গ্রন্থভুক্ত গল্পগুলোর প্রথমটি হলো "বড়দের গল্প যেমন হয় "। এ গল্পে লেখকের রাজনৈতিক সচেতনতার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। এটা মূলত একটি প্রতিকী গল্প। একটি শহরকে কেন্দ্র করে এ গল্পের পটভূমি গড়ে উঠেছে। নাতনি উর্মিলা গল্প শুনতে চাইলে দাদু তাকে গল্প শুনান। এ গল্প বড়দের গল্প। এখানে থাকে মানুষ গুম হওয়া, নির্বাচনের অনিয়ম প্রভৃতি বিষয়। শহরের মানুষ দেখে যে তাদের সবকিছু চুরি হয়ে যাচ্ছে। তাদের নিজস্বতা, তাদের প্রিয় জিনিসগুলো আর তাদের থাকছে না। হারিয়ে যাচ্ছে তাদের সামনেই। অর্থাৎ শহরে দেখা দিয়েছে প্রচণ্ড অনিয়ম। তখন তারা শহর প্রধানকে বদলানোর জন্য একটি নির্বাচনের দাবি জানায়। নির্বাচন হয়ও। কিন্তু এমনভাবে এ নির্বাচনের আয়োজন করা হয় যেখানে শহর প্রধান পুনরায় নির্বাচিত হতে পারেন। জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষার আর কিছু থাকে না। গল্প বলা শেষ করে দাদুর যে অনুভূতি হয় তা যেন এ শহরের প্রত্যেক মানুষের মনের অনুভূতি প্রকাশ করে। পুরো ব্যবস্থার উপর হতাশা থেকেই হয়ত তার চোখ ভিজে উঠে।
কামালের লেখায় মধ্যবিত্ত জীবনের নানান যন্ত্রণা, অপ্রাপ্তি ও হতাশার কথা উঠে আসে। "সেইসব পলায়নের গল্প" নামক গল্পটিতেও উঠে এসেছে আপাতভাবে প্রতিষ্ঠিত একজন মধ্যবিত্ত লোকের জীবন থেকে পলায়নের ইচ্ছা বিষয়ে। এ লোক ভালো পদে চাকরি করেন। কিন্তু এরপরও তার মনে পলায়নের ইচ্ছা জাগে। তার বেড়ে উঠার প্রক্রিয়াটাও লক্ষ্যনীয়। সে শৈশবেই বাড়ি থেকে পালিয়েছে। কোন নির্দিষ্ট কারণে নয়। তার ইচ্ছা হয়েছে বলেই সে পালিয়েছে। তখন সে কেবল স্কুলের ছাত্র। এ বয়সেই তার মনে পলায়নপর মনোবৃত্তি গড়ে উঠেছে। বাকি জীবনেও সে এ থেকে বের হতে পারেনি। তার জীবনে অপ্রাপ্তি আছে। যাকে সে ভালোবাসতো তার সাথে ঘর বাঁধতে পারেনি। এটার জন্য অবশ্য সে নিজেই দায়ি। একসময় মায়ের সতর্ক নজর তাকে পাহারা দিত। সে যাতে কোনভাবে আর পালাতে না পারে। তখন সে ছিল স্কুল পড়ুয়া। কিন্তু পরিণত বয়সে কে আর নজরে রাখবে। এ বয়সে চাইলেও পালানো যায় না। তাই হয়তো সে জীবন থেকেই পালাতে চায়। শারীরিক অবস্থার অবনতিও তার এ মনোভাবকে সাপোর্ট করে। পালিয়ে সে মায়ের কাছে চলে যেতে চায় যিনি শুয়ে আছেন "ছোট্ট নদীর পারে গভীর নির্জন এক গোরস্তানে"।
তাদের নিজস্বতা, তাদের প্রিয় জিনিসগুলো আর তাদের থাকছে না। হারিয়ে যাচ্ছে তাদের সামনেই।
"খেলা" গল্পে দেখা যায় হঠাৎ করে শহরে এক লোকের উদয় হয় যে তার কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে শহরের লোকজনের মনে তার সম্পর্কে বিস্ময় জাগাতে সক্ষম হন। তিনি তার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এমন কিছু কাজ সম্পন্ন করতে থাকেন যাতে শহরের নাগরিকগণ তাকে সমীহ করে চলতে শুরু করে। তবে এসবের আড়ালে যে তিনি অন্য কিছু করছিলেন তা মানুষ বুঝতে পারেনি। কারণ তার প্রতিটি কাজ ছিল সুচিন্তিত, সুদুরপ্রসারি লক্ষ্যাভিমুখী। তার ইতিবাচক কাজের পেছনে ছিল নেতিবাচক উদ্দেশ্য। এমনকি তার প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের প্রতিও ছিলেন নেতিবাচক। যেমন আব্দুল বারি নামক এক কর্মীর পেছনে তিনি লেগেছিলেন। তার ছিল সুখের সংসার। ছিল বেহালা বাজানোর অসাধারণ দক্ষতা। প্রথমত তার সুখের পরিবারকে ভেঙে দেয়ার জন্য এমন মেয়ের সাথে বিয়ের ব্যবস্থা করেন যে ইতোমধ্যে বদমেজাজি হিসেবে পরিচিতি হয়েছে। আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় বিয়ের ব্যবস্থা করে তিনি খুব ভালো একটি কাজ করছেন কিন্তু তার উদ্দেশ্য যে মহৎ ছিল না তা বুঝতে বেশি দিন সময় লাগেনি। আবার তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আব্দুল বারিকে বেহালা বাজানোর ব্যবস্থা করে দিয়ে প্রকৃতপক্ষে যাচাই করছিলেন তার দক্ষতা কতটা বেড়েছে। এরপরই তিনি চূড়ান্ত আঘাত হানেন। শিল্পীদের নিরবচ্ছিন্ন সুখ ভোগ থেকে বিরত রাখার ব্যবস্থা করেন। গল্পের শেষে এসে বুঝা যায় তার মূল রোষ শিল্পীদের উপর। তারাই কেবল সমস্ত রহস্য ভেদ করতে সম্ভব। যদি এমনই হয় তাহলে যে তার সবকিছু প্রকাশ হয়ে যাবে। তাই এদের মুখ বন্ধ করে দিতে হবে। আব্দুল বারির বাজনা থামানোর উপায় খুঁজে বের করার জন্য তিনি নির্দেশ দেন আবদুর রবকে। সে কোন উপায় না পেয়ে শেষে সব রকম শিল্পচর্চাকে নিষিদ্ধ করে দেয়। গল্পের শেষাংশে এসে লেখকের মূল বক্তব্য অনুধাবন করা যায়। এই ইঙ্গিতের মাধ্যমে লেখক আসলে কঠিন বাস্তবতাকে তুলে এনেছেন।জীবনের নানা সংকট মানুষকে কিভাবে পর্যুদস্ত করে দিতে পারে তার বর্ণনা পাওয়া যায় "যারা হারিয়ে যায়" গল্পে। আনোয়ার চরিত্রের মাধ্যমে এ বিষয়টি ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক। নিম্ন মধ্যবিত্ত জীবনে হয়ত এ বিষয়টি খুবই স্বাভাবিক। আনোয়ার শহরে তার পরিবার চালায় আবার গ্রামেও মায়ের দেখাশোনা করতে হয়। সে চাকরি করে যা আয় করে তা দিয়ে পরিবার চালানো কঠিন হয়ে যায় বলে খাবার ফেরি করার জন্য তাকে পথে দাঁড়াতে হয়। তা না হয় হলো, কিন্তু সে গভীর সংকটের মুখোমুখি হয় স্ত্রীর সাথে তার দূরত্ব বেড়ে গেলে। এ সংকট আরো ঘনীভূত হয় তার ছেলে হারিয়ে গেলে যার জন্য স্ত্রীর কারসাজিতে তাকে জেলে যেতে হয়। স্ত্রীর উদ্দেশ্য যে অন্যকিছু ছিল তা বুঝা যায় অন্য পুরুষের হাত ধরে পালিয়ে গেলে। ব্যক্তি হিসেবে আনোয়ার জীবন যুদ্ধে পরাজিত হয়ে যায়। এত প্রতিকূলতা সে সইবে কিভাবে? বাচ্চা হারিয়ে যাওয়া, স্ত্রীর খারাপ ব্যবহার, জেলে যাওয়া, চাকরি চলে যাওয়া, স্ত্রীর পালিয়ে যাওয়া, মায়ের মৃত্যু সংবাদ না পাওয়া- একজন মানুষের জীবনকে এলোমেলো করে দেওয়ার মতো যথেষ্ট। তাই শেষে নিজের কাছে থেকেই নিজে হারিয়ে যাওয়ার পদক্ষেপ নেয়।
"যখন সন্ধ্যা নেমে আসে" গল্পে এমন এক ব্যক্তির গল্প আমরা শুনি যে জীবনের সকলক্ষেত্রে কেবল পরাজিত হয়। পরিবারিক জীবন, চাকরি জীবন কোথাও থেকে তার কোন প্রাপ্তি নেই। এ চরিত্রের সাথে চলতে চলতে পাঠকের মনও যেন বিষাদাক্রান্ত হয়ে উঠে। তার সন্তান হয়ে মারা যায়, পরবর্তী সময়ে স্ত্রী আর গর্ভধারণ করতে পারে না। বরং জরায়ুতে টিউমার হওয়ার কারণে তা কেটে ফেলতে হয়। এটা একদিক। আরেক দিকে দেখা যায় তার বন্ধু ব্যবসা করে তড়তড়িয়ে অবস্থার উন্নতি ঘটালেও কোনরকম একটি চাকরি করে তার জীবন চলে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে । বন্ধুর এ অবস্থা তাকে মানসিকভাবে চাপ দিলেও তার আসলে কিছু আর করার নেই। জীবন সম্পর্কে হতাশ এ ব্যক্তি কিছু ভরসা পায় রাস্তায় একটি মেয়েকে কুড়িয়ে পেলে। সন্তান না হওয়ার অপ্রাপ্তি তাকে দিয়ে পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু এ জায়গাটাও যে নষ্ট হয়ে যাবে কে জানতো ? জয়িতা নামের মেয়েটি মৃত্যুর সাথে লড়াই করে হেরে যায়। হেরে যায় সে ও যে এ মেয়েটিকে এত আদর সোহাগ দিয়ে বড় করেছিল।
বাচ্চা হারিয়ে যাওয়া, স্ত্রীর খারাপ ব্যবহার, জেলে যাওয়া, চাকরি চলে যাওয়া, স্ত্রীর পালিয়ে যাওয়া, মায়ের মৃত্যু সংবাদ না পাওয়া- একজন মানুষের জীবনকে এলোমেলো করে দেওয়ার মতো যথেষ্ট
মৃত্যু মানুষের মাঝে নেমে আসে অবশ্যম্ভাবী হয়ে। তাকে এড়ানোর কোন সুযোগ নেই। জীবন নাট্যে একজন যতই অভিনয় করুক তাকে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুকে বরণ করে নিতে হয়। "অকূলপাথার " গল্পটি মৃত্যু দিয়ে শুরু, মৃত্যু দিয়ে শেষ। বন্ধু জহিরুল মামুনের মৃত্যু সংবাদ জহির আহসানকে ভীষণভাবে অবসাদগ্রস্ত করে দেয়। অভিনেত্রী লাবণ্য বিভাকে নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার সময় তিনি এ সংবাদ পান। লাবণ্য অভিনয়ে আসার পেছনে এবং যশ কুড়ানোর পেছনে এ দুজনের অবদান রয়েছে। যতসময় আমরা গল্পে থাকি ততসময় বিভিন্নভাবে অভিনয়ের ব্যাপারটি আসে। এটা লেখকের সচেতন প্রয়াস। এত এত অভিনয় আমরা প্রতিনিয়ত করে চলি, নিজের সাথে, পরের সাথে যার কোন সীমা নাই। বলতে গেলে আমরা সারাক্ষণ অভিনয়ের ভিতরেই থাকি। কিন্তু একসময় তা থেমে যেতে বাধ্য। কেননা মৃত্যুর মুখোমুখি আমাদের হতেই হয়। আর এর মাধ্যমেই সবকিছুর "মীমাংসা" হয়ে যায়। জীবন এবং মৃত্যু সম্পর্কে লেখক যে দার্শনিক অবজারভেশন দিয়েছেন তা ভাবনার খোরাক যোগায় বৈ কি।
মধ্যবিত্ত জীবনের গ্লানি, কদর্যতা, স্বার্থপরতা, পরাজয়ের হাহাকার কামালের গল্পে ধরা দেয়। যে জীবন অধিকাংশ মধ্যবিত্ত যাপন করে তার প্রতিচ্ছবি গল্পগুলোতে ফুটে উঠে। "বিদায়বেলার গান" গল্পেও এরকম একটি ছবি দেখা যায়। এক স্কুল মাস্টারের ছেলেমেয়েরা যখন উন্নতির পথে হাঁটছে তখন বৃদ্ধাবস্থায় অন্ধ হয়ে গ্রামের বাড়িতে তার শেষ জীবনের দিনগুলো কাটান। এমনকি নিজের স্ত্রীও তাকে এ অবস্থায় ফেলে রেখে আমেরিকায় সন্তানদের কাছে চলে গেছেন। বৈষয়িক স্বার্থবুদ্ধির কাছে হেরে গেছে মানবিক সম্পর্কের টান। ছেলেরা বাড়িতে মাঝে মাঝে আসে বটে তবে তা বাবাকে দেখার দায়িত্ব থেকে নেয়। ব্যতিক্রম শুধু তার বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছোট ছেলে রাজিব যে পুরো গল্প জুড়ে অবস্থান করে। বাবাকে দেখার দায়িত্ব সে নিজের কাঁধে নিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছুটিতে সে কোথাও ঘুরাঘুরি না করে বাবাকে দেখার জন্য বাড়িতে চলে আসে। বাবার প্রতি সে কতটা অনুরক্ত তা প্রকাশ পায়, বাবা যখন তার কবর নিজ ভিটায় দিতে বলেন সে কোন দ্বিধা ছাড়াই এতে রাজি হয়ে যায়। বাবা মারা গেলে সে নিজের অবস্থান ধরে রাখে। অন্য ভাইয়েরা বাড়ির ভিটায় বাবার কবর দেয়ার ব্যাপারে রাজি হয় না ভবিষ্যতে ঘরের সম্প্রসারণ বাধাগ্রস্ত হতে পারে ভেবে।ব সবার যুক্তি শুনেও রাজিব তার সিদ্ধান্ত বদলায় না। কিন্তু সময়ের আবর্তে তাকেও বদলে যেতে হয়। বাবার মৃত্যুর পর আমেরিকা চলে যাবার ব্যাপারে তার সাথে মায়ের মনোমালিন্য হয়। সে যাবে না বলে মা তাকে ভর্ৎসনা করেন। সবার কথা উপেক্ষা করে দেশেই নিজে কিছু করবে বলে থেকে যায়। কিন্তু জীবন যে এত জটিল হতে পারে তা আগে বুঝতে পারেনি। এ চরম বাস্তবতা তাকে তার সিদ্ধান্তে অনড় থাকতে দেয় না। মা আবার দেশে আসলে তার সাথে আমেরিকা যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়। মধ্যবিত্তরা এইভাবে জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে পরাজিত হয়ে যায়।
এ চরম বাস্তবতা তাকে তার সিদ্ধান্তে অনড় থাকতে দেয় না।
"আক্রোশ" গল্পে দুটি বিষয়ের মুখোমুখি হবেন পাঠক। একটি দেহজ অপরটি রাজনৈতিক। সাংবাদিক বদলুল করিম শরীরের স্বাদ মেটাতে উঠতি অভিনেত্রীকে নিয়ে বেড়াতে যান। বয়সের কারণে তার স্বাভাবিক যৌন ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। ফলে যৌন ক্ষমতা বর্ধক ভেষজ ঔষধ সেবন করেন। এ ঔষধ সেবন করে তিনি প্রথমবার অভিনেত্রীকে পরাস্ত করে দেন। একসাথে কয়েকবার তিনি তার সাথে মিলিত হন। এক পর্যায়ে মেয়েটি না করে দেয় যে সে আর পারবে না। কিন্তু পরদিন তাকে মেয়েটির কাছে পরাস্ত হতে হয়। কেননা তিনি ঔষধ সেবন না করেই তার সাথে সংগমে লিপ্ত হয়েছিলেন। মেয়েটি যেন তার আক্রোশ মিটিয়েছে। যে বীরদর্পে আগের দিন তার উপর চড়াও হয়েছিলেন পরদিন দপ করে নিভে গেলেন। এইভাবেই তিনি রাজনৈতিক অবস্থানে পরাস্ত হয়েছেন। প্রাথমিক জীবনের রাজনৈতিক আদর্শকে ভুলে গিয়ে ক্ষমতা কেন্দ্রিক রাজনৈতিক বলয়ের ভেতর ঢুকে পড়েন। অভিনেত্রীর কাছে পরাজিত হয়ে যখন ফেসবুকে ঢুকেন তখনই দেখতে পান বন্ধু এবং একসময়ের রাজনৈতিক সহকর্মী বন্ধুর স্ট্যাটাস। দুজনের চিন্তা এবং মতের মাঝে বিস্তর ব্যবধান ঘটে গেছে। ফলে একে অপরের উপর আক্রোশ প্রকাশ করে।"চিহ্ন" গল্পে দেখা যায় শেকড়-বিচ্ছিন্ন কায়েস মাহমুদ দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে শেষে শেকড়েই ফিরে আসেন। তিনি জীবনের সবদিকেই প্রতিষ্ঠিত। প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কালে তিনি ধীরে ধীরে নিজের পরিবার পরিজন থেকে সরে যান। নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার মাঝেই তিনি তার সমস্ত মনোযোগ, শ্রম ব্যয় করেন। নিজের বাবা মায়ের মৃত্যুও তাকে এ অবস্থান থেকে সরাতে পারেনি। আত্মকেন্দ্রিক চিন্তা ভাবনা তাকে তার অরিজিন ভুলিয়ে দেয়। তিনি নিজেকে উচ্চতর অবস্থানে নেয়ার জন্য দেশেও থাকেননি। চলে গেছেন বিদেশে। তার স্কুল মাস্টার বাবার অভাবের সংসারে যে জীবন তিনি যাপন করেছেন তা সম্পূর্ণ পাল্টিয়ে দিতে নিরন্তর চেষ্টা করে গেছেন। আর এর ফাঁকে যে কতটা দূরে সরে গেছেন তা উপলব্ধি করতে পারেননি। কিন্তু এ উপলব্ধি তার এসে যায় দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে। শেকড়ে ফিরে যাওয়ার তাগাদা অনুভব করেন। বউ বাচ্চাকে বিদেশে রেখে চলেও আসেন দেশে। এর ভেতরে পদ্মার ভাঙ্গনে তার শৈশবের স্মৃতি মাখানো বাড়িটি হারিয়ে যায়। যে নতুন বাড়িতে তিনি যান সেখানে আর সেই স্বাদ পান না যা পেতেন আগের বাড়িতে। মানুষ অতীতকে ভুলতে চাইলেও কি আসলে ভুলতে পারে? তার গায়ে কি শিকড়ের গন্ধ লেগে থাকে না? কায়েস মাহমুদের গায়েও এ গন্ধ লেগে আছে। গল্পের শেষ দিকে এসে দারুণ এক ইঙ্গিতের মাধ্যমে লেখক এটি বুঝিয়ে দিয়েছেন। এক বৃদ্ধ কাকা তার শরীরে এ গন্ধ পেয়ে যান। তিনি পালকি বাহক হওয়ার সুবাদে কায়েস আহমেদের মাকে অনেকবার পালকিতে বহন করেছেন। ফলে তার মায়ের গায়ের গন্ধ কাকার অনেক পরিচিত হয়ে উঠছিল। এ গন্ধই তিনি খুঁজে পান কায়েস আহমেদের গায়ে। এতদিন ধরে এত দূরে থেকেও তার শরীর থেকে এ মৌলিক গন্ধ চলে যায়নি।
বইয়ের শেষ গল্প "অমৃতের পুত্র"। নানাবিধ দুর্ঘটনার মুখোমুখি হয়ে জাহিদ তার স্মৃতি হারিয়ে ফেলে। এ গল্পের ঘটনাগুলো যেন চোখের সামনে ঘটে চলে। আমাদের চারপাশে নিত্যদিন যা ঘটে চলেছে তারই বয়ান এ গল্পে পাওয়া যায়। সড়ক দুর্ঘটনা, নারিকে অপহরণ করে ধর্ষণ, পরে খুন করা, সরকারি বাহিনী কর্তৃক মানুষ অপহরণ ও গুম- এসব এ গল্পে উঠে এসেছে। ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র জাহিদ শেষ পর্যন্ত মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। কিন্তু এ গল্পের কথক সহ যাদের সাথে তার কথাবার্তা হয় তাদের কাছে তার একসময়ের গভীর পাঠের ফলে যে চিন্তার জগৎ তৈরি হয়েছিলো তা প্রকাশ পায়। কথা প্রসঙ্গে ফ্রয়েডের কথা আসে, আসে ইয়ং এর কথা। তাদের দর্শন ব্যাখ্যা করে তিনি বুঝিয়ে দেন যে চেতন, অবচেতন ও যৌথ অবচেতন নিয়ে যে স্বাভাবিক মানুষ রয়েছে তাদের চেয়ে তিনি ভালো আছে। জগতের এত জটিলতা এত ভণ্ডামির মধ্যে তিনি নাই। শুধুমাত্র "কনশাস মাউন্ড" এই তার বসবাস। এ কথার মাধ্যমে তিনি যেন ধিক্কার ছুঁড়ে দিলেন আপাত সুস্থ মনে হওয়া জগৎ সংসারের প্রতি।
দশটি গল্পের মাধ্যমে লেখক তার চিন্তা ভাবনাকে ফুটিয়ে তুলেছেন। বর্তমান সময়ে আমাদের সমাজ বাস্তবতা কেমন যাচ্ছে, রাজনৈতিক সংকট, মধ্যবিত্ত সমাজের পচন, গলন, ব্যক্তি পর্যায়ের প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তি ইত্যাদির দেখা পাওয়া যায় গল্প সমূহে। গল্পগুলোর জীবন ঘনিষ্ঠতা লক্ষ্যণীয়। একজন লেখক এর স্বার্থকতা তো এখানেই যে তিনি তার সময়ের মানুষকে, আর্থ- সামাজিক, রাজনৈতিক বাস্তবতাকে আনুবীক্ষণিক দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে তার লেখায় তুলে আনতে পেরেছেন কি না। আহমাদ মোস্তফা কামাল এ ক্ষেত্রে সফল হয়েছেন বলা যায়।
================
বড়োদের গল্প যেমন হয়
আহমাদ মোস্তফা কামাল
প্রচ্ছদঃ মোস্তাফিজ কারিগর
প্রকাশনীঃ নাগরি
পৃষ্ঠাঃ ১২০
মূল্যঃ ২৫০ টাকা
ISBN: 978–984–94391–1–0
2 মন্তব্যসমূহ
আগ্রহ তৈরি হয়েছে। ধন্যবাদ আলোচককে।
উত্তরমুছুনআহা! কি মর্মান্তিক জীবন মানুষের? আলোচকের কলমগুণে লেখকের সহৃদয়তা ছুয়ে গেল৷
উত্তরমুছুনমার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম