কাঠগড়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়- রিমান্ড ও কারাগারের দিনলিপিঃ ড. মো. আনোয়ার হোসেন

কাঠগড়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়- রিমান্ড ও কারাগারের দিনলিপিঃ  ড. মো. আনোয়ার হোসেন

বইটি মনোযোগের সাথে পড়লাম। একজন শিক্ষক তার ছাত্রের পক্ষে থাকার কারণে যে ভোগান্তির শিকার হয়েছেন তার বিস্তারিত বিবরণ এখানে আছে।

বইটির দ্বিতীয় ফ্লাপে যা আছে তা হুবহু উদ্ধৃত করছি।
২০ আগস্ট ২০০৭ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেনা সদস্য কর্তৃক ছাত্র লাঞ্চিত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ২০-২২ আগস্ট - এই তিন দিনের স্বত:স্ফূর্ত উত্তাল বিক্ষোভ শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সীমাবদ্ধ থাকেনি। ছড়িয়ে পড়েছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং এমনকি কলেজগুলোতেও, শিক্ষকেরা বিপন্ন ছাত্রদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। ২৩ আগস্ট ২০০৭ রাতে ড. আনোয়ার হোসেন গ্রেফতার হয়েছিলেন। ২২ জানুয়ারি ২০০৮ পর্যন্ত তিনি ১২ দিন রিমান্ডে ও ৫ মাস বন্দি ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্র-ছাত্রীর এক অভূতপূর্ব অহিংস এবং একই সাথে প্রচণ্ড শক্তিশালী আন্দোলনের মাধ্যমে বন্দি শিক্ষক-ছাত্রদের মুক্ত করেন ২২ জানুয়ারি সন্ধ্যার প্রাক্কালে। ২০ আগস্ট ২০০৭ পর্যন্ত সময়ের দিনলিপি বিবৃত হয়েছে এই পুস্তকে। দিনের শুরু এবং শেষ যেমন আছে, তেমন দিনের অতীত এবং ভবিষ্যতও আছে।
বহুদিন কোনো বই পড়ে মন খারাপ হয়না। এই বইটা পড়ে হল। একজন শিক্ষকের কাছে পিতামাতারা সন্তানকে পাঠান পড়াশোনা করতে। সন্তানের সবরকম দায়দায়িত্ব শিক্ষকের কাছে থাকে। তাদের সার্বিক নিরাপত্তার দায়ভার বহন করতে হয় ঐ শিক্ষককেই। এরকম মনোভঙ্গি থেকে ড. আনোয়ার হোসেন তাঁর ছাত্রদের পক্ষাবলম্বন করতে গিয়েছিলেন। এই স্নেহবোধ ও মানবিক মনোভঙ্গির কারণে তাকে যে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তা সত্যিই হতাশাব্যঞ্জক। ছাত্ররা দোষী হতে পারে আবার নাও পারে। সেটা আলোচনা সাপেক্ষে নির্ধারণ করা যেতে পারে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ করা হয়েছিল যা সত্যিই একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ তা সে শিক্ষকই করুক আর যেই করুক। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ। তারা দেশের নিরাপত্তা বা রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্রদেরকে ভয় পাবে, তাদের কাছ থেকে বিপদের আশংকা করবে এটা ভাবতে মন চায়না।

ড. আনোয়ার হোসেনের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও তিনজন শিক্ষককে গ্রেফতার করা হয়েছিল।

বইটি পড়ে যে শুধু দু:খ পেয়েছি তা নয়; কিছু কিছু জায়গা পড়ে হতবাক হয়ে গেছি। যেমন ২৪ আগস্ট ২০০৭ এর ঘটনাবলী(পৃ-১৮)।

২৪ থেকে ২৫ আগস্ট পর্যন্ত বলতে গেলে একটানা কঠিন জিজ্ঞাসাবাদ চলল। প্রথম, ২য়, ৩য় ডিগ্রির জিজ্ঞাসাবাদ টিম আছে। ৩য় অর্থাৎ সবচেয়ে কঠোর টিম দিয়ে শুরু করে ১ম টিম দিয়ে শেষ_ এমন সাইকেলে চলে জিজ্ঞাসাবাদ। শুরু হয় এভাবে- কাপড় পরেন, যেতে হবে। শার্ট, প্যান্ট পরে নেই। দু্ই পট্টি কালো কাপড় দিযে চোখ বাঁধা হয়। আমার পেছনে দাঁড়িয়ে রক্ষী দুই স্কন্ধে ধরে সামনের দিকে নিয়ে যেতে থাকে। কখনও বলে, পা একটু উঁচু করুন, ডানে, বাঁয়ে যান ইত্যাদি।এরপর একটি কক্ষে কাঠের বেঞ্চে বসায়। চারদিক শান্ত। হঠাৎ পদশব্দ, চেয়ার টেনে বসার শব্দ। জিজ্ঞাসা শুরু হয়। সবচেয়ে খারাপ নমুনা- "এই বল, তোর নাম কী?" বলি, ড. মো. আনোয়ার হোসেন।" বল, তোর নামের অর্থ কী। উত্তর দেই না। বলে, ডক্টর অর্থ কী। বলি পিএইচডি, ডক্টর অব ফিলোসফি। চিৎকার করে গালি দেয়। অবাক হই যখন ডান বাহুতে ব্যাটনের আঘাত আসে। আমার চোয়াল শক্ত হয়, আঙুল শক্ত হয়, দাঁতে দাঁত চাপি। সে হয়ত তা পর্যবেক্ষণ করে। হয়ত পছন্দ হয় না। বাম গালে হাত দিয়ে জোরে ডানে ঘুরিয়ে দেয়। তারপর প্রশ্ন, "তোর ভাইরা কি করে?" বলি আমার এক ভাই কর্ণেল আবু তাহের বীর উত্তমকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করেছে জেনারেল জিয়া। ভোজবাজির মত কি ঘটে যায়। "একে আর কিছু জিজ্ঞাসাই করব না" - রাগের মাথায় এই কথা বলে সশব্দে সে প্রস্থান করে। আমার মধ্যে তেমন কোন প্রতিক্রিয়া হয় না। শুধু অবাক হই, একজন তো জিজ্ঞাসাবাদে আসে না। অন্তত দুজন থাকে। বুঝি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিশেষ করে আমার উপর তার প্রচণ্ড বিদ্বেষ। সম্ভবত সে ছিল ৩য় ডিগ্রি টিমের। এরপর বেশ কয়েকজন এলেন। চেয়ারে বসে, সম্ভবত দলনেতা পরিহাসের সাথে জিজ্ঞাসা করলেন, "বলেন আপনাকে কি বলে ডাকব?" বস, বাবা, ওস্তাদ না অন্য কিছু?" আমি বললাম, আমার নামে ডাকতে পারেন। আর আমার বয়স ৫৭ বছর। আপনারা সবাই আমার চেয়ে কনিষ্ঠই হবেন। যেহেতু আমি একজন প্রবীণ অধ্যাপক, তাই আমাকে স্যার ডাকতে পারেন।
সত্যিই ড. আনোয়ারের স্নায়ুশক্তি অসাধারণ। প্রশংসা করতে হয়। তবে একটি জায়গায় আমি প্রচণ্ড দু:খ পেয়েছি। ২৬ পৃষ্ঠায় আছে একজন অফিসার চিৎকার করে বলেছিলেন -My father was also a bloody teacher। ড. আনোয়ার হোসেন জোরে উত্তর দিয়েছিলেন -He was not a bloody teacher, he was a respectful teacher। আমি ড. আনোয়ারের দৃষ্টিকোণ থেকে নয় একটি ভিন্ন বিষয়ের কারণে ওই অফিসারটির প্রতি সহানুভূতি পোষণ করি। এই বইটি কিনেছি ৪ মার্চ তারিখে। পড়েছি তখনই। তখন থেকে এই লাইনগুলি আমাকে মাঝেমাঝেই আলোড়িত করত। সেই অফিসার তার শিক্ষক পিতাকে কেন ব্লাডি বললেন? এর কারণ কি? আমি বুঝতে পারছিলাম না। ২১ মার্চের প্রথম আলো পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকীতে মাহবুব আলম এর লেখা বাংলার পাঠশালা প্রবন্ধটি পাঠ করার পর বিষয়টা স্পষ্ট বুঝতে পারলাম।

শিক্ষককে দ্বিতীয় পিতা বলা হয়। আগে সন্তানকে গুরুগৃহে পৌঁছে দিয়ে পিতা বলতেন -সন্তানের হাড় আমার আর মাংসগুলো আপনার অর্থাৎ শিক্ষককে দেয়া হত নির্যাতনের অবাধ অধিকার। সাহিত্য সংসদের ইংরেজি-বাংলা ডিকশনারী অনুযায়ী Bloody শব্দটির অর্থ হল- রক্তবৎ, রক্তাক্ত, খুনে, নিষ্ঠুর, জারজ; অর্থহীন গালিরূপে ব্যবহৃত। অফিসার কোন অর্থে শব্দটি ব্যবহার করেছেন তা পরিষ্কার নয়। তবে নিষ্ঠুর অর্থে ব্যবহার করেছেন বলেই মনে হল। কারণ কিছু কিছু শিক্ষক আছেন যারা সত্যিকার অর্থে নিষ্ঠুর, স্যাডিস্ট। ছাত্রদের উপর নির্যাতন করে মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা পশুত্বের চর্চা করেন। এমন একজন ভয়ানক শিক্ষকের দেখা আমি ছাত্র জীবনে পেয়েছিলাম। তখন আমি বাবার চাকরিসূত্রে দিনাজপুরের সেতাবগঞ্জে ছিলাম। ৮ম-৯ম শ্রেণীতে পড়ি। তিনি দেখতে হুজুর টাইপের। লম্বা আলখেল্লা, লম্বা দাড়ি এবং টুপি। নূরাণী চেহারার মত তার মনটাও কোমল হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তিনি বাস্তবে ছিলেন হিংস্র আর রক্তলোভী পাশবিকতার সমার্থক। এমন কোন দিন নেই যেদিন তিনি ক্লাসের প্রত্যেক ছাত্রকে পেটাননি। মেয়েরাও তার হাত থেকে রেহাই পেত না। এই ধরণের ভয়ানক চরিত্রের শিক্ষক হয়ত ছিলেন ওই অফিসারের পিতা। তিনি যে নিষ্ঠুরতা ও আতঙ্ককে সাথী করে শৈশব পার করেছেন। তাই হয়তো ড. আনোয়ারকে দেখে তার মনে পড়ে গিয়েছিল। আমার ভাবনা একেবারে অবান্তর নয়। তার প্রমাণ রয়েছে বাংলার পাঠশালা প্রবন্ধে। প্রবন্ধটির একটি অংশ আমি হুবহু তুলে ধরছি।

রূঢ় বাক্য, কঠোর ব্যবহার এবং যথেচ্ছ বেত্রাঘাত গুরুমশায় ও ওস্তাদজিকে অনেক সমালোচনার মুখোমুখি করেছে। কাণ্ডজ্ঞানহীন শাস্তি দেওয়ার কাহিনী যে অতিরঞ্জিত ছিল না তার প্রমাণ উইলিয়াম এডামের দেশীয় শিক্ষা সংক্রান্ত রিপোর্ট (১৮৩৫)। এ রিপোর্টে গা-হিম করা ভাষায় ১৪ রকম শাস্তির বিবরণ দেওয়া হয়েছে। পাঠশালায় বেত্রাঘাত, চ্যাংদোলা করা, জলবিছুটি লাগানো ছাড়াও থলের মধ্যে বিড়ালের সঙ্গে পড়ুয়াকে ঢুকিয়ে মাটিতে গড়ানো ছিল প্রচলিত শাস্তি। এত সব শাস্তির অজুহাত অবশ্যই একটি, মার না দিলে উচ্ছন্নে যাবে। অভিভাবকেরা এই মারতত্ত্ব মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন।
ওই অফিসারকেও হয়তো এই ধরণের কোন নৃশংস অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। সে জন্যই তিনি শিক্ষকদেরকে রক্তলোভী/ খুনে বলেছেন। সত্যিই কিছু কিছু শিক্ষক আছেন যাদের মানসিক চিকিৎসা করানো দরকার। তারা কিভাবে যে বাচ্চাদেরকে পেটায় তা আমি বুঝতে পারিনা। শিক্ষক হিসেবে আমি ওই অফিসারের অভিজ্ঞতার জন্য আন্তরিকভাবে দু:খিত।

কিছু সাধারণ তথ্য


কাঠগড়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
রিমান্ড ও কারাগারের দিনলিপি

ড. মো. আনোয়ার হোসেন
প্রকাশক : আগামী প্রকাশনী
ফেব্রুয়ারি ২০০৮
মূল্য ২০০.০০
প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ