আজাদ মণ্ডলের উপন্যাস "বিষয় ভ্রমণ শেষে" - শেখর দেব

আজাদ মণ্ডলের উপন্যাস "বিষয় ভ্রমণ শেষে"
২০১৯ গ্রন্থমেলায়  প্রকাশিত আজাদ মণ্ডলের "বিষয় ভ্রমণ শেষে" উপন্যাসটি মূলত জীবনঘনিষ্ঠ ভ্রমণের প্রতিচ্ছবি। উপন্যাসটি আপাত অসংগত ভ্রমণ ও যাপনের গল্প মনে হলেও, প্রকৃত অর্থে সংগত বিষয়ের ভ্রমণ ও বোধোৎসারিত গল্পের সচেতন প্রকাশ। একটি গল্প শাখা প্রশাখা মেলে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে উপন্যাসের মহিরুহ হয়ে একটি সুশীতল পরিবেশ তৈরি করেছেন লেখক। পাঠক সেই মহিরুহের ছায়াতলে বসে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন। জানা অথবা না-জানা বিষয়ের চিত্রায়ন ও পরিমিত বয়ান আমাদের আপন হয়ে ওঠে। আপামর জনগোষ্ঠীর বোধ ও চেতনায় নাড়া দেয়ার মতো বিষয় ও ভাষ্য সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো আন্দোলিত করে আমাদের নিউরনে। অবিচ্ছিন্ন  একটি কাহিনী ছোট ছোট সংগত গল্পের পুতি দিয়ে উপভোগ্য সুন্দর একটা মালা যেন উপন্যাসটি।

নায়কের বেকারত্ব হতে অথবা কিছুটা স্বতন্ত্র যাপনের প্ররোচনা হতে এই উপন্যাসের জন্ম। দেশের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী একজনের বেকারত্ব, ভাই-ভাবীর উপর নির্ভরশীলতা, প্রেম হারানোর ভয়, সচেতন নাগরিক হবার অন্তর্গত ইচ্ছা এবং নিজ পায়ে দাঁড়ানোর মতো ব্যক্তিত্ববোধ ফুটে উঠেছে উপন্যাসে। এছাড়াও সংগত কারণে এসেছে দেশের অসংগত চিত্রগুলো।

চরিত্র চিত্রণে লেখকের সচেতনতা লক্ষ করার মতো। একজন মুক্তিযোদ্ধার মানবেতর যাপন, তার চিন্তা ও চেতনার প্রভাবে প্রভাবিত উপন্যাসের বেকার নায়ক, বাস্তবতার শিকার প্রেমিকা, নায়কের প্রাইভেট পড়ানো ছাত্রীর নায়িকা হয়ে উঠা, নায়কের উদার বড় ভাই ও ভাবী, এছাড়াও উপন্যাসের গল্পের প্রয়োজনে উঠে আসা ছোট ছোট চরিত্রগুলোও দক্ষতার সাথে ফুটিয়েছেন। একজন ঔপন্যাসিককে উপন্যাসের সকল চরিত্রকে সমান গুরুত্বপূর্ণ মনে করে চিত্রিত করতে হয় প্রেক্ষাপট। এইদিক দিয়ে উপন্যাসিক শতভাগ সফল।

উপন্যাসের ভাষার দিকে খেয়াল করলে দেখা যায় আজাদের ভাষা সহজবোধ্য, যুক্তিযুক্ত ও সাবলীল। উপমা প্রয়োগে মুন্সিয়ানা এবং পৌরাণিক চরিত্র হতে তুলে আনা বিষয়গুলো উপন্যাসের ভাষাকে দিয়েছে আলাদা মাত্রা। পাঠকে টেনে নেয়ার ক্ষমতা এবং সহজাত রসবোধ পাঠককে সহজে মুগ্ধ করে।

উপন্যাসে প্রধানত বাংলাদেশের রাজনৈতিক শঠতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, রোহাইঙ্গা ইস্যু, বেকারত্ব, প্রেম-ভালোবাসা বিষয়গুলো উঠে এসেছে কাহিনির প্রয়োজনে। এছাড়াও আরো অনেক বিষয় উপন্যাসের পরতে পরতে উঁকিঝুঁকি দিয়ে গেছে।

সত্যিকার অর্থেই এটা যেন উদাসীন ভ্রমণের মধ্যে ফুটে উঠেছে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয়। 

উপন্যাসের নায়ক রনি রহমান বেকারত্বের ভার মাথায় নিয়ে বোঝা হয়ে আছে যেন বড়ভাই-ভাবীর সংসারে। রনির মাথায় খেলা করে আবোল তাবোল কত বিষয়, কখনো সংগত কখনো অসংগত বিষয়ে না চাইতেই যেন ভ্রমণ করতে হয়। কর্মহীন মানুষের মাথায় যেমন হাজারো চিন্তা এসে ঘিচঘিচ করে ঠিক তেমনি। সকাল বেলা ঘুম ভাঙার পরপরই ভাই-ভাবীর (রহিম ও মোমেনা) টিটকারি রনিকে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘর থেকে বের হয়ে যেতে প্ররোচিত করে। সেই প্ররোচনায় পড়ে নায়ক রনিকে জীবনের এমন একটি ভ্রমণের সম্মুখীন করাবে তা বুঝে উঠতে পারেনি। যে ভ্রমণের মধ্যেই উপন্যাস ছুঁয়ে গেছে নানাবিধ বিষয়ের ভেতর। একে একে আমাদের সামনে প্রস্ফুটিত হয় ছাত্রী মিলি, প্রেমিকা সোমা, মুক্তিযোদ্ধা আনু চাচা, সরকারি অফিসের দারোয়ান আনিস, মন্ত্রী বাহাদুর সাহেব, ফুটপাতের দোকানদার মনির ইত্যাদি চরিত্রগুলো। সত্যিকার অর্থেই এটা যেন উদাসীন ভ্রমণের মধ্যে ফুটে উঠেছে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয়। প্রেমিক হারানোর ব্যথা পাঠকের মনে দাগ কাটার আগেই ছাত্রী মিলির প্রেমিকারুপে আবির্ভাব স্বস্তি দেয়। ঔপন্যাসিক আজাদ মণ্ডল পজেটিভনেসের পক্ষেই দাঁড়িয়ে যান বা দাঁড়াতে পছন্দ করেন। তাই তিনি সমাজ ও রাষ্ট্রের সফল সমালোচক। গল্পের ছলে চলমান ছিল এই সমালোচনা উপন্যাসের ভাষায় ও বিষয়ে।

আজাদ মণ্ডলের প্রথম উপন্যাস হিসেবে তিনি সামগ্রিকভাবে সফল ঔপন্যাসিক বলে তকমা দিলে তেমন বেশি কিছু দেয়া হয় না। যদিও হুমায়ুন আহমেদের বিভিন্ন চরিত্রের অসাবধান ছাপ রনি রহমানের চরিত্রে দৃশ্যমান, তবুও ভাষা ও বয়ানের দক্ষতা আজাদকে কিঞ্চিৎ আলাদাই করে রেখেছে। সামগ্রিকভাবে উপন্যাসটি পাঠকের মনোরঞ্জন করতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস।

===============
বিষয়ভ্রমণ শেষে
আজাদ মণ্ডল

প্রচ্ছদ: চারুপিন্টু
প্রকাশ: বইমেলা ২০১৯
প্রকাশনী: দৃষ্টি
পৃষ্ঠা: ১৮৪
মূল্য: ৩০০টাকা।

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ