স্বদেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সাজু, ধনু মিয়া, সূর্য, সূর্যি, সূর্যের মা সর্বোপরি অশ্রুলেখার মধ্য দিয়ে নাট্যকার বিরুন-আল-রশিদ পূর্ব বাংলার মানুষের অত্যাচারিত হওয়ার নাট্যালেখ্য চিত্রিত করেছেন ।
নাটকে দৃশ্য আছে মোট ১৪টি। ১৯৯৭ সালে বাংলা একাডেমী থেকে তরুণ লেখক প্রকল্পের আওতায় নাট্যকার বিরুন-আল-রশিদের নাট্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। নিম্নে প্রতিটি দৃশ্যের ভাবার্থ আলাদা করে বর্ণনা করা হলো:
নাট্যগ্রন্থের প্রথম দৃশ্যে দেখা যায় আট দশ বছরের বালক যার নাম সূর্য, তার বাবাকে উজান দেশের অত্যাচারী বড় সর্দার বেরহম খাঁর দুজন লাঠিয়াল ধরে বজরায় নিয়ে যায়। সূর্যের মা শত চেষ্টা করেও রুখতে পারে না। সূর্যের বাবা ভাটির দেশের বিদ্রোহী কৃষক, উজানী বেরহম খাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার সাহস দেখিয়েছিলো কিংবা খাজনা দিতে অস্বীকার করেছিলো। পরক্ষণে সেই লাঠিয়াল বাহিনী সূর্যের বাবার মৃতলাশ ফিরিয়ে দিয়ে যায়। বজরায় যাকেই নিয়ে যাওয়া হয় তারই লাশ ফেরে। বেরহম খাঁর আদেশে সূর্যের বাবার লাশ কেউ স্পর্শও করতে পারে না। সূর্যের মা আর সূর্য লাশের কবরস্থ করতে থাকে।
দ্বিতীয় দৃশ্য সূর্যের বাবার ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারার ঠিক এক যুগ পরের। যেখানে সূর্য, সূর্যের বন্ধু সাজু, ধনু মিয়া, অশ্রুলেখা ওরা বড় হয়ে গেছে। বজরার বহর নিয়ে বেরহম খাঁ আসছে এ খবর এতিম হিন্দু বালক অজয় এসে জানায়। সূর্য প্রতিবাদ করবে, রুখে দেবে মর্মে অন্যদেরও রাজী করায়।
তৃতীয় দৃশ্যে মনুচাষী ও তার মেয়ের সংলাপ দিয়ে শুরু যেখানে মনুচাষী স্বপ্ন দেখে ক্ষেতের ধান বিক্রি করে রফিকের সাথে নিজ মেয়ের বিয়ে দেবে। তখনই বেরহম খাঁ লাঠিয়াল নিয়ে এসে ধান দাবি করে। সূর্য, সাজুদের সাথে লাঠিয়াল বাহিনীর লাঠালাঠি শুরু হয় এবং বেরহম খাঁ পরাজিত হয়ে ফেরত যায়।
চতুর্থ দৃশ্যে সূর্য আর অশ্রুলেখার রোম্যান্টিজম চিত্রিত। অজয় তার দিদি অশ্রুলেখাকে ডেকে নিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে এ দৃশ্যের সমাপ্তি ঘটে।
পঞ্চম দৃশ্যে দেখা যায় অস্থির বেরহম খাঁ। পরাজয়ের গ্লানি সহ্য না করতে পেরে ভাটির দেশ আক্রমণ করতে চায়। কিন্তু তার দুই সহযোগী ভুট্টা খাঁ ও ইয়া খাঁ তাকে নিবৃত্ত করে। ভুট্টা খাঁ বলে রণনীতির চেয়ে রাজনীতি বেশি কার্যকর। তারা নদীতে বাঁধ দিলে ভাটির দেশের লোক পানি না পেয়ে ফসল ফলাতে পারবে না, তখন তারা নতজানু হবে। সে বুদ্ধি মোতাবেক বেরহম খাঁ পাহাড় কেটে নদীতে বাঁধ দিতে মনস্থ হলো।
ষষ্ঠ দৃশ্যে দেখা যায় নদীতে বাঁধ দেয়ার কারণে সাজু, ধনু মিয়া, অশ্রুলেখা, সূর্য ও সূর্যের মা খুবই চিন্তাগ্রস্ত। সূর্য মনস্থ করে ভাটি দেশের মানুষ একত্র হয়ে এর উচিত জবাব দেবে।
সপ্তম দৃশ্যে বাঁধ ভাঙার উদ্দেশ্যে সবাই রওনা হলে বেরহম খাঁর লাঠিয়াল বাহিনী আক্রমণ করে। উভয়পক্ষের মধ্যে লাঠালাঠির এক পর্যায়ে সূর্য ও তার কৃষক বাহিনী পরাজিত হয়। সূর্যের মা আঘাত প্রাপ্ত হয়ে মারা যায়, সূর্যকে আহত করে ধরে উজানের দেশে চলে যায় তারা। এসব দেখে অশ্রুলেখার ভেতর বিদ্রোহ জেগে উঠে।
অষ্টম দৃশ্যে বেরহম খাঁ সূর্যকে নানা প্রলোভন আর লোভ দেখিয়ে হাত করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে কোতোয়ালকে নির্দেশ দেয় চাবুক মারতে। সূর্য জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। ওদিকে পানির অভাবে ভাটির দেশে দৈন্যদশা নামে। ক্ষুধার তাড়নায় ইজ্জত বিলিয়ে দিচ্ছে। মনুচাষীর সেই যুবতী কন্যা সূর্যি আজ বেরহম খাঁর রক্ষিতা। সূর্যি ভালোবাসার মায়াজালে কোতোয়ালকে ভুলিয়ে সূর্যকে পানি খেতে দেয়।
নবম দৃশ্যে ভাটির দেশের মানুষের অনাহারীর চিত্র চিত্রিত। অশ্রুলেখা নিজের সাথে নিজে যুদ্ধ করে, দেশকে বাঁচাতে হবে, বন্দি সূর্যকে বাঁচাতে হবে, প্রয়োজনে নিজের ইজ্জত বিলিয়ে দিয়ে হলেও। ভাটির দেশের মানুষ বেরহম খাঁর বশ্যতা মেনে নিতে রাজী হলে অশ্রুলেখা তাদের বাঁধা দেয়।
দশম দৃশ্যে অশ্রুলেখার কাছ থেকে এক মুঠো চাল এনেছিলো খুঁড়িমা অজয়কে খেতে দেবে বলে। ক্ষুধার্ত অজয় তার আগেই মারা যায়। এ নিরন্ন মানুষগুলোকে বাঁচাতে হলে কি করতে হবে তার দিশা দেয় সূর্যি। অশ্রুলেখাকে বেরহম খাঁর দুর্গে নিয়ে যাবে, ভাটির দেশ বাঁচাতে, সূর্যকে বাঁচাতে প্রয়োজনে বীরাঙ্গনা হবে।
একাদশ দৃশ্যে বশ্যতা স্বীকারের জন্য সূর্যের সাথে বেরহম খাঁ দর কষাকষি করে। সূর্য থুথু ছিটিয়ে দেয়। বেরহম খাঁ কোতোয়ালকে চাবুক চালাতে নির্দেশ দিলে ভাটি সুন্দরী অশ্রুলেখা প্রবেশ করে বেরহম খাঁকে থামায়, সূর্যকে বাঁচানোর জন্য বেরহম খাঁর কাছে নিজেকে সঁপে দেয়।
দ্বাদশ দৃশ্যে বেরহম খাঁ অশ্রুলেখার নৃত্যে মুগ্ধ হতে থাকে। এক পর্যায়ে অশ্রুলেখা সূর্যের মুক্তি চাই, প্রয়োজনে সারা জীবন বেরহম খাঁর রক্ষিতা হয়ে থাকবে। কিন্তু বেরহম খাঁ অশ্রুলেখাকে দুর্গের বাইরে বের করে দিয়ে কোতোয়ালকে নির্দেশ করে সূর্যের শরীরে গরম পানি ঢালতে।
তেরতম দৃশ্যে দেখা যায় ভাটির দেশের সবাই সূর্য আর সাজুকে অপরাধী করে উজান দেশের বেরহম খাঁর বশ্যতা মেনে নিতে রাজী হয়ে গেছে। কিন্তু তন্মধ্যে সূর্যি আর অশ্রুলেখা এসে বাঁধ সাজে। গ্রামবাসীকে বোঝায়, সবাই যুদ্ধে যাবার জন্য একমত পোষণ করে।
চতুর্দশ ও শেষ দৃশ্যে ভাটির দেশের সকল কৃষক উজান দেশকে আক্রোমণ করে। সর্দার বেরহম খাঁ ছোরা বের করে সূর্যের দিকে মারে, বুক পেতে দেয় অশ্রুলেখা। কৃষক জনতার আক্রোমণ রুখতে না পেরে বেরহম খাঁ পালাতে গেলে সূর্যের অাঘাতে মারা যায়। ছোরা বিদ্ধ অশ্রুলেখাও সবার সম্মুখে মারা যায়। তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তার লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। তার আত্মত্যাগে ভাটির দেশ মুক্ত হয়।
স্বদেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সাজু, ধনু মিয়া, সূর্য, সূর্যি, সূর্যের মা সর্বোপরি অশ্রুলেখার মধ্য দিয়ে নাট্যকার বিরুন-আল-রশিদ যে নাট্যালেখ্য চিত্রিত করেছেন তার মধ্য দিয়ে আমি পূর্ব বাংলার মানুষের অত্যাচারিত হওয়ার দৃশ্যাদি সম্মুখে ভেসে উঠে। আর বেরহম খাঁ, ভুট্টা খাঁ, ইয়া খাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্য দিয়ে যে লুণ্ঠনের, নিগ্রহের চিত্র ফুটে উঠেছে তা যেন পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক শোষক শ্রেণিরই কোন মূর্ত প্রতীক। ভাটির দেশের কৃষক জনতা যখন একতাবদ্ধ হয়ে যুদ্ধে নিমগ্ন হয় তখন উজান দেশের অত্যাচার গোষ্ঠির পতন হয়। পূর্ব বাংলার আম জনতার একতাবদ্ধ গেরিলা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের সুপ্রশিক্ষিত বাহিনীর পরাজয় হয় এই দুয়ে যেন অনেক মিল পাওয়া যায়। এদিক দিয়ে বিচার করলে নাট্যগ্রন্থটিকে রূপক নাটক বা প্রতীকী নাটক বলেই বেশী মনে হবে, যদিও নাটকের আঙ্গিক সম্পূর্ণ কল্পিত।
----------------------------
নদীর নাম অশ্রুলেখা
বিরুন-আল-রশিদ
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম