আর্কিমিডিসের কথাই ধরি। এই বইতে তার জীবনের দুইটি প্রধান ঘটনার বর্ণনা আছে। একটি রাজার মুকুটে ভেজাল আছে কি নেই, তার সমাধান ভেবে ‘ইউরেকা, ইউরেকা’ বলে রাস্তায় দিগম্বর হয়ে দৌড়ানোর ঘটনা ও অন্যটি আয়নায় সূর্যের আলো প্রতিফলিত করে তৈরি করা তাপরশ্মি দিয়ে রোমান সৈন্যদের হাত থেকে নিজের শহর সিরাকিউজ রক্ষার কাহিনী।
এই বই ঠিক সরাসরি বিজ্ঞানীদের জীবনকাহিনী নয়। তাদের জীবনের দুয়েকটা মজার বা অবাক করা কাণ্ড কারখানা তুলে ধরাই এই বইয়ের উদ্দেশ্য। সাধারণ পাঠক বুঝতে পারবেন বিজ্ঞানীরা অলৌকিক শক্তির অধিকারী কোন মানুষ নন। তারাও আমাদের মত সাধারণ মানুষ। প্রকৃতির অপার রহস্য তাদেরকেও অবাক করে, বিস্ময়াভিভূত করে। সাধারণ তাপমাত্রার পরিবর্তন তাদেরকেও কাবু করে। তারা আমাদের মতই কখনও কখনও ভুল কাজ, অলসতা বা বোকামী করে ফেলেন। এই যেমন বিজ্ঞানী ফ্লেমিংয়ের অলসতা পেনিসিলিন ব্যবহারের দ্বার খুলে দেয়। আবার বৈদ্যুতিক বাতি, ফোনোগ্রাফ এর মত অতি প্রয়োজনীয় যন্ত্রের উদ্ভাবক টমাস আলফা এডিসন পড়াশোনায় অতটা ভাল ছিলেন না। স্কুল থেকে তাকে বের করে দেয়া হয়েছিল। প্রধান শিক্ষক তার মা'কে বলেছিলেন –
আপনার ছেলেটা বিশিষ্ট গর্দভ। ওকে দিয়ে পড়াশোনার কিচ্ছু হবে না। মাথায় গোবর ছাড়া আর কিছুই নাই। এই স্কুলে ওকে আর রাখা যাবে না। পৃষ্ঠা- ৪১
আবার আইনস্টাইন এতটা ভুলোমনের ছিলেন যে নিজের বাড়ির ঠিকানা পর্যন্ত তার মনে থাকত না। এরকমটা দুর্বল স্মৃতিশক্তির কারণে নয়, তিনি আসলে অন্য বিষয়ে অন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এতটাই চিন্তিত যে, তার স্মৃতিভান্ডার এই সাধারণ তথ্যটা ধরে রাখতে চায় নি।
বইয়ে উল্লেখিত সব ঘটনাই যে আনন্দের বা মজার তা নয়। চন্দ্রশেখর জাহাজে যাত্রাকালীন অবসর সময়ে বিনোদনে ব্যস্ত না থেকে মরণাপন্ন নক্ষত্রের জীবন নিয়ে মৌলিক চিন্তা করেছেন। ১৯৩০ সালে যে তত্ত্ব আবিষ্কার করেছেন, তা প্রমাণ করার মত প্রযুক্তি সে সময়ে ছিল না। ১৯৭২ সালে চন্দ্রশেখরের চিন্তা প্রমাণিত হয় আর নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন ১৯৮৩ সালে। আবার পোলিও রোগের টিকা আবিষ্কারক বিজ্ঞানী জোনাস সাল্ক তার আবিষ্কারের পেটেন্ট করেন নি। তার মহত্ব চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে। গ্যাস্ট্রিক আলসারের জীবাণু আবিষ্কারক ব্যারি মার্শাল নিজেকে বানিয়েছিলেন গবেষণার গিনিপিগ। জীবাণু ভর্তি তরল নিজে খেয়ে প্রমাণ করেছেন যে গ্যাস্ট্রিক আলসার একটি জীবাণুবাহিত রোগ এবং এন্টিবায়োটিক দিয়ে এর পূর্ণ চিকিৎসা করা যায়। বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র তার গবেষণার স্বীকৃতির জন্য ব্যাকুল ছিলেন না। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার মানব কল্যাণে উৎসর্গ করার মত মানবিক বোধ তিনি পৃথিবীর সামনে উপস্থাপন করেছেন।
বিজ্ঞানীদের জীবনের এরকম ছোট ছোট ঘটনা বা কাহিনী দিয়ে সাজানো এই বই। বিজ্ঞানপ্রেমী পাঠক এক বইতে একাধিক বিজ্ঞানীর সাথে পরিচিত হতে পারবেন। জানতে পারবেন তাদের জীবনের অনেক অজানা কাহিনী। আর এর ফলে পাঠকের হৃদয়ে বিজ্ঞানীদের জন্য তৈরি হবে অপার ভালবাসা ও আগ্রহ। লেখক রাগীব হাসান নিজে একজন বিজ্ঞানী। যন্ত্রকৌশলের জটিল জগতে তার অবাধ যাতায়াত। বাংলা ভাষায় লেখালেখিতেও রয়েছে প্রবল উৎসাহ। তার ভাষাভঙ্গি সরল, সহজ। কোনরকম জটিল শব্দ তার লেখায় খুঁজেও পাওয়া যায় না। সহজবোধ্য শব্দ ও সাবলীল গদ্য ব্যবহারের এই দক্ষতা তার সহজাত। ফলে বইটি পড়তে গিয়ে কোথাও হোঁচট খেতে হয় না।
বইটি বোর্ড বাঁধাই। বেশ শক্তপোক্ত হওয়ায় সহজে ছিঁড়বে না। বহুদিন ধরে বহু ব্যবহারেও জীর্ণ হবে না। বইয়ের প্রচ্ছদটি আকর্ষণীয় হয়েছে। বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের একটি ক্যারিক্যাচার পাঠককে বইটি পড়তে উৎসাহ দেবে। বইয়ের ভিতরে প্রবন্ধগুলোতে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীদের বিভিন্ন ছবি সংযোজন করা হয়েছে। নতুন প্রজন্মের মননে এই বই বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীদের প্রতি ভালবাসা জাগাতে সহায়ক হবে। প্রত্যাশা করি বাংলাদেশের সকল নবীন পাঠক এই বইয়ের সান্নিধ্য পাক।
<><><><><><><><><>
বিজ্ঞানীদের কাণ্ড কারখানা
রাগীব হাসান
প্রচ্ছদঃ সাজু
প্রকাশকঃ আদর্শ, ঢাকা।
প্রকাশকালঃ প্রথম প্রকাশঃ ২০১৮, ১ম সংস্করণ ২য় মুদ্রণঃ ২০১৯
পৃষ্ঠাসংখ্যাঃ ৯৬
মূল্যঃ ২০০ টাকা
ISBN: 978-984-9266-43-3
2 মন্তব্যসমূহ
আমার প্রিয় বই৷
উত্তরমুছুন:}
উত্তরমুছুনমার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম